৫২ বছর একজন মানুষের জন্য কম নয়। আমরা যারা এখন জীবনের শেষ প্রান্তে, তখন আমরা তরতাজা যুবক। ১৬ ডিসেম্বর মুক্ত হলো স্বদেশ; যার জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন ৩০ লাখেরও বেশি মানুষ, ধর্ষিত হয়েছিলেন পাঁচ লাখেরও বেশি নারী। ভাবিনি যে, স্বাধীনতার ৫০ বছর দেখে যাব। এখনও মনে হয়, সেদিন না স্বাধীন হলাম, অথচ পেরিয়ে এসেছি জীবন।
যেদিন দেশ স্বাধীন হয়, সেদিনটিকে স্বাধীনতা দিবস হিসেবেই আখ্যা দেওয়া হয়। আমাদের কিন্তু তা নয়। মুক্তির দিবস আমাদের কাছে বিজয় দিবস। এর একটি তাৎপর্য আছে। তা হলো, বাঙালি কখনও যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েনি; স্বাধীনতা ভোগ করেনি এ অর্থে যে, কোনো বাঙালি এ ভূখণ্ড শাসন করেনি। তা ছাড়া বাঙালি কখনও ঐক্যবদ্ধ ছিল না। সে বাঙালি পৃথিবীর একটি শক্তিশালী দেশের সঙ্গে যুদ্ধ করে জয়ী হয়েছে, যেখানে একটি দেশ ছাড়া সব দেশ ছিল বিপক্ষে। আর ওই জয় তো যে সে জয় নয়, বিরাট জয়। এবং বাঙালি জিতেছিল এ কারণে যে, ঐক্যবদ্ধ হয়ে তারা বাঙালি হিসেবে লড়েছিল; মুসলমান, হিন্দু, খ্রিষ্টান পরিচয়ে নয়।
১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু রমনার মাঠে বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘আমি স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলে দিতে চাই যে, আমাদের দেশ হবে গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতান্ত্রিক দেশ। এ দেশের কৃষক-শ্রমিক, হিন্দু-মুসলমান সবাই সুখে থাকবে, শান্তিতে থাকবে।’
শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু একটি আদর্শ রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। রাষ্ট্রের চার নীতি মূলনীতি হিসেবে সংবিধানে সংযোজিত করেছেন, যা তখনকার পরিপ্রেক্ষিতে কোনো রাষ্ট্রনায়ক করার সাহস করেননি। শুধু তাই নয়, সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ছাড়া যে কাজটি কেউ করার সাহস দেখায়নি, সেটি তিনি করেছিলেন, রাজনীতিতে ধর্ম নিষিদ্ধ করেছিলেন। এ কারণে তিনি বীর বঙ্গবন্ধু।
১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর অর্জন অনেক। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরের দু’দশকের কাহিনি সবার জানা। আদর্শিক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের পতন ঘটে, কারণ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ মূল নীতিই বাতিল করা হয়েছিল। ঘাতকদের মুক্তি শুধু নয়, ক্ষমতায় বসানো হয়েছিল। ১৯৪৮ থেকে পাকিস্তান থেকে এ ভূখণ্ড বাংলাদেশ হওয়ার পথে যাত্রা করেছিল। পরবর্তী দু’দশক ছিল বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানের দিকে যাত্রা বা পিছু হটা, যা পৃথিবীর ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা। ধর্ম আবার রাজনীতির কেন্দ্রে চলে আসে, সব দিক থেকে বাংলাদেশের অবনতি ঘটে। বস্তুত জিয়াউর রহমান, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, খালেদা জিয়া ও মতিউর রহমান নিজামী বাঙালি হয়ে বাংলাদেশের যে ক্ষতি করেছেন, গত কয়েকশ বছরে কোনো বাঙালি বাংলাদেশের এমন ক্ষতি করতে পারেনি। জিয়ার আমল থেকেই বাংলাদেশের মানুষ বিভক্ত হয়ে গেল স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি ও স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তি হিসেবে। এ রকম দৃষ্টান্ত পৃথিবীর কোথাও নেই। স্বাধীন হলে দেশে রাজনৈতিক অধিকার পায় একটি পক্ষই– স্বাধীনতার পক্ষ।
অনেক টানাপোড়েনের পর শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসেছেন এবং এক যুগ আছেন। তিনি চার নীতি ফিরিয়ে এনেছেন বটে, কিন্তু এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ বাদ দিতে পারেননি, পারবেনও না। এটিই বাস্তবতা। তিনি জিয়া-এরশাদ-খালেদা-নিজামী যে ক্ষতি করেছেন বাংলাদেশের, তা মেরামতের চেষ্টা করছেন। তাঁর অর্জন অনেক, যা আলোচ্য নয়। কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গি দেখার বিষয়। বাংলাদেশ যাতে পাকিস্তান না হয়ে যায়, সে জন্য তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করেছেন। ১৯৭১-এর ঘাতক বা জিয়া-এরশাদ-খালেদার মিত্রদের বিচার শুরু করেন; যা কেউ ভাবেননি করা সম্ভব। জঙ্গিদের দমন করেছেন। সর্বক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের বোধ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছেন। অর্থনৈতিক বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য উপরি কাঠামোর বিশাল পরিবর্তন করেছেন; যা গত অর্ধশতকে কেউ করার চিন্তা করেনি। সংসদকে রাজনীতির কেন্দ্রে এনেছেন। বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশের অবস্থান এখন গুরুত্বপূর্ণ। পাকিস্তায়ন রোধে তাঁর প্রচেষ্টা লক্ষণীয়। মানবিকতার কথা বিবেচনা করলে শুধু রোহিঙ্গাদের আশ্রয় প্রদান নয়, আশ্রয়ণ প্রকল্পের কথা আসবে; যা কোনো বিশ্বনেতা করেননি।
আজ বাংলাদেশের মানুষের আছে এক জোড়া পোশাক, দু’বেলা অন্ন, মাথার ওপর ছাদ। এর চেয়ে বড় বিজয় আর কী হতে পারে? বাংলাদেশ তার ইতিহাসে এত ভালো অবস্থায় কখনও ছিল না। আমি ভাবিনি, আমার জীবদ্দশায় এমন বাংলাদেশ দেখে যাব।
আমরা যখন বিজয় দিবস উদযাপন করব, তখন অবশ্যই ৩০ লাখ শহীদ ও নির্যাতিতকে স্মরণ করব; যারা আমাদের ভবিষ্যতের জন্য তাদের বর্তমান উৎসর্গ করেছিলেন। বিজয় দিবসে এটি তাদের পাওনা। তবে এটি বলাও বাঞ্ছনীয়, বিজয় সেদিন সম্পূর্ণ হবে পুরোপুরি, যেদিন দেশে এক পক্ষ-স্বাধীনতার পক্ষই থাকবে আর আদর্শ রাষ্ট্রের মৌলিক নীতিগুলো যখন আবার প্রতিষ্ঠিত হবে। ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু যা বলেছিলেন, তা যদি মনে রাখি তাহলে বিজয় দিবস কেউ আমাদের থেকে ছিনিয়ে নিতে পারবে না, তাহলো, ‘ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার সময় আমি বলব, আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা। জয় বাংলা।’