মানুষের ওপর বিএনপির আস্থা নেই

মোনায়েম সরকার

ফাইল ছবি

গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় সরকারি শেখ মুজিবুর রহমান কলেজ মাঠে গত শনিবার (৩০ ডিসেম্বর) নির্বাচনী জনসভায় শেখ হাসিনা বলেছেন, নির্বাচন বানচাল করতে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র হচ্ছে। শেখ হাসিনা বলেন, ‘তৃতীয় পক্ষ কী করতে পারে? দেশের কোনো উন্নতি করতে পারে না। ২০০৭-এ আপনারা দেখেছেন কী করেছে। তার আগে তো জিয়া-এরশাদ-খালেদা জিয়া, এরাই তো ছিল, মানুষের তো কোনো ভাগ্য পরিবর্তন হয়নি! মানুষ তো যে অন্ধকার সেই অন্ধকারেই ছিল।’

কোটালীপাড়ার জনসভায় প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘নির্বাচন বানচালে যারা ষড়যন্ত্র করছে, তাদের একদিন উপযুক্ত শাস্তি পেতে হবে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কেউ যদি নাক গলাতে আসে, আমরা সেটা মেনে নেবো না। বাংলাদেশ মেনে নেয়নি। মুক্তিযুদ্ধের সময়ও পারেনি। আর অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিজয়, সেটাও আমরা ইনশাআল্লাহ অর্জন করে দেখিয়ে দেবো যে আমরা পারি। দারিদ্র্যের হার কমিয়ে বাংলাদেশকে আরও উচ্চ মর্যাদায় নিয়ে যাবো ইনশাআল্লাহ। ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত-সমৃদ্ধ, সোনার বাংলা ও স্মার্ট বাংলাদেশ আমরা করে দেব।’

universel cardiac hospital

নতুন ভোটারদের উদ্দেশে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের যুবসমাজ, তরুণসমাজ প্রথমবার যারা ভোটার হবে, তাদের কাছে আহ্বান করব, ভোট যেন ব্যর্থ না হয়।’ তিনি বলেন, ‘অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয়, বিএনপি-জামায়াত জোট মিলে অগ্নিসন্ত্রাস শুরু করেছে। মানুষ হত্যা শুরু করেছে। রেললাইনে মা-শিশুকে পুড়িয়ে মারে, রাস্তাঘাটে বাসে আগুন দিয়ে পোড়ায়। এই দুর্বৃত্তপরায়ণতা আমাদের বন্ধ করতে হবে। আগুন যারা দেয় বা যারা ক্ষতিগ্রস্ত করে, নির্বাচন বানচাল করার ষড়যন্ত্র করে, ওদের ধরিয়ে দিন, ওদের উপযুক্ত শাস্তি দিন।’

৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে বিএনপিসহ কয়েকটি দল অংশ না নিয়ে গণতন্ত্রকেই হুমকির মধ্যে ফেলেছে। তবে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা যে পরিস্থিতি মোকাবিলায় আত্মবিশ্বাস নিয়েই এগিয়ে চলেছেন, তা তার নির্বাচনী বক্তৃতা থেকেই পরিষ্কার হচ্ছে। শেখ হাসিনার আত্মবিশ্বাসের বিষয়টিও অকারণ নয়। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশে যে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়েছে প্রায় দেড় দশকে, তার কোনো তুলনা হয় না। বাংলাদেশে কোনো সরকারের আমলেই এত উন্নয়নসাধিত হয়নি।

জনগণের প্রতি ভালোবাসা না থাকলে, দেশের জন্য অঙ্গীকার না থাকলে এটা কখনোই সম্ভব নয়। পৃথিবীতে সমস্যামুক্ত কোনো দেশ নেই। বাংলাদেশেও সমস্যা রয়েছে। তবে দেখতে হবে, সরকার সমাধানে উদ্যোগী কি না। বর্তমান সরকার শুধু সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী নয়, নতুন নতুন সম্ভাবনা বাস্তবায়নেও এগিয়ে যাচ্ছে। একাত্তরের স্বপ্ন বাস্তবায়নে সরকার দারিদ্র্যমুক্ত, ক্ষুধামুক্ত বাংলাদেশ গঠনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে শুধু তা-ই নয়, তরুণ প্রজন্মের স্বপ্ন বাস্তবায়নে ডিজিটাল ও স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনেও সে উদ্যোগী। বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে ২০২৬ সালের মধ্যে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উঠে যাবে। করোনা পরিস্থিতিতে না পড়লে এরই মধ্যে সে লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হতো।

সরকারের বিরুদ্ধে দেশের ভেতর ও বাইরে থেকে চক্রান্ত হচ্ছে। সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেও হচ্ছে। অনেক অভিযোগ তোলা হচ্ছে, যা অযাচিত। আগামী নির্বাচন কীভাবে অনুষ্ঠিত হবে, তা নিয়ে দেশের মানুষের চেয়ে বিশেষ কিছু দেশ ও সংস্থার উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা যেন বেশি দেখা যাচ্ছে। এটা অনাকঙ্ক্ষিত। এটা সম্ভব হচ্ছে, কারণ দেশের ভেতর থেকে একটি মহল অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের জন্য তাদের ডেকে আনছে; সুযোগ করে দিচ্ছে। ন্যায্য দাবিদাওয়া থাকলে তারা পারতো জনগণের কাছে যেতে, জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলন গড়ে তুলতে।

আওয়ামী লীগও অতীতে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে, সরকারের অন্যায় কর্মকাণ্ড, নির্বাচনে কারচুপি ইত্যাদির বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। তারা যা করেছে, সেটা জনগণের কাছে গিয়ে এবং জনগণকে সঙ্গে নিয়ে। তাতে জনতার ইচ্ছার প্রকাশও ঘটেছিল। অপরদিকে বিএনপিসহ যেসব দল সরকারের বিরুদ্ধে নির্বাচনসহ বিভিন্ন বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ করে যাচ্ছে, তারা কখনো সেগুলো নিয়ে জনগণের কাছে যায়নি। জনগণও তাদের ডাকে কখনো সাড়া দেয়নি। এবারও দিচ্ছে না। এর একটা বড় কারণ, জনগণ তাদের চেনে। কীভাবে তাদের জন্ম হয়েছে এবং ক্ষমতায় গিয়ে তারা কী করেছিল, সে বিষয়ে জনগণ ভালোই অবহিত।

জনগণকে বিভ্রান্ত করা বা সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত করে তোলার সুযোগ তাদের নেই। সে কারণেও কার্যকর কোনো আন্দোলন তারা গড়ে তুলতে পারেনি দীর্ঘদিনেও। ২০১৪ সালের নির্বাচন বানচাল করতে তারা যা করেছিল, সেটা আসলে কোনো আন্দোলন ছিল না। ছিল অগ্নিসন্ত্রাস। সরকার ও প্রশাসন সেটা দক্ষতার সঙ্গে প্রতিহত করে দেশকে স্বাভাবিক ধারায় রাখতে সক্ষম হয়। এতে কেবল গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা বজায় থেকেছে তা নয়; উন্নয়নের নতুন যুগেও দেশ প্রবেশ করতে পেরেছে।

এর একটি বড় উদাহরণ প্রমত্তা পদ্মার বুকে সেতু। এরই মধ্যে পদ্মা সেতু চালু হওয়ার এক বছরের বেশি সময় অতিক্রান্ত হয়েছে। ইতিমধ্যে পদ্মা সেতু চালু হওয়ার ফলে দক্ষিণবঙ্গসহ দেশের অর্থনীতি ও সমাজে কী প্রভাব পড়েছে, তার ওপর মিডিয়ায় অনেক প্রতিবেদন প্রকাশ পেয়েছে। এটা এখন সবাই বিশ্বাস করে, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় না থাকলে এত বাধা ও বিরূপতার মধ্যে এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব হতো না।

এখানে সে বিষয়ে বিস্তারিত বলতে চাই না। কারণ পদ্মা সেতু প্রকল্পের বিরুদ্ধে কী হয়েছে, তা সবারই কমবেশি জানা। বর্তমান সরকারকে এখন যেমন দেশ ও দেশের বাইরে থেকে হওয়া চক্রান্ত মোকাবিলা করতে হচ্ছে, তেমনি বাধাবিপত্তি ও চক্রান্ত হয়েছিল পদ্মা সেতু ঘিরে। শেখ হাসিনা ও তার টিমের দৃঢ়তার কারণেই সেসব অতিক্রম করা সম্ভব হয়। বিদায়ী বছরে পদ্মা সেতুর ওপর রেললাইন স্থাপনের কাজ শেষ হয়ে ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছে। এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব কী পড়বে না বাংলাদেশসহ এ অঞ্চলে? রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পও সরকারের আরেকটি উচ্চাভিলাষী প্রকল্প, যার বাস্তবায়ন শেষ হবে নতুন বছরেই। এ প্রকল্প চালু হলে বিদ্যুৎ সমস্যা মোকাবিলায় একটি বড় অগ্রগতি সাধিত হবে।

আমরা কি জানি না, বিএনপি-জামায়াত সরকারের আমলে বিদ্যুতের অভাবে মানুষকে কত দুর্ভোগ পোহাতে হয়? অর্থনীতির অগ্রগতিও এজন্য রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। বাংলাদেশ যে এখন বেশি হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে, তাতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরকারের সাহসী উদ্যোগকে অবশ্যই কৃতিত্ব দিতে হবে। তবে একথা ঠিক, পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়নে ত্রুটি থাকতে পারে। সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে সরকার সচেষ্ট নয়, সেটাও কি বলা যাবে?

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে প্রশাসনের সব জায়গা থেকে পর্যাপ্ত সহায়তা পাচ্ছেন, তা বলা যাবে না। তার সহকারীদের সবাই দক্ষতা ও আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করছেন, সেটা বলারও সুযোগ নেই। তবে সামগ্রিক দিক থেকে দেখলে, সরকারের সাফল্যই বেশি। এর ওপর ভর করে জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে একথা বলার অধিকার প্রধানমন্ত্রী অবশ্যই রাখেন যে, আর কে আছে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার?

অনেক অগ্রগতির মধ্যেও বিগত দুটি জাতীয় নির্বাচন প্রত্যাশা অনুযায়ী অনুষ্ঠিত হয়নি বা হতে পারেনি, এটা সরকারের দিক থেকেও অস্বীকার করা হচ্ছে না। আগামী নির্বাচন নতুন প্রেক্ষাপটে সুষ্ঠুভাবে হবে, এ অঙ্গীকার খোদ প্রধানমন্ত্রী করেছেন। এদেশের গণতন্ত্র ও উন্নয়নের ব্যাপারে বিশেষভাবে আগ্রহী দেশগুলোর প্রতিনিধিদের কাছেও এটা দৃঢ়ভাবে ব্যক্ত করা হচ্ছে। গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে আর কী করা যায়, সে ব্যাপারে পরামর্শ প্রদানের কথাও বলা হচ্ছে। সংবিধানের আওতায় কোনো গ্রহণযোগ্য সংস্কারের প্রস্তাব থাকলে তা নিয়ে আলোচনাও কি হতে পারে না? কিন্তু এসবের মধ্যে না গিয়ে যে নির্বাচনকালীন ব্যবস্থা আদালতের মাধ্যমেই বাতিল হয়ে গেছে, তা ফিরিয়ে আনতে চাওয়া কেন?

আমরা কি জানি না, ওই ব্যবস্থাকে বিএনপি কীভাবে নষ্ট করেছিল এবং তা ব্যবহার করে কীভাবে ক্ষমতা ধরে রাখতে চেয়েছিল? সেই সুযোগ যাতে আর কেউ না পায়, সেজন্যই নির্বাচনকালীন ওই ব্যবস্থা বাতিল করা হয়েছে।

এখন যা করার সংবিধানের আওতায়ই করতে হবে। দেশের বাইরে থেকে বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন যারা সুষ্ঠু দেখতে চায়, তারাও কিন্তু বলেনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরিয়ে আনার কথা। তারা জোর দিচ্ছে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে, যাতে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটে।

দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন এদেশে সম্ভব নয়- এটি বহুল উচ্চারিত আপ্তবাক্য এবং একে ভুল প্রমাণের সুযোগ আমাদের সামনে এসেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবারই বলছেন, তিনি দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতি নিশ্চিত করেছেন বলে নির্বাচনকে ভয় পান না। জনগণের রায় নিতে ভয় কীসের? এত কিছুর পরও জনগণ যদি আওয়ামী লীগের বদলে অন্য কোনো দলকে বেছে নেয়, তবে তাকে স্বাগত জানাতে প্রধানমন্ত্রী প্রস্তুত বলে জানিয়েছিলেন। তারপরও বিএনপিসহ তার মিত্ররা আগামী নির্বাচনে অংশ না নিয়ে কেন নির্বাচন বানচালের জন্য নানা ধরনের অপতৎপরতায় লিপ্ত রয়েছে?

নির্বাচন তো আসলে মতপ্রকাশের স্বাধীনতারই অংশ। মানসম্মত নির্বাচনে জনগণ মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রয়োগ ঘটাতে পারে। তাতে সিংহভাগ ভোটারের ইচ্ছায় গঠিত হয় সরকার। নির্বাচন-পরবর্তী জবাবদিহিরও ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন, যাতে সরকার স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠতে না পারে। সংসদে থাকা চাই সত্যিকারের বিরোধী দল ও কার্যকর বিরোধিতা। কিন্তু বিএনপি কেন মানুষের মুখোমুখি হতে চায় না। এ থেকে কী মানুষের প্রতি বিএনপির আস্থার প্রমাণ পাওয়া যায়? দল হিসেবে টিকে থাকতে হলে বিএনপিকে রাজনৈতিক কৌশল ও নীতিগত অবস্থান পাল্টাতে হবে।

লেখক : রাজনীতিক, লেখক ও চেয়ারম্যান, বিএফডিআর।

শেয়ার করুন