কিছুটা অনিশ্চয়তার মধ্যে শেষ হলো বাংলাদেশের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন। অনিশ্চয়তার কথা এই কারণে আসছে যে নির্বাচন বানচাল করার জন্য দেশে-বিদেশে নানা রকমের ষড়যন্ত্রের অভাব ছিল না। নির্বাচনের এক দিন আগেও বাতাসে ভাসছিল ‘নির্বাচন হচ্ছে না’ এমন গুজব। এমন গুজবে বিশ্বাস করে কিছু মানুষ ভোট দিতে শহরের কাছের জেলা বা গ্রামে যাননি, তাঁদের সংখ্যাও কম নয়।
নির্বাচনে ৪১.৮ শতাংশ ভোট পড়েছে বলে নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, যদিও এ নিয়েও নানা জন নানা সন্দেহ প্রকাশ করেছে। নির্বাচন কমিশন আগেই বলেছে, দুই ঘণ্টা পর পর তারা ভোট পড়ার শতাংশ অনুযায়ী হিসাব জানাবে। তা-ই তারা করছিল। তাদের এটি নিঃসন্দেহে একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ।
ঘোষিত হিসাব যে তাৎক্ষণিক সংখ্যা নয়, তা যেকোনো মধ্য মেধার মানুষও বুঝবে। ৪১ হাজার কেন্দ্র থেকে তথ্য আসার পর তা গড় করতে এক ঘণ্টার বেশি সময় লেগে যায়। তার ওপর আছে ‘ডাটা ট্রাফিক জ্যাম’, ব্যান্ডউইডথজনিত সমস্যা। এই বিষয়টি না বুঝে ভোট পড়ার পরিসংখ্যানের সমালোচনা করেছে অনেকে।
যাক সে বিষয়টির রেশ না কাটতেই আবার ওই একই গোষ্ঠী হৈচৈ শুরু করল নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের শপথ গ্রহণ নিয়ে। তাদের দাবি, এই মুহূর্তে দেশে একাদশ সংসদ বহাল থাকতে দ্বাদশ সংসদের সদস্যরা কিভাবে শপথ নেন? তারা হয় বুঝতে পারে না যে শপথ গ্রহণ আর কার্যভার গ্রহণ এক জিনিস নয়, অথবা বুঝেও এই বিষয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে। একজন ব্যক্তির পদোন্নতির সিদ্ধান্ত তখনই কার্যকর হয়, যখন তিনি তাঁর নতুন পদে যোগ দেন। এই বিষয়টি পরিষ্কারভাবে সংবিধানে উল্লেখ আছে। আইনমন্ত্রীও তা স্পষ্ট ভাষায় বুঝিয়ে বলেছেন।
১৯ তারিখ জিয়ার জন্মদিনে তাঁর কবরে ফুল দিয়ে বিএনপির একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা নতুন নির্বাচনের দাবি করেছেন। তাঁরা হয়তো নিজেদের ভুল বুঝতে পেরেছেন। তবে নির্বাচন তো আর পাড়ার ক্রিকেট ম্যাচ নয় যে সপ্তাহে সপ্তাহে তা আয়োজন করতে হবে। যাঁরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেননি, তাঁদের হয়তো ২০২৮ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এরই মধ্যে বিশ্বের প্রায় সব দেশ এবং জাতিসংঘসহ সব আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিরা প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর মন্ত্রিসভার একাধিক সদস্যের সঙ্গে দেখা করে তাঁদের অভিনন্দন জানিয়েছেন। এডিবির কান্ট্রি ডিরেক্টর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে এমনও বলেছেন, ‘শেখ হাসিনার এই বিজয় প্রয়োজন ছিল।’ বুধবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের মূখপাত্র ম্যাথু মিলারের নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ের সময় তাঁর কাছে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত সাংবাদিক মুশফিক ফজল আনসারি, যিনি খালেদা জিয়ার সহকারী প্রেসসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন, বংলাদেশের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সম্পর্কে জানতে চেয়ে প্রশ্ন করেন, ‘যেহেতু বাংলাদেশের সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি, তার অর্থ কি এই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শেখ হাসিনার টানা চতুর্থবার ক্ষমতা গ্রহণকে অনুমোদন করবে না?’ মিলার স্পষ্ট ভাষায় বলেন, ‘না, না’, তেমনটা নয়। তিনি নির্বাচন ঘিরে সব ধরনের সহিংসতার সমালোচনা করেন। তিনি সব মহলকে সংবেদনশীল হওয়ার পরামর্শ দেন। এই সাংবাদিক এক বছর ধরে স্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রায় প্রতিটি প্রেস ব্রিফিংয়ে উপস্থিত থেকে এমন সব প্রশ্ন করে বিএনপির স্বার্থ উদ্ধার করার চেষ্টা করেছেন। শেষতক তিনি তাঁর সব প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হয়েছেন বলা যায়। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও সম্ভবত বুঝতে অক্ষম যে বিশ্বে তাদের রাজনৈতিক শক্তি বর্তমানে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে দুর্বল। গাজা উপত্যকায় ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলের চলমান গণহত্যার সহযোগী হয়ে তারা বিশ্বের মানবতাবাদী সমাজের কাছে নিন্দিত হয়েছে।
বাংলাদেশে ভারতীয় সাংবাদিক চন্দন নন্দীর নাম এরই মধ্যে পাঠক মহলে পরিচিত। এই সাংবাদিক গত কয়েক মাস বিএনপি ও যুক্তরাষ্ট্রের নানা হুমকি-ধমকি নিয়ে কত রকমের সংবাদ প্রচার করলেন। ১৭ জানুয়ারি সেই একই চন্দন নন্দী আসাম থেকে প্রকাশিত নর্থ ইস্ট নিউজে এক মন্তব্য প্রতিবেদনে নিজে অনেকটা হতাশ হয়ে লিখেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের অনেক গুরুত্বপূর্ণ লোকজন বাংলাদেশে গত কয়েক মাস বেশ দৌড়ঝাঁপ করেছেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন ডোনাল্ড লু, আজরা জেয়া, আফরিন আখতার আর সর্বশেষ বাংলাদেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস। অস্ত্র হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র, মানবাধিকার, শ্রমিক স্বার্থ—সব কিছু ব্যবহার করেছে। আওয়ামী লীগবিরোধী পক্ষ তাদের ওপর অনেক আস্থা রেখেছিল, কিন্তু শেষতক তারা সবাই হতাশ। তাদের হতাশা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে যখন তারা দেখেছে, মার্কিন দূত নির্বাচনের পরপরই অন্যদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কয়েকজন মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার প্রতিযোগিতায় মেতেছেন।
এটি ঠিক, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করেনি। এটি তাদের দলীয় সিদ্ধান্ত। তারা যে অসাংবিধানিক দাবিতে নির্বাচন বর্জন করেছে, তা কোনো সরকারের পক্ষে মানা সম্ভব নয়। সম্ভব হতো তারা যদি একটি গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে তাদের দাবি মানতে সরকারকে বাধ্য করতে পারত। তেমনটি তারা করতে পারেনি। শেখ হাসিনা পঞ্চমবার ক্ষমতায় এসেছেন, তাতে দলের মানুষ ছাড়াও দেশের সংবেদনশীল মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে। তারা সবাই আওয়ামী লীগ করে না। বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় থাকলে দেশের কী হতে পারে সে অভিজ্ঞতা তাদের আছে। তারা স্বস্তি চায়। আগের চারবারের চেয়ে শেখ হাসিনার এবার ক্ষমতায় আসা অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং ছিল। তাঁর জন্য আগামী পাঁচ বছর শক্ত হাতে দেশ পরিচালনা আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি চ্যালেঞ্জের। সামনে আছে পাহাড়সম দুর্নীতির নানা ধরনের অভিযোগ, ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতে এত ধরনের নৈরাজ্য, সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সক্ষমতার ঘাটতি, ক্রমবর্ধমান দ্রব্যমূল্য ও মুদ্রাস্ফীতির অভিশাপ। আর আছে সব দিকে অবিনাশী আমলাতন্ত্রের সর্বনাশা উল্লাস নৃত্য। বিশ্বের অনেক গণমাধ্যম শেখ হাসিনাকে নানা অভিধায় অভিষিক্ত করেছে। কেউ বলেছে, ‘পূর্ব দিগন্তের উদীয়মান তারকা’, কারো কারো মতে ‘লৌহমানবী’। পরবর্তী সংসদ নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনাকে তাঁকে দেওয়া এই সব অভিধা যে যথার্থ, তা তাঁর কাজের দ্বারা তিনি প্রমাণ করতে পারবেন বলে সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করে। এই বিশ্বাস মানুষ করে তাঁকে তাঁর আগের চার মেয়াদের দেশ পরিচালনার কাজ দ্বারা বিচার করে। তিনি যে অসম্ভব সব মেগাপ্রকল্পের স্বপ্ন দেখিয়েছেন, তা তিনি বাস্তবায়ন করে তাঁর সক্ষমতার পরিচয় দিয়েছেন। এখন মানুষের উল্লেখিত প্রত্যাশাগুলো পূরণ করার পালা। দেশের মানুষ এও বিশ্বাস করে, শেখ হাসিনা যা একবার প্রতিজ্ঞা করেন, তা তিনি বাস্তবায়নে শতভাগ চেষ্টা করেন এবং সফল হন। পিতা বঙ্গবন্ধু একটি স্বাধীন দেশ দেওয়ার অঙ্গীকার করেছিলেন, তা তিনি দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকতে তিনি বিভিন্ন সভা-সমাবেশে যতগুলো বক্তব্য দিয়েছিলেন, তার প্রতিটিতে একটি কমন বিষয় ছিল ‘দুর্নীতি’। দুর্ভাগ্য জাতির, সেই দুর্নীতি উৎপাটন করার আগেই ঘাতকদের হাতে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করেছেন অধ্যাপক নূরুল ইসলাম, অধ্যাপক আনিসুর রহমান, অধ্যাপক রেহমান সোবহান, অধ্যাপক মফিজ চৌধুরী প্রমুখ। তাঁদের অনেকেই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা নিয়ে স্মৃতিমূলক গ্রন্থ লিখেছেন। তাঁদের গ্রন্থে তাঁরা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বঙ্গবন্ধুর মাথাব্যথার কথা অকপটে বলেছেন, যার একটি ছিল আমলাতন্ত্রের অসহযোগিতার কারণে তাঁর অনেক কর্মকাণ্ডে ব্যাঘাত ঘটা বা বাস্তবায়িত না হওয়া।
এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে ১৯৭৫ সালের পর বাংলাদেশে অনেক কিছু বদলে গেছে। দুর্নীতির প্রচার-প্রসার ও ধরনও বদলে গেছে নানাভাবে। বিগত দিনে যখন বিএনপি-জামায়াত সরকারে ছিল, তখন বাংলাদেশ পর পর পাঁচবার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। এখন তা হয় না। স্বীকার করতে হবে বর্তমান সরকারের আমলে দুর্নীতির জন্য বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ মানুষের সাজা হয়েছে। তবে দুর্নীতির নতুন নতুন ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। ব্যাংকিং, শিক্ষা, জ্বালানি, সরকারি ক্রয়, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী, প্রশাসনসহ এমন কোনো খাত নেই, যেখানে দুর্নীতির থাবা পড়েনি। শেখ হাসিনা একবার বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগে সবাইকে কেনা যায় একমাত্র শেখ হাসিনাকে ছাড়া।’ যে মানুষটি এমন একটি কঠিন কথা বলতে পারেন, তাঁর পক্ষে সব কিছুই করা সম্ভব। দুর্নীতি শূন্যের কোঠায় আনতে সিঙ্গাপুর মডেল বলে একটি মডেল আছে। সিঙ্গাপুরে যেসব মন্ত্রী তাঁদের কাজ সুচারুভাবে করতে পারেন না অথবা সরকারের কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির বিরুদ্ধে দুর্নীতির সামান্যতম প্রমাণ মেলে, তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করা হয় না। বাংলাদেশের মন্ত্রিসভার যাঁরা সদস্য আছেন, তাঁদের সর্বোচ্চ মেয়াদ পাঁচ বছর হতে পারে, কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে নানা অযোগ্যতা সত্ত্বেও পাঁচ বছর জনগণের অর্থে তাঁদের লালন করতে হবে। জনগণ আশা করে, এই দফায় শেখ হাসিনা সব কিছুর ঊর্ধ্বে উঠে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করে এ দেশের ইতিহাসে অমরত্ব লাভ করবেন। তাঁর দেওয়া নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়নই যথেষ্ট। তবে তাঁকে এও মনে রাখতে হবে, সামনের দিনগুলো তাঁর জন্য অনেক চ্যালেঞ্জ বয়ে আনবে এবং তিনিই এই মুহূর্তে একমাত্র ব্যক্তি, যিনি সব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারবেন। তাঁর সফলতা কামনা করি।
লেখক : বিশ্লেষক ও গবেষক