নতুন কারিকুলাম এসেছে, শিক্ষাকে ‘স্মার্ট’ করবে বলে

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

তরুণদের জন্য সবচেয়ে জরুরি বিষয় তো শিক্ষা। তার হালটা কী? ব্রিটিশ শাসকরা আমাদের দেশে শিক্ষার একটা ব্যবস্থা চালু করেছিল, আমাদের উপকারের জন্য নয়, আমরা তাদের উপকারে লাগব– এই ভরসাতে। সেই ব্যবস্থাটা সোয়া শ বছর ধরে চালু ছিল। তারপর পাকিস্তান এলো, চেষ্টা চলল শিক্ষাব্যবস্থাকে পাকিস্তানের শাসকদের জন্য কাজে লাগবে, এমন করবার। ‘বিপ্লবী’ আইয়ুব খান অন্য ক্ষেত্রে যেমন, শিক্ষাক্ষেত্রেও তেমনি একটা বিপ্লব ঘটাতে চেয়েছিলেন। পুঁজিবাদী ধরনের। পূর্ববঙ্গের তরুণরা সেটা মেনে নেয়নি। তারা আন্দোলন করেছে। আদতে শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনই ছিল আইয়ুববিরোধী প্রথম জনবিক্ষোভ। সে বিক্ষোভ থেকেই ’৬৯-এর অভ্যুত্থানের সূচনা ঘটে, তারপর একাত্তরের যুদ্ধে দেশ স্বাধীন হয়। স্বাধীনতার পরে স্বভাবতই বারবার চেষ্টা হয়েছে শিক্ষাব্যবস্থায় ‘উন্নয়ন’ ঘটানোর। কিন্তু কোনো উন্নয়নই পুঁজিবাদী ঘরানার বাইরে পা বাড়াতে সাহস করেনি। বরং তিন ধারার শিক্ষার পারস্পরিক দূরত্ব আরও বেড়েছে। শিক্ষা সংস্কারের যতগুলো চেষ্টা হয়েছে, প্রতিটিতেই ক্ষতি হয়েছে মূলধারার। অর্থাৎ বাংলা মাধ্যমের। 

সৃজনশীল নামে কিম্ভূত এক পদ্ধতি চালু করা হয়েছিল, যাতে উপকার কী হয়েছে জানা যায় না, তবে অপকার যে হয়েছে– তা অনস্বীকার্য। হেফাজতে ইসলামের চাপে বাংলা পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তন আনা হয়েছে, যার ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে লেখা হয়েছে; বলা হয়েছে; আওয়াজও উঠেছিল সচেতন মহল থেকে। তবে কাজ হয়নি। এবার নতুন কারিকুলাম এসেছে, শিক্ষাকে ‘স্মার্ট’ করবে বলে। এতে কথিত ‘জ্ঞানভিত্তিক’ শিক্ষাকে সরিয়ে দিয়ে ‘দক্ষতাভিত্তিক’ শিক্ষার ব্যবস্থা করা হবে বলে শোনা যাচ্ছে। আমরা নিজেরা এখনও সবটা দেখিনি, তবে পত্রপত্রিকা যে সংবাদ দিয়েছে, তা থেকে জানা গেল, তাত্ত্বিক বিজ্ঞানকে অর্থাৎ ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি ও বায়োলজিকে একই বইয়ের ভেতর নিয়ে আসা হবে। অর্থাৎ বিজ্ঞান শিক্ষা আগে যেটুকু ছিল, তাও কমিয়ে দেওয়া হবে। ধর্ম শিক্ষা অবশ্যই আগের মতো বহাল থাকবে। 

universel cardiac hospital

শিক্ষা নিয়ে নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছেই। এটাই যে শেষ পদক্ষেপ, তা নিশ্চয়ই নয়। অবশ্যই আমরা আরও এগোব। তবে লক্ষ্য করার বিষয় হিসেবে এটি অবশ্যই থাকা দরকার যে এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা কিন্তু ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাক্রমে নেই। সেখানে একই শিক্ষাক্রম অপরিবর্তিত (অবিকৃতও বলা যায়) অবস্থায় চালু রয়েছে এবং দেশের অবস্থাপন্ন পরিবারের ছেলেমেয়ে ওই শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে দক্ষ ও ‘স্মার্ট’ হয়েছে এবং হচ্ছে। তারা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে কিংবা বিদেশে চলে যাচ্ছে। বিদেশে যেতে যারা ব্যর্থ হচ্ছে তারা মনমরা হয়ে থাকছে। ইংরেজি মাধ্যমে হাত দেওয়া হয় না; দেওয়া যায়ও না। ওই শিক্ষা যদি ঠিকমতো চলে তাহলে আর দুশ্চিন্তা কী? শাসকগোষ্ঠীর ছেলেমেয়ে তো ইংরেজি মাধ্যমেই পড়ে; বাংলা মাধ্যমের ধারেকাছেও ঘেঁষে না। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী বলেছেন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে উঠলে মনে হয়, ইউরোপে আছি। নিচে নামলে দেখা যায় গরিব অবস্থা; ইংরেজি মাধ্যম এবং বাংলা মাধ্যমেও ওই একই দূরত্ব; যদিও তারা চালু রয়েছে একই দেশে এবং একই সময়ে। মাদ্রাসা শিক্ষাতেও কোনো ‘বৈপ্লবিক’ পরিবর্তন আনার দরকার পড়েনি; তবে আলিয়া মাদ্রাসার ডিগ্রিগুলোকে মূলধারার ডিগ্রির সমান মর্যাদাদানের ব্যবস্থা হয়েছে, যাতে মাদ্রাসা শিক্ষার প্রতি ক্রমবর্ধমান আকর্ষণ আরও বৃদ্ধি পায়। বেচারা মূলধারারই যত অপরাধ। 

তবে যে পরিবর্তন এবার আনা হচ্ছে, তা নিয়ে মনে হয় বড় রকমের আপত্তি উঠবে। আপত্তি ইতোমধ্যে উঠেছেও। এ ক্ষেত্রে একটা মুশকিল দাঁড়িয়েছে এই যে, সরকারপক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে ‘ভয়ংকর’ রকমের মিথ্যা প্রচারণা চালানো হচ্ছে। কারা করছে ওই গর্হিত কাজ, সরকারি বক্তব্যে তা অবশ্য পরিষ্কারভাবে আসেনি। তবে আগে যা কখনোই ঘটেনি তা-ই এবার ঘটেছে। যাতে বোঝা যাচ্ছে, আমরা ক্রমশ অধিকতর ‘গণতান্ত্রিক’ হচ্ছি। সেটা হলো এই যে, সমালোচকদের শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। খুবই স্মার্ট সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্টে তিনজন শিক্ষক ও একজন অভিভাবক সমালোচনার অপরাধে ইতোমধ্যে কারাবন্দি হয়েছেন। সরকারের পক্ষ থেকে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্টে। অন্য মামলায় তাও জামিন পাওয়ার আশা থাকে, এই আইনের মামলাতে জামিন নেই।জামিন নিষিদ্ধ। একটি জাতীয় দৈনিকের সংবাদ শিরোনামে ঘটনার খবরটি এসেছে এভাবে: ‘কারিকুলাম সমালোচনা করে বিপাকে অভিভাবকরা: এনসিটিবির মামলা, গ্রেপ্তার, আতঙ্কে ঘরছাড়া’ (ইত্তেফাক, ২ ডিসেম্বর)।

ওই সংবাদে বলা হচ্ছে, নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে আপত্তি উঠেছে। এমনকি জাতীয় সংসদেও একাধিক সদস্য এর অসংগতি নিয়ে কথা বলেছেন। এ নিয়ে শহীদ মিনারে মানববন্ধন এবং প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনও করেছেন উদ্বিগ্ন অভিভাবকরা। অভিভাবকরা বলছেন, “নতুন শিক্ষাক্রমে লিখিত পরীক্ষা না থাকায় শিক্ষার্থীরা বাসায় বই নিয়ে বসছে না। পড়তে বললে তারা বলছে, পড়ার তেমন কিছু নেই। স্কুল থেকে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন রকম ‘গ্রুপ স্টাডিজ’-এর কাজ দেওয়া হচ্ছে, যা সমাধান করতে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা নানা রকম ঝামেলায় পড়ছেন। এসব ঝামেলার মধ্যে আছে: স্কুল ছুটির পর সহপাঠীদের বাসায় গিয়ে গ্রুপ স্টাডিজের কাজ সমাধান করা, এই কাজে অনেক সময় লাগা, কাজের উপকরণ ক্রয়ে অনেক অর্থ ব্যয় হওয়া, গ্রুপ স্টাডিজের অজুহাত দেখিয়ে শিক্ষার্থীদের অনিয়ন্ত্রিতভাবে ডিভাইস ব্যবহার করা ইত্যাদি। 

আরেকটি জাতীয় দৈনিকের (যায়যায়দিন, ৩ ডিসেম্বর) দুটি সংবাদ শিরোনাম এই রকম: ১. নৈতিকতা ধ্বংসকারী শিক্ষা কারিকুলাম বাতিলের দাবি; ২. নতুন শিক্ষাক্রম, প্রজন্ম ধ্বংসের নীলনকশা। প্রথম সংবাদটি একটি মানববন্ধনের; দ্বিতীয়টি জাতীয় প্রেস ক্লাবে অনুষ্ঠিত একটি সেমিনারের। মানববন্ধন আয়োজন করেছিল সচেতন অভিভাবক সমাজ নামের একটি সংগঠন; সেমিনারটি অনুষ্ঠিত হয় শিশু ও শিশুরক্ষা আন্দোলন এবং সম্মিলিত শিক্ষা আন্দোলনের উদ্যোগে। 

নৈতিকতার প্রশ্নে যে অভিভাবকরা আপত্তি তুলেছেন তাদের বক্তব্যটা এ রকম: নতুন শিক্ষাক্রমে ষষ্ঠ শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও বিজ্ঞান শিক্ষার নামে যা শেখানো হচ্ছে, তা স্পষ্টভাবে ‘যৌন শিক্ষা’। সেমিনারটির আলোচ্য বিষয়বস্তু ছিল, ‘পরিকল্পিত শিক্ষাধ্বংসের কালপঞ্জী ১৯৭২-২০২২’। এর মূল বক্তব্যটি ছিল এই রকম: ‘এ পর্যন্ত যে কয়টি শিক্ষাক্রম বাস্তবায়িত হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে খারাপ ও বাস্তবতাবর্জিত শিক্ষাক্রম হলো নতুন শিক্ষাক্রম। এ শিক্ষাক্রমের ফলে দেশে নিম্নমানের প্রচুর ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল সৃষ্টি হবে। এতে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা বাইরে চলে যাবে।’ তাদের মতে, ঘন ঘন শিক্ষাক্রম পরিবর্তনে জাতীয় মেরুদণ্ড দুর্বল হচ্ছে। তাদের দাবি, শিক্ষার্থীদের ডিভাইসমুখী হতে উৎসাহিত না করে বরং তাত্ত্বিক বিষয়ে অধ্যয়নমুখী করা চাই। এ দাবি যে অত্যন্ত যুক্তিসংগত– তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। জ্ঞান মানুষকে দক্ষ করে, কিন্তু জ্ঞান তো ভাসমান তথ্য বৈ নয়, তার অভ্যন্তরে যদি তত্ত্ব না থাকে। আর ডিভাইসমুখী করে স্মার্ট করা? সে তো শিক্ষার্থীকে যান্ত্রিক ও চালিয়াত করারই নামান্তর। চালিয়াত আর দক্ষ এক জিনিস নয়। আর এটাও তো এখন বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত সত্য– স্মার্টফোনের অতিরিক্ত ব্যবহার মানুষের বিষণ্নতা বৃদ্ধি করে চলেছে। 

সূচনাকাল থেকেই শিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থী কী শিখল, কতটা শিখল তা নয়; কেমন ‘ফল’ করল, আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় সেটাকেই করে তোলা হয়েছিল মূল্যবান। নতুন শিক্ষাক্রমেও মূল্যায়ন গুরুত্ব পাবে। তবে সেটা নাকি ঘটবে ভিন্নভাবে। নম্বর থাকবে না, গ্রেডও উঠে যাবে; ত্রিভুজ, বৃত্ত, চতুর্ভুজ দিয়ে নাকি মূল্য জ্ঞাপন করা হবে। বিজ্ঞান শিক্ষা সংকুচিত হলেও জ্যামিতিরই দোকানদারি বেশ দাপটে থাকবে, বোঝা যাচ্ছে। 

ওদিকে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কিন্তু নেমে যাচ্ছে। জানা গেল, এবার তিন কোটি পাঠ্যবই কম ছাপা হবে। কারণ কী? কারণ অন্য কিছু নয়। প্রাক-প্রাথমিক থেকে শুরু করে নবম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ২৮ লাখ কমেছে। (যায়যায়দিন, ২১ সেপ্টেম্বর) পাবলিক পরীক্ষায় সাফল্যের হারও কমতির দিকে। উচ্চ মাধ্যমিকে পাসের হার গতবার ছিল ৮৫.১৫ শতাংশ, এবার তা নেমে এসে ঠেকেছে ৭৮.৬৪-তে। আসলে সব শিক্ষার্থীরই পাস করার কথা। কারণ সফল হবে ধরে নিয়েই বিদ্যায়তন থেকে তারা পরীক্ষার জন্য প্রেরিত হয়েছে। পরীক্ষার ফলের উঠতি-কমতির ঘটনা কিছুটা রহস্যজনকও বটে। যেমন এবার যশোর বোর্ডের তুলনায় বরিশাল বোর্ডের শিক্ষার্থীরা ভালো করেছে। যশোরে পাসের হার শতকরা ৬৯.৮৮; বরিশালে সেটি ৮০.৬৯। এর ব্যাখ্যা কী? বরিশালের ছেলেমেয়ে কি হঠাৎ অধিক মেধাবান ও মনোযোগী হয়ে গেল? নাকি মূল্যায়নে ত্রুটি ছিল? এসব নিয়ে মাথা ঘামানো খুব একটা ঘটে বলে তো মনে হয় না।

লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

শেয়ার করুন