শেখ হাসিনার সামনে নতুন দিগন্ত

আবদুল মান্নান

আবদুল মান্নান
আবদুল মান্নান। ফাইল ছবি

নানা জল্পনাকল্পনা, তর্কবিতর্ক, সন্ত্রাস-নাশকতা, দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র, শেখ হাসিনাকে উত্খাতের জন্য বাম-ডানের অভূতপূর্ব ঐক্য—সব কিছু মোকাবেলা করে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল বাংলাদেশের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন। এর আগে এ দেশে আরো ১১টি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, যার মধ্যে একাধিক নির্বাচন ছিল নির্বাচনের নামে তামাশা। যেমন—দেশের প্রথম সেনা শাসক জিয়াউর রহমানের ‘হ্যাঁ, না’ ভোট, ১৯৭৯ সালে তাঁরই আমলে সেনা শাসনের ছত্রচ্ছায়ায় ভোট, ১৯৮৮ সালে সব দলের বর্জনের মধ্য দিয়ে জেনারেল এরশাদের ভোট, ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি কোনো দলের অংশগ্রহণ ছাড়া বিএনপির ভোট। এসব ভোটের তামাশার ফলাফল ছিল ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে প্রতিষ্ঠিত সংসদে যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতের নেতাদের সদস্য হিসেবে উপস্থিতি।

অনেকে মন্ত্রী হিসেবে গাড়িতে পতাকাও উড়িয়েছেন। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর খুনি কর্নেল আব্দুর রশিদ (অব.) বিরোধী দলের নেতা হিসেবে সংসদে আসন নিয়েছিলেন।

১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির একতরফা নির্বাচনে গঠিত সংসদ পরবর্তী নির্বাচনের অনুষ্ঠানের জন্য দেশের শাসনভার ৯০ দিনের জন্য একটি অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে দিয়ে বিদায় নিয়েছিল। পরবর্তীকালে সেই ব্যবস্থাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল বিএনপি-জামায়াত।

এরপর দেশের সর্বোচ্চ আদালতে তা বাতিল হয়ে যায়।
২০১৪ সালে বিএনপি-জামায়াত আবারও বাতিল হওয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অধীনে সংসদ নির্বাচন দাবি করে এবং সেই দাবিতে সারা দেশে এক ভয়াবহ সন্ত্রাস সৃষ্টি করে প্রায় ৫০০ মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করে। সেই সময়ও কিছু দেশের রাষ্ট্রদূত প্রকাশ্যে শেখ হাসিনার ওপর চাপ সৃষ্টি করেছিলেন, কিন্তু শেখ হাসিনা ছিলেন এ ব্যাপারে দৃঢ়। অনেক চাপের মুখে সেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

যথারীতি তা বর্জন করে বিএনপি-জামায়াত জোট। ২০১৮ সালে বিএনপি ও তার মিত্ররা অংশ নিয়েছিল স্রেফ নির্বাচন কমিশনে তাদের নিবন্ধন রক্ষা করার জন্য। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল মনোনয়ন বাণিজ্য, যা তারা খুবই সফলভাবে করতে পেরেছিল।

শেখ হাসিনা দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠন করেন ২০০৯ সালে। ২০০৯ থেকে ২০২৩—এই ১৫ বছর তিনি একটানা দেশ পরিচালনা করেছেন। এই সময় তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ বিশ্বে একটি ক্রমবর্ধমান উন্নত অর্থনীতির দেশ হিসেবে পরিচিত হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বের ৩৪তম অর্থনীতির দেশ। এর বেশির ভাগ কৃতিত্ব সরকারপ্রধান শেখ হাসিনার।

গত ১৫ বছরের দেশ পরিচালনায় দক্ষতার স্বাক্ষর রাখার কারণে শেখ হাসিনা গত এক দশকে একজন প্রধানমন্ত্রী থেকে হয়ে উঠেছেন একজন বিশ্ব স্বীকৃত রাষ্ট্রনায়ক। বাংলাদেশকে নিয়ে গেছেন অন্য উচ্চতায়। ইতিহাসের আলোয় দেখা যায়, আওয়ামী লীগ যখনই ক্ষমতায় গেছে, তখনই তাকে নানা ধরনের বৈরী পরিবেশের মধ্য দিয়ে পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর শাসনকালে তিনি তাঁর চারপাশে কিছু বিশ্বস্ত ও আস্থাভাজন মানুষ পেয়েছিলেন, যাঁদের ওপর তিনি ভরসা করতে পেরেছিলেন। আবার মোশতাকের মতো বিশ্বাসঘাতকও তাঁর পাশেই ছিলেন।

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা এরই মধ্যে শপথ নিয়েছেন। বাদ পড়েছেন একাধিক হেভিওয়েট মন্ত্রী। তাঁদের বদলে মন্ত্রিসভায় এসেছেন অনেক নতুন মুখ। কোনো কোনো বাদ পড়া বা অন্তর্ভুক্তি মানুষকে অবাক করলেও আগামী দিনে তারা সবার কর্মকাণ্ড মূল্যায়ন করবে। জনগণের মূল্যায়নই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। যাঁরা বাদ পড়েছেন, তাঁরা কেনই বা পড়েছেন, তা একমাত্র দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রীই বলতে পারবেন। তবে গত মন্ত্রিসভার কিছু সদস্যের একটি বড় সমস্যা ছিল, তাঁদের অতিকথন ও কথা বলার সময় শব্দচয়নের দুর্বলতা। মন্ত্রিসভার কিছু সদস্যের আরেকটি বড় সমস্যা ছিল সাংবাদিকদের মাইক পেলেই অপ্রয়োজনীয় কথা বলা। বেশি কথা বললে অনেক সময় বেফাঁস কথা বলে ফেলার আশঙ্কা থাকে।

যখনই আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে, তখনই সেই সরকারের কাছে জনগণের প্রত্যাশা বহুগুণ বেড়ে যায়। তাদের ধারণা, যে দলটির নেতৃত্বে একটি দেশ স্বাধীন হতে পারে, সেই দলটি কেন জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবে না? আর জনগণের প্রত্যাশা তো খুবই সামান্য। তারা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য তাদের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকুক, তা চায়। এই চাওয়াটা বিগত সময়ে মারাত্মকভাবে হোঁচট খেয়েছে। বিশ্ব অর্থনীতির চাপের কারণে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে তা ঠিক, কিন্তু দেশের ভেতরে এক ধরনের অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে যখন দেশে উৎপাদিত আলু ৮০ টাকায় আর কাঁচা মরিচ ২০০ টাকায় বিক্রি হয়, তখন মানুষ তো বিরক্ত হবেই। এর কারণ যে হাতে গোনা কয়েকটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের অশুভ আঁতাত বা সিন্ডিকেট, তা না বোঝার কোনো কারণ নেই।

নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য লাগামহীন বৃদ্ধির সঙ্গে আছে আর্থিক খাতে লাগামহীন নৈরাজ্য। এ খাতে দুর্নীতি হয়েছে আকাশচুম্বী। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বেসরকারি খাতে ব্যাংক পরিচালনা চলে গেছে পারিবারিক নিয়ন্ত্রণে। এর ফলে খুব সহজে পুঁজি পাচার হয়েছে কয়েক হাজার কোটি টাকা। দেশে গত কয়েক দশকে ব্যাংকের সংখ্যা বেড়েছে ঝোড়ো গতিতে। বর্তমানে দেশে ৬১টি নিবন্ধিত ব্যাংক আছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির যে আকার, সেই বিচারে এত ব্যাংকের প্রয়োজন আছে কি না, তা তো ভেবে দেখতে হবে। ব্যাংকিং খাতে যে নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়েছে, তা রোধ করতে অনেকটা ব্যর্থ হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে শেয়ারবাজারের অব্যবস্থাপনা। অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে আবু হাসান মাহমুদ আলীকে, যিনি তাঁর শিক্ষাজীবনে অর্থনীতির ছাত্র ছিলেন। এর আগে ছিলেন দেশের সফল পররাষ্ট্রমন্ত্রী। অনেকটা নিভৃতচারী। তাঁকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। অত্যন্ত সজ্জন ব্যক্তি। তাঁর কাছে মানুষের আশা অনেক। একইভাবে আশা বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রীর ওপর। তাঁর পূর্বসূরির মতো তিনি যেন না বলেন ‘সিন্ডিকেটে হাত দিলে সমস্যা হবে’।

দুর্নীতি যে শুধু আর্থিক খাতে হচ্ছে তা নয়। লাগামহীন দুর্নীতি আছে শিক্ষা খাতে, জনপ্রশাসন খাতে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীতে, সরকারি ক্রয় খাতে, জ্বালানি খাতসহ আরো অনেক খাতে। এসব দমন করার প্রাথমিক দায়িত্ব নিজ নিজ মন্ত্রণালয়ের, তারপর দুর্নীতি দমন কমিশনের। দুর্নীতি দমন কমিশনকে আরো শক্তিশালী করা সময়ের দাবি।

সিঙ্গাপুর স্বাধীন হয়েছিল ১৯৬৫ সালে। তখন এটি ছিল একটি জেলেপল্লী। আজ সিঙ্গাপুর বিশ্বের অন্যতম শক্তি। এর পেছনে সেই দেশটির প্রথম প্রেসিডেন্ট লি কোয়ান হুর অবদান এখনো সেই দেশে স্মরণ করা হয়। তিনি যে কয়েকটি বিষয়ের ওপর জোর দিয়েছিলেন, তার মধ্যে অন্যতম ছিল মেধার লালন ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স। সিঙ্গাপুরে ৩৭ হাজার আন্তর্জাতিক কম্পানির সদর দপ্তর আছে। বাংলাদেশে একটিও নেই। এর অন্যতম কারণ আমলাতান্ত্রিক জটিলতা আর লাল ফিতার দৌরাত্ম্য। এসবের ভেতর থেকে বের হয়ে আসাটাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। এর জন্য প্রয়োজন সুশাসন। এটি হলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।

নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ সভাপতি একটি নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেছেন, যার মধ্যে ওপরে বর্ণিত সব কিছুই স্থান পেয়েছে। ইশতেহার বাস্তবায়নে প্রয়োজন স্বচ্ছ চরিত্রের মানুষ আর দেশপ্রেম। লি কোয়ান হু বলতেন, ‘জনপ্রিয়তা ক্ষণস্থায়ী আর চারিত্রিক দৃঢ়তা স্থায়ী।’ তাঁর মন্ত্রিসভার কোনো সদস্য যদি যোগ্যতার প্রমাণ দিতে সক্ষম না হতেন, তাহলে তাঁকে মন্ত্রিসভা থেকে ছাঁটাই করতে তিনি সময়ক্ষেপণ করতেন না। নতুন মন্ত্রিসভার সামনের ১০০ দিন চ্যালেঞ্জের। এই সময়ে তাদের প্রমাণ করতে হবে নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রের দক্ষতা ও সক্ষমতা। গত মেয়াদে যাঁরা মন্ত্রিসভায় ছিলেন, তাঁরা সবাই পাঁচ বছর মেয়াদ শেষ করেছেন, যদিও তাঁদের সবার কর্মকাণ্ড সমালোচনার বাইরে ছিল না। এবারও তাহলে সাধারণ মানুষ হতাশ হবে।

বঙ্গবন্ধু বাঙালির জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম দিয়ে ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। পাঁচ মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করার সুযোগ পেয়ে শেখ হাসিনা এরই মধ্যে বিশ্বরেকর্ড করেছেন। এখন তাঁর কর্মের ফলে তাঁর সামনে ইতিহাসে অমর হয়ে থাকার হাতছানি। চেষ্টা করলে এটি তাঁর পক্ষে অর্জন করা অসম্ভব নয়।

লেখক : বিশ্লেষক ও গবেষক

শেয়ার করুন