২০২৩ সালে বাংলাদেশের কূটনীতি

ড. দেলোয়ার হোসেন

প্রতীকী ছবিটি সংগৃহীত

বাংলাদেশের কূটনীতি ও পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে ২০২৩ সাল নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ বছর ছিল। বিভিন্ন রাষ্ট্র ও বৈশ্বিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বাংলাদেশের শক্তিশালী সম্পর্ক তৈরি হয়েছে বছরটিতে। ’২৩ সালে কূটনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক সাফল্য দেখিয়েছে।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বছরটিতে জাপান সফর করেছেন। ঐ সফরের মাধ্যমে জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের একটি নতুন মাত্রা তৈরি হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ভারত সফর করেছেন, যেখানে জি-২০ সম্মেলনে ভারতের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণ বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত ইতিবাচক ফল বয়ে এনেছে। দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত ব্রিকস সম্মেলনেও অংশগ্রহণ করেন প্রধানমন্ত্রী। বিশ্ব খাদ্য সংস্থার আমন্ত্রণে সফর করেন ইতালি। প্রধানমন্ত্রীর কাতার সফরও ছিল একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ। উপরন্তু, প্রধানমন্ত্রীর সৌদি আরব সফর ছিল দেশের কূটনীতি ও পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে এক আলোকিত অধ্যায়।

দেশের সবচেয়ে বড় কূটনীতিক হিসেবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে সফর করে বাংলাদেশের উন্নয়ন, সমৃদ্ধি ও অর্জনের বিষয়গুলো বিভিন্ন দেশ ও প্রতিষ্ঠানের সামনে তুলে ধরেছেন। একই সঙ্গে বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব তুলে ধরে ঐ মঞ্চগুলোকে বাংলাদেশের কূটনীতিতে আরো কার্যকরভাবে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছেন। এসবের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাতেই হয়।

বাংলাদেশের সরকারপ্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন কূটনৈতিক ফোরামে অংশগ্রহণের মাধ্যমে বক্তব্য রেখেছেন। এর মধ্য দিয়ে দেশের কূটনীতির একটি স্পষ্ট দিকনির্দেশনা আমরা পেয়েছি। পাশাপাশি বাংলাদেশ কতকগুলো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে, যেমন—২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে বাংলাদেশ ইন্দো-প্যাসেফিক আউটলুক ঘোষণা করে, যার মাধ্যমে বাংলাদেশ ইন্দো-প্যাসেফিক অঞ্চলে নিজের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরার প্রয়াস পায়। বাংলাদেশ সেখানে অত্যন্ত জোরালোভাবে ঘোষণা করে, ‘ইন্দো-প্যাসেফিক অঞ্চলটি হবে উন্মুক্ত, শান্তিপূর্ণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক। এখানে সব দেশ, সব পক্ষ একসঙ্গে কাজ করবে এবং এই অঞ্চলকে একটি সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাবে।’ এই অন্তর্ভুক্তিমূলক দৃষ্টিভঙ্গি নিঃসন্দেহে ইন্দো-প্যাসেফিক আউটলুকের একটি বৈশিষ্ট্য। তাছাড়া এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি যে কোনো দেশের কূটনীতির জন্য বেশ তাত্পর্যবহও বটে।

২০২৩ সালে বাংলাদেশ কূটনৈতিকভাবে জাতিসংঘে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছে। প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ থেকে শুরু করে বিভিন্ন ফোরামে বক্তব্য রেখেছেন। বক্তব্যে উন্নয়নশীল বিশ্বের বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরার পাশাপাশি বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের ভূমিকা ও বিভিন্ন অর্জন তুলে ধরার মাধ্যমে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছেন। এতে করে বাংলাদেশের প্রতি বিশ্বের মনোযোগ বেড়েছে স্বভাবতই। এত সবের ভিড়েও ২০২৩ সালে বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা আরো শক্তিশালী করার চেষ্টা করেছে, যা রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের পথ অবারিত করতে দেশকে সাহায্য করবে আগামী দিনে।

মনে রাখতে হবে, মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক। এমন একটি পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ সম্ভাব্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়েছে। এক্ষেত্রে চীনের উদ্যোগে বা চীনের সহায়তায় রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবসনের জন্য ‘পাইলট প্রকল্প’ বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছে। যদিও সেটি ২০২৩ সালে বাস্তবায়িত হয়নি। কিন্তু এ উপলক্ষ্যে তত্পরতার বিষয়টি লক্ষ করার মতো।

২০২৩ সালে বাংলাদেশ বিশ্বরাজনীতিতেও সক্রিয় ভূমিকা রাখার চেষ্টা করেছে। ইউক্রেন যুদ্ধে বাংলাদেশ তার শক্তিশালী অবস্থান তুলে ধরেছে। বস্তুত, বাংলাদেশ একটি নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকে বিষয়টিকে পর্যবেক্ষণ করছে। গাজা যুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে জোরালো অবস্থান গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ কর্তৃক গৃহীত প্রস্তাবগুলোতে বাংলাদেশ সক্রিয় ছিল। তাছাড়া ফিলিস্তিনিদের বিপক্ষে যে নিষ্ঠুরতা এবং যে ধরনের যুদ্ধাপরাধমূলক ঘটনা ঘটেছে ও ঘটছে, তা প্রতিকারের জন্যও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে সোচ্চার ছিল বাংলাদেশ। এমনকি বাংলাদেশসহ পাঁচটি দেশ ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের সম্ভাব্য যে তথ্য-প্রমাণের জন্য কাজ করার কথা ঘোষণা করেছে, সেখানে বাংলাদেশ অগ্রগামী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ভূরাজনীতির গুরুত্বের প্রেক্ষাপটে এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির প্রশ্নে দক্ষিণ এশিয়া, বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চল ও এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে বাংলাদেশ ভূমিকা রাখার ওপর জোর দিয়ে আসছে, যা আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অঙ্গনে অত্যন্ত তাত্পর্যপূর্ণ। ফলে বাংলাদেশে বৃহত্ শক্তিগুলোর আরো বেশি উপস্থিতি ও তত্পরতা লক্ষ করা যাচ্ছে সাম্প্রতিক সময়ে।

২০২৩ সালে আমরা লক্ষ্য করেছি, বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি মেগা প্রজেক্ট সমাপ্ত করেছে। ঢাকা মেট্রো লাইন চালু, বঙ্গবন্ধু টানেল, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ও পদ্মা রেল লিংক প্রকল্প কিংবা ঢাকা কক্সবাজার রেলওয়েসহ গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের কাজ সফলভাবে শেষ করেছে শেখ হাসিনার সরকার। এই বিচারে বলা যায়, অর্থনীতিতে কূটনীতির একটি বড় ধরনের যোগসূত্র তৈরি করতে সক্ষমতা দেখিয়েছে বাংলাদেশ।

ঢাকা এয়ারপোর্টে টার্মিনাল-৩, একই সঙ্গে যমুনা মাল্টিপারপাস ব্রিজ নির্মাণ এবং মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দর ও বিদ্যুত্ প্রকল্প নির্মাণে জাপান বাংলাদেশকে ব্যাপক সহায়তা করছে। ফলে জাপান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত, রাশিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ সব পক্ষের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক আরো বেশি শক্তিশালী হয়েছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন ইস্যু, বিশেষ করে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে কিছুটা দূরত্ব তৈরি হলেও নির্বাচন যত ঘনিয়ে এসেছে, বাংলাদেশের সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের এ বিষয়ে যে অবস্থান, সেখানে আরো বেশি সহযোগিতার আশ্বাস আমরা দেখতে পেয়েছি।

মনে রাখা জরুরি, বাংলাদেশের সঙ্গে বিভিন্ন দেশের শক্তিশালী দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক রয়েছে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের গুরুত্ব বাড়ানোর প্রেক্ষাপটে সেই সম্পর্কের মধ্যে যে জাতীয় স্বার্থ ও পারস্পরিক সহযোগিতা, তা গুরুত্ব পাচ্ছে। ২০২৩ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ফ্রান্সের সঙ্গে দরকষাকষিতে এয়ারবাস কেনার মতো বিষয়গুলো ছিল। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিভিন্ন আলোচনার মধ্যে বোয়িং কোম্পানির বিমান কেনার বিষয়টিও ছিল। কূটনৈতিক দরকষাকষি, পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ে বিভিন্ন বিবৃতি বা বিভিন্ন ধরনের তত্পরতার মধ্যে ভূরাজনীতি, অর্থনীতি বা জাতীয় স্বার্থের বিষয়টি কতটা গুরুত্বপূর্ণ, সেটিও আমরা লক্ষ করি গেল বছর। ফলে বাংলাদেশের কূটনীতিতে ২০২৩ সালে অতীতের সাফল্যের ধারাবাহিকতা আমরা দেখতে পাই। একই সঙ্গে বর্তমান বিশ্বের জটিল পরিস্থিতি মোকাবিলার ক্ষেত্রে কূটনীতিকে আরো বেশি শক্তিশালী করা, আরো বেশি গুরুত্ব দেওয়া এবং এটিকে আরো বেশি অগ্রাধিকারের মধ্যে এনে সামনের দিনগুলো মোকাবিলা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

আমরা জানি, বিশ্ব পরিস্থিতি প্রতিনিয়ত জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। কতকগুলো ঘটনার দিকে আমরা তাকাতে পারি। আমরা কখনোই ভাবতে পারিনি রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে এমন একটি দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ শুরু হবে। হামাসের শক্তিশালী আক্রমণের প্রেক্ষাপটে গাজা যুদ্ধের ব্যাপারেও কেউ ভবিষ্যদ্বাণী করেনি যে এভাবে যুদ্ধ শুরু হবে এবং তা আর থামানোর মতো অবস্থাতেই থাকবে না! এদিকে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যেমন বৈরিতা বা প্রতিদ্বন্দ্বিতা রয়েছে, তেমনি দুই দেশের মধ্যে বিভিন্ন শীর্ষ বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়েছে। এটা অবশ্যই ইতিবাচক, যদিও কিছুটা বিস্ময়েরও জন্ম দেয়। ফলে ’২৩-এর বিশ্বে অনেক বেশি জটিলতার প্রতিফলন লক্ষ করা গেছে এবং বাংলাদেশ সেটিকে মোকাবিলা করেছে সুনিপুণভাবে।

২০২৪ সালে একটি নতুন সরকার বাংলাদেশের দায়িত্ব গ্রহণ করবে। নতুন মেন্ডেট নিয়ে সরকার রাষ্ট্র পরিচালনা করবে। কূটনীতি পরিচালনা করবে। ফলে ’২৩ সালে যে পরিস্থিতি ছিল, সেখান থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে বাংলাদেশ জাতীয় স্বার্থে, সমৃদ্ধি ও উন্নয়নের প্রশ্নে ’২৪ সালে আরো বেশি কূটনীতি ও পররাষ্ট্রনীতিকে কাজে লাগাবে বলে আশা করা যায়। পাশাপাশি বাংলাদেশকে নিয়ে বিশ্বশক্তি বা আঞ্চলিক শক্তিগুলোর মধ্যে যে প্রতিযোগিতা, সেটিও বজায় থাকবে বলে প্রত্যাশা। বিশ্ব কূটনীতিতে বাংলাদেশের সরব উপস্থিতি বজায় থাকবে—এটাও কাম্য।

উন্নয়শীল বিশ্বে বাংলাদেশের যে নেতৃত্ব আমরা দেখতে পাচ্ছি, সেটি বজায় থাকার সম্ভাবনা সুবিশাল। বাংলাদেশকে হয়তো কোনো কোনো দেশের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন মোকাবিলা করতে হতে পারে। বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে যে মতভেদ, তা মোকাবিলা করতে হবে। এক্ষেত্রে আরো বেশি শক্তিশালী কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলার দিকে নজর দিতে হবে বাংলাদেশকে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মূলনীতি ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়’ অনুসরণ করে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান শক্তভাবে বজায় রাখতে পারলে বাংলাদেশের প্রতি কোনো দেশ আঙুল তোলা কিংবা বাংলাদেশকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করার সুযোগ কখনোই পাবে না। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির সবচেয়ে বড় শক্তি হিসেবে এই মূলনীতি আগামী দিনেও কাজ করবে বলে মনে করি।

লেখক : আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক। অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

শেয়ার করুন