শিক্ষিত তরুণদের উপযুক্ত কর্মসংস্থান চাই

ড. ফজলে এলাহী মোহাম্মদ ফয়সাল

প্রতীকী ছবি

বেকারত্বের কারণে ব্যক্তিজীবন, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে বিশাল সমস্যা তৈরি হয়। বাংলাদেশের বিশাল শিক্ষিত জনগোষ্ঠী বেকার রয়েছে অথবা যোগ্যতা অনুযায়ী উপযুক্ত চাকরি পাচ্ছে না। পড়ালেখা শেষ করে চাকরিবঞ্চিত অনেকে হতাশা ও মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে দেশে প্রায় ৮ লাখ স্নাতক অথবা স্নাতকোত্তর শিক্ষিত বেকার রয়েছেন। স্নাতক পাশ বেকারের সংখ্যা প্রায় ১২ শতাংশ, উচ্চমাধ্যমিক উত্তীর্ণ বেকার ৮.৮৯ শতাংশ এবং মাধ্যমিক উত্তীর্ণ বেকার ২.৮২ শতাংশ। ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের তথ্য অনুযায়ী ২০১৪ সালে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক অথবা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনকারী বেকার ছিল ৪৭ শতাংশ। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের তথ্য অনুযায়ী ২০১৭ সালে বেকার ছিল ৬৬ শতাংশ। শিক্ষাজীবন শেষ করে দীর্ঘদিন যাবৎ চাকরি না পেয়ে অনেকে চরম হতাশা নিয়ে গ্রামে অবস্থান করছেন। অনেকে নিজ এলাকা ত্যাগ করে অন্য অঞ্চলে গিয়ে শিক্ষাগত যোগ্যতা গোপন রেখে ছোটখাটো কাজ করছেন।

যদিও সবাই সব কাজ করতে পারেন, তবু দীর্ঘদিন লেখাপড়াজীবন শেষ করে উপযুক্ত কাজ না পাওয়াটা হতাশার। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিলে পাওয়া যায় শত শত অথবা হাজার হাজার আবেদন। কিছুদিন আগে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো একটি বিভাগে পিয়ন হিসেবে একজন কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কথা প্রসঙ্গে জানতে পারলাম, পিয়ন পদে সদ্য যোগদান করা ব্যক্তির অনার্সসহ মাস্টার্স পাশ করেছেন। একই বিভাগের অন্য একজন পিয়ন স্নাতক পর্যায়ে লেখাপড়া করছেন। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন নিরাপত্তাকর্মী (গার্ড) অনার্সসহ মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন। ক্যাফেটেরিয়ায় কর্মরত বেশ কয়েকজন স্নাতক বিভাগের ছাত্র। প্রতিবেশী এক জনের গৃহে কর্মরত একটি মেয়ে উচ্চমাধ্যমিক সম্পন্ন করেছেন। আরো দুঃখজনক হলেও পরিচিত একজনের মুখে জানা গেল, সিলেট শহরে তিনি একজন রিকশাচালক পেয়েছেন, যিনি একটি কলেজ থেকে অনার্সসহ মাস্টার্স সম্পন্ন করা। এসব উদাহরণে আসলে আমাদের বেকার সমস্যা অথবা যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি না পাওয়ার চিত্র ফুটে উঠেছে।

universel cardiac hospital

বেকার সমস্যা নিয়ে চিন্তা করলে বিষয়টিকে দুটি দিক দিয়ে বিশ্লেষণ করা যায়। প্রথমত, হয়তো ডিগ্রি অর্জন করলেও ছাত্রছাত্রীদের কমিউনিক্যাশনাল দক্ষতার অভাব রয়েছে, অথবা ছাত্রছাত্রীদের বিশ্লেষণধর্মী জ্ঞানে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এজন্যই অনেকে শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে টেকনিক্যাল অথবা ভোকেশনাল ট্রেনিংয়ের কথা বলে থাকনে। ইংরেজিতে দক্ষতার অভাব, কারিগরি জ্ঞানের অভাব—এগুলোও অনেক সময় চাকরিপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। অধিক যোগ্যতাসমূহ শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে চাকরিপ্রাপ্তির সম্ভাবনা বেশি হয়ে থাকে। বুয়েট থেকে পাশ করে গ্র্যাজুয়েটদের প্রায় সবাই চাকরি পাচ্ছেন এবং উন্নত দেশের জব মার্কেটে একটি ভালো অবস্থান তৈরি করেছেন। অন্য দিকটি হলো, আমাদের দেশে উচ্চশিক্ষিত শিক্ষার্থীদের চাকরির জন্য তেমনভাবে কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে না। বেসরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠান ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান তৈরি হলে বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। এর জন্য প্রয়োজন বিনিয়োগ। সুতরাং দেশীয় উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ, প্রবাসীদের বিনিয়োগ, বৈদেশিক বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য সম্ভাব্য সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ এবং বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে অনুধাবন করা প্রয়োজন।

অবশ্য দেশে বেকার জনগণের একটি বিশাল অংশ বিদেশে চলে যাচ্ছে এবং দেশের জন্য প্রচুর পরিমাণ রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছে। যা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশাল ভূমিকা রাখছে। মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণি পরিবারের প্রয়োজনে প্রচুর পরিমাণ রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে উচ্চবিত্ত শ্রেণি দেশে অর্থ পাঠানো অথবা বিনিয়োগের বদলে বিদেশে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। প্রচুর পরিমাণ রেমিট্যান্স আসার ফলে প্রবীণ অর্থনীতি শক্তিশালী হচ্ছে এবং জনগণের আয়স্তর বেড়েছে। জনগণের আয়স্তর বাড়ার ফলে শিক্ষিত বেকার জনগণের ব্যবসা-বাণিজ্য করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য করার ক্ষেত্রে মূলধনের অভাব একটি বড় সমস্যা। কৃষিতে প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে তাতে আনাবাদি জমিতে চাষাবাদে যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে বেকার জনগোষ্ঠীর আয়স্তর বাড়ানো সম্ভব। উন্নত প্রযুক্তিতে মত্স্য চাষও আয় বাড়ানোর একটি পন্থা হতে পারে।

সিলেট শহরের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ব্যবসা-বাণিজ্যে জড়িত হতে দেখা গেছে। শিক্ষিত বেকার সমস্যা আমাদের দেশের একটি বিশাল সমস্যা। চাকরিবান্ধব শিক্ষানীতির সমন্বয়, দেশীয় ও বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধি, কৃষিতে প্রযুক্তির ব্যবহার, গ্রামকেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধি, বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি, নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন প্রভৃতির মাধ্যমে বেকার সমস্যা সমাধানের প্রচেষ্টা বাড়ানো, দেশের বেকারত্ব দূরীকরণ এবং উত্পাদন বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য একান্ত প্রয়োজন।

লেখক : অধ্যাপক, ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট

শেয়ার করুন