দামের ঝাঁজ

চিররঞ্জন সরকার

ফাইল ছবি

নির্বাচনের ডামাডোলে আকস্মিকই আবার আলোচিত হয়েছে পেঁয়াজ। আটই ডিসেম্বর সকালেও যে পেঁয়াজ ১০০ থেকে ১২০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়েছে, সন্ধ্যা পেরোতেই তার দাম ২০০ ছাড়িয়ে যায়। ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করেছে, এমন খবর আসামাত্র দেশের বাজার জুড়ে প্যানিক ছড়িয়ে পড়ে। ক্রেতারা যে পণ্য কিনেছেন ১০০ থেকে ১২০ টাকায়, এক দিনেই সে পণ্যের দাম ২০০ টাকা ছাড়িয়ে যায়। ভারত রপ্তানি বন্ধ করার ঘোষণা দেওয়ার পর পরই দাম বাড়তে পারে না। এটা সুশাসনের ঘাটতি। ব্যবসায়ীরা যেমন খুশি দাম নির্ধারণ করছে, সরকারের কোনো বিধিবিধানের তোয়াক্কা করছে না। সরকারও তাদের কিছু করতে পারছে না। মুনাফালোভী ব্যবসায়ী-সিন্ডিকেটের কারণে ক্রেতারা প্রায়ই দুর্ভোগে পড়ছে। খাবারের পাতে পেঁয়াজ ‘অত্যাবশ্যক’ কি না, তা মানুষের রুচি স্থির করবে। কিন্তু আকস্মিক পেঁয়াজের দামের ঝাঁজে মানুষ নাকাল হবে, এটা মেনে নেওয়া মুশকিল।

গত কয়েক বছর ধরেই রান্নাঘরের পেঁয়াজ আর রান্নাঘরে নেই। বাজার থেকে অফিস সর্বত্রই এখন আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। ‘পেঁয়াজ না খেলে কী হয়, কিংবা চাপ কমাতে এক কেজির জায়গায় আধা কেজি কেনেন’—এমন কথা আলোচনায় বারবার উঠে এলেও পেঁয়াজ ছাড়া যেন চলছেই না। আর এই সুযোগে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ইচ্ছামতো দামে পেঁয়াজ বিক্রি করছেন। এতে বিপাকে পড়েছেন স্বল্প আয়ের মানুষ।

universel cardiac hospital

দেশে বছরে পর্যাপ্ত পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়েছে। আমদানিও হয়েছে অনেক। এ ছাড়া বাজারে নতুন মুড়িকাটা পেঁয়াজ উঠতে শুরু করেছে। ফলে বাজারে এ পণ্যের কোনো সংকট নেই। এ ছাড়া বছরে আমদানির দরকার হয় ৬ লাখ টন। কিন্তু আমদানি করা হয়েছে ৮ লাখ টনের বেশি। চাহিদার চেয়ে বেশি পেঁয়াজ দেশের বাজারে সরবরাহ ও মজুত রয়েছে। এ ছাড়া অনেক পেঁয়াজ দেশে আসার পথে পাইপলাইনে আছে। তার পরও কথিত সিন্ডিকেট ভারতের পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের দোহাই দিয়ে পরিকল্পতিভাবে এর দাম বাড়াচ্ছে।

একসঙ্গে দুই কেজি পেঁয়াজ কিনলে ‘ট্যাক্স আইডেনটিফিকেশন নম্বর বা টিআইএন’ দেখাতে হবে, কারণ এটি ‘হাই ভ্যালু ট্র্যানজাকশন’ গত কয়েক দিনে এই রসিকতাটি অনেকের মুখেই শুনলাম। সেদিন এক সহকর্মী ধাঁধা জিগ্যেস করলেন, বলুন তো, কোনো জিনিস কাটতে গেলেও কান্না আসে, কিনতে গেলেও কান্না আসে! তেমন কিছু অনুমান করতে না পেরে আমি ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলাম! এবার চটপটে সহকর্মীটি হেসে বললেন, না আপনি খুবই ডাল-ব্রেইনের। এটার উত্তর জানেন না? এটা হলো পেঁয়াজ!

সেদিন এক বান্ধবী ইনবক্সে জোক পাঠিয়েছে।

স্ত্রী : কী ব্যাপার! বাজার থেকে পেঁয়াজ আনোনি কেন, দাম বেশি বলে পেঁয়াজ আনবে না?

স্বামী : না, ঠিক তা নয়।

স্ত্রী : তাহলে?

স্বামী : পেঁয়াজ কাটতে বসে তুমি প্রতিদিন চোখের জল ফেলবে, দৃশ্যটা আমি সহ্য করতে পারি না!

পেঁয়াজ নিয়ে এখন এমন রসিকতার রমরমা চলছে। এ ধরনের রসিকতা যখন সর্বজনীন হয়ে ওঠে, তখন বোঝা যায়, পরিস্থিতি আসলে নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে বা গেছে। এক কেজি পেঁয়াজের দাম যদি ২০০-২৫০ টাকা হয়, রসিকতাই তখন একমাত্র সান্ত্বনা। পেঁয়াজের দাম অবশ্য আমাদের দেশে নানা সময়ে নানা কারণে বেড়ে থাকে। কখনো শোনা যায়, বৃষ্টি কম হয়েছে বলে ফসলের জোগানে টান পড়েছে, কখনো অতিবৃষ্টির ঘাড়ে দোষ চাপে। কখনো ভারত রপ্তানি বন্ধ করার কারণে পেঁয়াজের দাম বাড়ে। কখনো আমদানিকৃত পেঁয়াজ পচে যাওয়ার কারণে দাম বাড়ে। অর্থাত্, সমস্যাটি এই বছরের জন্য বিশেষ নয়, তা কাঠামোগত। সরকার পেঁয়াজের দাম বাগে রাখতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। পেঁয়াজ আমদানির জন্য অনেক চেষ্টা করা হচ্ছে। আমদানি শুল্ক কমিয়ে ব্যবসায়ীদের পেঁয়াজ আমদানিতে উৎসাহিত করা হচ্ছে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না।

পেঁয়াজের উৎপাদনের ওঠাপড়া বা ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানিতে সংকটের কারণে এর দামে প্রভাব ফেলে, সে কথা অনস্বীকার্য। কিন্তু, এটাই একমাত্র কারণ নয়। আমাদের দেশে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বাজারের নিয়ন্ত্রণ মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণির হাতে। দাম বাড়ার ইঙ্গিতমাত্র পেলেই তারা পেঁয়াজ মজুত করতে থাকেন, ফলে বাজারে দ্রুত দাম বাড়তে থাকে।

মজুতদারির পেছনে রয়েছে ভবিষ্যতের দাম সম্বন্ধে অনিশ্চয়তা ও অতিলাভের প্রত্যাশা। মধ্যস্বত্বভোগীরা যখন অদূর ভবিষ্যতে পণ্যের দাম বাড়ার প্রত্যাশা করেন, তখনই তারা পণ্য মজুত করেন। সেই অনিশ্চয়তা যদি কেটে যায়, যদি ভবিষ্যতের মূল্যস্তর সম্বন্ধে প্রত্যেকেরই স্পষ্ট ধারণা থাকে, তাহলে আর মজুতদারির কোনো প্রণোদনা অবশিষ্ট থাকে না। দুইটি পথে এমন অবস্থায় পৌঁছানো সম্ভব। প্রথম পথটি সনাতন পথ। সরকার কৃষকদের কাছ থেকে পেঁয়াজ কিনবে এবং বাজারে দাম একটি নির্দিষ্ট স্তর অতিক্রম করলেই সেই পেঁয়াজ বিক্রি করবে। পথটি শুনতে সহজ, কিন্তু বাস্তবে তা করে দেখানো অনেক কঠিন। আর পেঁয়াজ বিক্রি করা সরকারের কাজ নয়। কাজেই, দ্বিতীয় পথটিই ভরসা। তা হলো, কমোডিটি এক্সচেঞ্জে পেঁয়াজের মতো পণ্যের ফিউচার্স বাজার খুলবার পথ। এই বাজারটি খুললে ভবিষ্যতের দাম সম্বন্ধে অনিশ্চয়তা বহুলাংশে কেটে যাবে। একই সঙ্গে চাহিদা নির্ধারণ করে সে অনুযায়ী আমদানির ব্যবস্থা করা। এই জিনিসটি মজুতযোগ্য এবং প্রয়োজনীয়। আমাদের দেশে তো দেওয়ালে পিঠ না ঠেকলে সংস্কার বা স্থায়ী সমাধানের পথ খোঁজা হয় না। পেঁয়াজের দাম সাধারণ মানুষকে সেই অবস্থায় এনে ফেলেছে। এ ব্যাপারে যা করার এখনই করা দরকার।

মুখে যত যা-ই বলি না কেন, আমরা এখন পেঁয়াজখোর জাতিতে পরিণত হয়েছি। পেঁয়াজ ছাড়া আমাদের চলে না, চলবেও না। পেঁয়াজ একদিকে মসলা, অন্যদিকে সবজি। কাঁচাও খাওয়া যায়, আবার রান্না করেও খাওয়া যায়। ভাজি-ভর্তা-ঝোল সবখানে সমান গুরুত্বপূর্ণ। সব দলের কাছে ব্যবসায়ীরা যেমন বিশেষ মর্যাদা পায়, ঠিক তেমনি ধনী-গরিব সবার কাছেই পেঁয়াজ বিশেষ মর্যাদা পায়। পেঁয়াজের চেহারা সাইজ-স্বাদ-সব কিছুই আলাদারকম। এর কাণ্ড-পাতা-ফুল-ফল সবটাই প্রায় প্রকাশিত। এর শিকড় পর্যন্ত দেখা যায়। ঠিক বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের মতো। সব বাঙালির যেমন মোটামুটি একই রকম চেহারা-চরিত্র-প্যাঁচ, সব দেশি পেঁয়াজেরই ঠিক একই রকম কোয়া ও ঝাঁজ!

বাঙালি সমাজে কবে প্রথম পেঁয়াজ খাওয়া শুরু হয়—এ ব্যাপারেও বিস্তারিত কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। ভাসা ভাসা যতটুকু তথ্য পাওয়া যায়, তাতে দেখা যায়, বৈষ্ণব ও ব্রাহ্মণরা সাধারণত পেঁয়াজ খেত না। পেঁয়াজ খেলে মানুষের ‘তেজ’ বাড়ে—এমন একটা ধারণা সমাজে প্রচলিত আছে। তাই তো হিন্দু বিধবা কিংবা সন্ন্যাসীরা নিরামিষ খায়। নিরামিষে পেঁয়াজ নিষিদ্ধ। পেঁয়াজকে আমিষ হিসেবে গণ্য করা হয়। ভারতবর্ষে মুসলিম শাসন বিস্তৃতির সঙ্গে সঙ্গে পেঁয়াজের বিকাশ ঘটেছে বলে অনেক পেঁয়াজবিদ মনে করেন। ব্যাপারটিকে অযৌক্তিক বলা যাবে না। মাংসপ্রিয় মুসলিম শাসকদের হাত ধরে এই বাংলামুলুক এমন পেঁয়াজময় হওয়াটা মোটেও অবিশ্বাস্য নয়।

এখন দুঃখ-দারিদ্র্য-অভাব-অনটন-কলহের মতো বাঙালির জীবনে পেঁয়াজ অনিবার্য হয়ে উঠছে। পেঁয়াজ ছাড়া রান্নাঘর চিন্তা করা যায় না। পেঁয়াজ খাওয়া এখন বাঙালির অভ্যাস হয়ে গেছে। যে পদে না দিলেও চলে, সেখানেও পেঁয়াজ দেওয়া হয়, আর যেখানে পেঁয়াজের দাবি আছে, সেখানে তো দেওয়া হবেই। অভ্যাসবশেই এখন রান্নায় কমবেশি পেঁয়াজ দেওয়া হয়। এ কারণে পেঁয়াজের চাহিদা দিনদিন বেড়ে চলেছে। পেঁয়াজের প্রতি এই আকর্ষণ যদি অব্যাহত থাকে, আর দাম যদি না কমে, তাহলে পেঁয়াজ কিনতে কিনতেই গোটা জাতি ফতুর হয়ে যাবে।

পেঁয়াজের দাম বাড়ুক, এর ঝাঁজ জাতির চোখকে যতই আচ্ছন্ন করুক, তাতে আমাদের অবশ্য তেমন কিছু যায়-আসে না। কারণ মানুষ পেঁয়াজ ছাড়াও বাঁচে, বাঁচতে পারে। ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই বাঁচতে হবে!

পুনশ্চ : মহাখালীর এক রেস্টুরেন্টে সাইনবোর্ড টাঙানো হয়েছে : পেঁয়াজ চাহিয়া লজ্জা দিবেন না! মহাখালী টিবি গেটের পাশের এই হোটেলে ভিড় ভালোই হয়। এখানে ভাত-সবজির সঙ্গে এক টুকরো করে পেঁয়াজ দেওয়া হতো। কিন্তু এখন উধাও। হোটেল মালিক আবুল হোসেন বলেন, ১৩০-১৪০ টাকা কেজিতে পেঁয়াজ কিনে আর ক্রেতাদের পাতে দিতে পারছি না। এক্সট্রা লেবু দিচ্ছি, শসা দিচ্ছি, মরিচ দিচ্ছি। কিন্তু তাতে ক্রেতাদের মন ভোলানো যাচ্ছে না। অনেকেরই পেঁয়াজ ছাড়া ভাত রোচে না! এ অবস্থায় উপায়ান্তর না দেখেই ‘পেঁয়াজ চাহিয়া লজ্জা দিবেন না’ এটা লিখতে হয়েছে।

এই হোটেল মালিকের মতো সরকারও রেডিও-টেলিভিশনে প্রচারের উদ্যোগ নিতে পারে : ‘পেঁয়াজ চাহিয়া লজ্জা দিবেন না!’

লেখক : রম্য লেখক

শেয়ার করুন