নির্বাচন নিয়ে টিআইবির প্রতিবেদন এবং বাস্তবতা

ব্যারিস্টার মিতি সানজানা

সংগৃহীত ছবি

পাহাড়প্রমাণ বাধা, দেশি ও বিদেশি ষড়যন্ত্রকে একেবারে উড়িয়ে দিয়ে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। সংবিধানের ধারাবাহিকতা এবং জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হলো এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। বহুল আলোচিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিশ্চিত করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। বরাবরের মতোই ঘরে-বাইরের দুষ্টচক্র বহু ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল। কিন্তু জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ এবং নানা দল-মতের প্রার্থীদের অংশগ্রহণে উন্মুক্ত পরিবেশে অবাধ ও শান্তিপূর্ণ একটি নির্বাচন প্রত্যক্ষ করল বিশ্ব।

সম্প্রতি বাংলাদেশের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে ‘একপাক্ষিক’ ও ‘পাতানো প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ’ আখ্যা দিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। নির্বাচন ‘অবাধ হয়নি’ এবং সেটি ‘বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক নির্বাচনের জন্য অশনিসংকেত’ বলে সংস্থাটি বলছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ টিআইবির প্রতিবেদনে আসল তথ্যের বদলে মতামত দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে। তথ্য এবং মতামতের মধ্যে পার্থক্য আছে। তারা মতামতকে তথ্য হিসেবে উপস্থাপন করেছে। এই প্রতিবেদনের আলোকে কিছু বাস্তব চিত্র নিচে তুলে ধরা হলো।

বাস্তব চিত্র কী?

মনোনয়ন যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ায় ৩০০ সংসদীয় আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার আশায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছ থেকে মোট ২ হাজার ৭১৬টি মনোনয়নপত্র নির্বাচন কমিশনের কাছে পাঠানো হয়। যাচাই-বাছাই শেষে ৭৩১ জন প্রার্থী বা মোট ২৭ শতাংশ প্রার্থীকে বাতিল করেছে ইসি। আমরা দেখেছি, দ্বৈত নাগরিকত্বের দায়ে আওয়ামী লীগের নেতা শাম্মী আহমেদের (বরিশাল-৪ আসন) প্রার্থিতা বাতিল করেছে ইসি।

নির্বাচনি আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ

রিপোর্টে সুনির্দিষ্ট কোনো ঘটনা বা তথ্য না দিয়ে টিআইবি রায় দিয়েছে, আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীরা সবাই নির্বাচনি আচরণবিধি লঙ্ঘন করেছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, নির্বাচনি প্রচারণা ও আচরণবিধি পর্যবেক্ষণ করে প্রয়োজনে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। আচরণবিধি লঙ্ঘনের জন্য ইসি ৭৬২ বার শোকজ করেছে, যার মধ্যে ৩০০ বার ছিল আওয়ামী লীগের শতাধিক সংসদ সদস্যকে। এছাড়া প্রার্থী বা তাদের সমর্থকদের বিরুদ্ধে ৬৩টি মামলা হয়েছে।

নির্বাচনি আচরণবিধি ভঙ্গ ঠেকাতে পুলিশ-প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা, বিরোধী দলগুলোর পোলিং এজেন্টদের ভোটকেন্দ্রে যেতে বাধা দেওয়া, নির্বাচনি কর্মকর্তাদের পক্ষপাত, সাংবাদিকদের তথ্য সংগ্রহে বাধাদান, জাল ভোটদান ইত্যাদি অভিযোগ তুলেছে টিআইবি। এক্ষেত্রেও সংস্থাটির মাপকাঠি মাত্র ৫০টি নির্বাচনি আসন। সেগুলোর কতগুলো ভোটকেন্দ্রে তারা পর্যবেক্ষণ চালিয়েছে, তার উল্লেখ নেই।

কিন্তু আসল সত্য হলো, নির্বাচনের দিন ইসিকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে দেখা গেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে হুমকি দেওয়ার অভিযোগে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরীকে (চট্টগ্রাম-১৬) অযোগ্য ঘোষণা করে ইসি। এটি দেশের নির্বাচনের ইতিহাসে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। একটি ভোটকেন্দ্র স্থগিত থাকায় ময়মনসিংহ-৩ (গৌরীপুর) আসনের ফলাফলও স্থগিত করেছেন রিটার্নিং কর্মকর্তা।

২৭ শতাংশ থেকে ৪১ শতাংশ ভোটার টার্নআউট বিতর্ক

নির্বাচন কমিশন প্রায় প্রতি দুই ঘণ্টা পরপর হালনাগাদ তথ্য পেয়েছে। এর মানে হলো যে, ২৭ শতাংশ ভোটারের তথ্য, যা বিকাল ৩টায় বলা হয়েছে, তা কমপক্ষে দুই ঘণ্টা পুরোনো ছিল। অতএব, ৪১ শতাংশ ভোট পড়ার বিকাল ৪টায় আপডেট হওয়া তথ্যের সঙ্গে আগের তথ্যের তিন ঘণ্টার ব্যবধান ছিল। নির্বাচনের দিন সকালে অতিরিক্ত ঠান্ডা থাকার কারণে ভোটারদের একটি বড় অংশ তাদের ভোট দেওয়ার জন্য দুপুর পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিলেন, যার আপডেট ঐ দিন দেরিতেই গণনা করা হয়েছিল।

আওয়ামী লীগ ও তার মিত্র কিছু হেভিওয়েট প্রার্থীর পরাজয়

ঢাকা-১৯ আসনে ট্রাক প্রতীকে প্রতিনিধিত্বকারী স্বতন্ত্র প্রার্থী সাইফুল ইসলাম ৮৪ হাজার ৪১২ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ প্রার্থী সাবেক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান ৫৬ হাজার ৩৬১ ভোট পেয়েছেন।

যশোর-৫ আসনে স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী ও দুই বারের সংসদ সদস্য স্বপন ভট্টাচার্য অতীতে স্থানীয় উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ৭২ হাজার ৩৩২ ভোট পেলেও স্বতন্ত্র প্রার্থী ইয়াকুব আলীর কাছে পরাজিত হন, যিনি ৭৭ হাজার ৪৬৮ ভোট পেয়েছিলেন। হবিগঞ্জ-৪ আসনে পরাজিত হয়েছেন অ্যাডভোকেট মাহবুব আলী। তিনি বেসামরিক বিমান চলাচল প্রতিমন্ত্রী এবং দুই বারের এমপি। ৬৯ হাজার ৫৪৩ ভোট পেয়েও তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমনের কাছে ১ লাখ ৬৯ হাজার ৯৯ ভোটের বিশাল ব্যবধানে পরাজিত হন। গাজীপুর-৫ আসনে মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকির পরাজয়ের সাক্ষী। চার বারের সংসদ সদস্য এই হেভিওয়েট প্রার্থী ৬৭ হাজার ৭৮৩ ভোট পেয়েছিলেন। তার প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী আখতারুজ্জামান ৮২ হাজার ৭২০ ভোট পেয়েছিলেন।

কিশোরগঞ্জ-২ আসনে পুলিশের সাবেক ডিআইজি আবদুল কাহার আকন্দ ৬৮ হাজার ৯৩২ ভোট পেয়েও পরাজিত হন। ঐ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী সোহরাব হোসেন ৮৯ হাজার ৫৩৯ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। মাদারীপুর-৩ আসনে অপ্রত্যাশিত পরাজয়ের শিকার হন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রভাবশালী সদস্য আবদুস সোবহান গোলাপ। তিনি ৬১ হাজার ৯৭১ ভোট পান। কিন্তু তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রায় অপরিচিত তাহমিনা বেগম পেয়েছেন ৯৬ হাজার ৬৩৩ ভোট।

সুনামগঞ্জ-২ আসনে পুলিশের বর্তমান মহাপরিদর্শকের ছোট ভাই চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মাহমুদ ৫৮ হাজার ৬৭২ ভোট পেয়েও পরাজিত হয়েছেন। তাঁর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকা স্বতন্ত্র প্রার্থী ৬৭ হাজার ৭৭৫ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন। কুষ্টিয়া-২ আসনে সাবেক তথ্যমন্ত্রী ও তিন বারের সংসদ সদস্য, জাতীয় নেতা ও আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক মিত্র হাসানুল হক ইনু স্থানীয় নেতা কামারুল আরেফিনের কাছে হার মানেন। তিনি ৯২ হাজার ৪৪৫ ভোট পান। কামারুল আরেফিন ১ লাখ ১৫ হাজার ৭৯৯ ভোট পেয়েছিলেন।

টিআইবির গবেষণা পদ্ধতি নিয়ে কিছু প্রশ্ন

টিআইবি ৩০০টির মধ্যে গবেষণার জন্য ৫০টি নির্বাচনি এলাকা বেছে নিয়েছে। কীসের ভিত্তিতে তারা ঐ ৫০টি আসন বেছে নিল, তা অস্পষ্ট। এই ৫০ আসনে তারা কতগুলো ভোটকেন্দ্রের তথ্য নিয়েছে, তার উল্লেখ নেই। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে ৪২ হাজার ৩৫০টি ভোটকেন্দ্র ছিল। তাদের পদ্ধতি কীভাবে কার্যকর ধরা যায়, যখন তারা কতগুলো ভোটকেন্দ্রের তথ্য নিয়েছে, সেই সংখ্যাই প্রকাশ করেনি।

কাজেই আমি মনে করি যে, টিআইবি কর্তৃক প্রকাশিত প্রতিবেদনটি রাজনৈতিকভাবে পক্ষপাতদুষ্ট। এ ধরনের প্রতিবেদন প্রকাশ জনমনে বিভ্রান্তি তৈরি করে এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

লেখক : সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং অধিকারকর্মী

শেয়ার করুন