নামটি অনেক বড়, তবে স্বাধীনতা পরবর্তী ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের কাছে কেবলই রবিউল বা রবিউল ভাই।
১৯৭৫ সালের ৭ জুন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন সমন্বয়ে একক ছাত্র সংগঠন জাতীয় ছাত্রলীগ গঠন করেন। আমরা দু’জনে এ সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হই। ১০ জুন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে জাতীয় ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যরা গণভবনে দেখা করতে গেলে তিনি যা পরামর্শ-নির্দেশনা দিয়েছেন, তা নিয়ে একটি পুস্তিকা প্রকাশের প্রস্তাব করেন শেখ শহীদুল ইসলাম ও মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। বঙ্গবন্ধু আমাদের দু’জনকে দেখিয়ে বলেন– ‘ওরা নোট নিয়েছে দেখলাম। ছেপে ফেল।’ আমরা মাত্র দুই মাস ৭ দিন কাজ করতে পারি। এর মধ্যে ১ জুলাই ‘ছাত্র সমাজের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু’ শিরোনাম দিয়ে এটি প্রকাশ করা হয়।
১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর শুরু অন্য ধারায় কাজ। এ হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে– এ শপথ নিয়ে যারা কাজ শুরু করে, বলতে গৌরববোধ করি– আমরা দু’জন ছিলাম সামনের সারিতে। অবশ্যই দুঃসাহস দেখাতে হয়েছে। খুনিদের হাতে ধরা পড়লে মৃত্যুর শঙ্কা। জেল তো সাধারণ ঘটনা।
১৯৭৫ সালের ৪ নভেম্বর জাতীয় ছাত্রলীগের ব্যানারে শোক দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয় জাতীয় ছাত্রলীগ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বটতলা থেকে শোক মিছিল যাবে বঙ্গবন্ধু ভবনে। বঙ্গবন্ধুর খুনিরা তখন ক্ষমতায়। তাদের হুঙ্কার– ‘মুজিবের চ্যালারা পথে নামলে পাখির মতো গুলি করে মারা হবে।’ আমরা তা উপেক্ষা করি– মধুর ক্যান্টিন থেকে প্রতিবাদী মিছিল বের করি ২০ ও ২১ অক্টোবর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ক্লাসে গিয়ে ৪ নভেম্বরের মিছিলে যোগ দিতে ছাত্রছাত্রীদের অনুরোধ করি। প্রতিটি কর্মসূচিতে আরও অনেকের সঙ্গে ছিলাম আমরা দু’জন।
রবিউল ভাই বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর সশস্ত্র সংগ্রামের পথ অনুসরণ করার কথা ভেবেছেন। আরও অনেকে এভাবে চিন্তা করেন। আমি ভেবেছি ভিন্নভাবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করেই ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে থাকি। ১৯৭৬ সালের ১৫ জানুয়ারি আমাকে আটক করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নিয়ে যাওযা হয়। তবে কৌশলে বের হয়ে আসতে পারি কয়েক ঘণ্টা পর। উপহার হিসেবে পাই জিয়াউর রহমানের আর্মির বেত্রাঘাত।
সশস্ত্র পথে সমাধান নেই, এটা উপলব্ধি করে রবিউল ভাইসহ অন্যরা ফের ছাত্র আন্দোলনে সক্রিয় হন। এক সময়ে তিনি গ্রেফতার হয়ে যান এবং অশেষ যন্ত্রণা সহ্য করেন।
আশির দশকের শুরুতে তিনি যোগ দেন প্রশাসনে। ১৯৮৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে বিরোধীদলের নেতা নির্বাচিত হলে রবিউল ভাই তাঁর সহকারী হিসেবে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করেন।
১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিএনপি বাংলাদেশে প্রহসনের নির্বাচন আয়োজন করে। রবিউল ভাই তখন প্রশাসনে যুক্ত। নির্বাচনের ফল বাতিল এবং নতুন নির্বাচনের দাবিতে শেখ হাসিনা প্রবল আন্দোলন গড়ে তোলেন। হরতাল-অবরোধ-অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচিতে ব্যাপক সাড়া মেলে। মার্চ মাসের প্রথম দিকে তিনি ডাক দেন অসহযোগ আন্দোলনের। তোপখানা রোডে প্রতিষ্ঠা হয় ‘গণতন্ত্র মঞ্চ’। নিকটবর্তী সচিবালয়ে তার ঢেউ আছড়ে পড়ে। ২০ মার্চ খালেদা জিয়ার সরকারের প্রতিমন্ত্রী ডাকসুর সাবেক ভিপি আমানুল্লাহ আমান বিক্ষুদ্ধ কর্মচারীদের হাতে লাঞ্ছিত হন। তাকে সচিবালয়ে অবাঞ্চিত ঘোষণা করা হয়।
২৪ মার্চ প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা সমন্বয় পরিষদ ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন বাতিল করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনার দাবির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে। সমন্বয় পরিষদ নেতারা জনতার মঞ্চে হাজির হয়েছিলেন মিছিল করে। [সংবাদ, ২৫ মার্চ, ১৯৯৬]
২৭ মার্চ সচিবালয়ে সরকারি অফিসার ও কর্মচারীদের যৌথ সমাবেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে অনুরোধ জানানো হয়। ২৮ মার্চ সচিব মহিউদ্দিন খান আলমগীরের নেতৃত্বে সচিবালয়ের বিপুল সংখ্যক অফিসার ও কর্মসূচি তোপখানা রোডে জনতার মঞ্চে হাজির হয়ে চলমান আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন। এ দিন বাংলাদেশের কোনো সরকারি অফিসে কাজ হয়নি। [সংবাদ, ২৯ মার্চ, ১৯৯৬]
রবিউল আলম চৌধুরী এই ব্যতিক্রমী আন্দোলনে ছিলেন সামনের সারিতে, প্রধান সংগঠক হিসেবে। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীনতা সংগ্রাম চলাকালে সরকারি কর্মকর্তাদের এমন সর্বাত্মক অংশগ্রহণ দেখা গিয়েছিল। তবে এটাও মনে রাখতে হবে সে সময় স্বাধীনতার দাবিতে সর্বাত্মক আন্দোলন শুরু হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু ছিলেন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা। তাঁর কাছে রাষ্ট্রক্ষমতা তুলে দেওয়ার অঙ্গীকার ছিল প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের।
শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালের মার্চ মাসে যখন অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন, তিনি সংসদেও সদস্য ছিলেন না। বিরোধীদলের নেতৃত্বেও ছিলেন না। ১৯৯৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর তিনি ১৪৬ জন সদস্যসহ পঞ্চম জাতীয় সংসদ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। এরপরও কেন সরকারি অফিসার ও কর্মচারীরা তাঁর ডাকে সারা দিয়ে রাজপথে নেমে এসেছিলেন? বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এ ঘটনা ছিল অভূতপূর্ব। একটি মহল বলছে– প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের এ পদক্ষেপ অনুচিত ছিল। তারা র্জনৈতিক কর্মসূচিতে যোগ দিয়েছিলেন। অন্যরা বলছেন, জাতীয় প্রয়োজনে সঠিক পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তারা। কী জাদুমন্ত্র কাজ করেছে এর পেছনে? শেখ হাসিনার সহযোগী হিসেবে কারা কাজ করেছেন? প্রায় তিন দশক আগের এ আন্দালনের অনেক অংশগ্রহণকারী এখনও সক্রিয়। তাদের কাছ থেকে প্রকৃত ঘটনা জানা যেতে পারে।
এ বিষয়টি নিয়ে গবেষণা তেমন নজরে আসেনি। এক বা একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এ নিয়ে পিএইচডি ডিগ্রির কাজ হতে পারে। ইউরোপ-আমেরিকা এমনকি ভারতের গবেষকদেরও এ কাজে উৎসাহী করা যেতে পারে।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে আমার প্রশিক্ষণ হয়েছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া সংলগ্ন পালাটানায়। পরে ছিলাম মেলাঘরে। সে সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিয়েছি। রবিউল ভাইও তখন রণাঙ্গনে। আমার সঙ্গে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অনেকে ছিলেন। তাদের স্মরণ করি এ সুযোগে। মুক্তিযুদ্ধে মেলাঘরের অনন্য অবদান ছিল। ঢাকা-কুমিল্লার দুঃসাহসী সব অভিযান এ সেক্টর হেডকোয়ার্টার থেকে পরিচালিত হয়েছে। এ নিয়েও কিন্তু বড় ধরনের গবেষণা হতে পারে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদের সদস্যপদে জয়ী হয়ে মন্ত্রীর দায়িত্বে রবিউল আলম চৌধুরীর সফলতা কামনা করি।
অজয় দাশগুপ্ত: বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিকতায় একুশে পদকপ্রাপ্ত। ১৯৭৫ সালের ৭ জুন বঙ্গবন্ধু গঠিত জাতীয় ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য।