মালয়েশিয়ায় বৈধ অনুমোদন না ৪ হাজারের বেশি অভিবাসীকে আটক করেছে দেশটির অভিবাসন বিভাগ। এর মধ্যে প্রায় এক হাজার বাংলাদেশি রয়েছেন। চলতি জানুয়ারি মাসের প্রথম ২৮ দিনে ৮৭০টি বিশেষ অভিযানে তাঁদের আটক করা হয়।
সম্প্রতি মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে দেশটির অভিবাসন বিভাগের মহাপরিচালক দাতুক রুসলিন জুসোহ এসব তথ্য জানান।
দাতুক রুসলিন জুসোহ বলেন, দেশব্যাপী এই অভিযানে ৯ হাজার ১৬৯ জন অভিবাসীর কাগজপত্র যাচাই করা হয়। বৈধ কাগজপত্র না থাকায় চার হাজার ২৬ জনকে আটক করা হয়। এর মধ্যে প্রায় এক হাজার বাংলাদেশি রয়েছেন। আটক করা ব্যক্তিদের মধ্যে এক হাজার ৪৯৭ জন অবৈধ অভিবাসীকে নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠিয়েছে অভিবাসন বিভাগ।
একই সঙ্গে অবৈধ অভিবাসীকে নিয়োগ দেওয়ায় ৪২ জন নিয়োগকর্তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মালয়েশিয়ার অভিবাসন বিভাগ প্রতিবছর অবৈধ কর্মীর সংখ্যা কমাতে বছরের শুরুতেই রুটিনমাফিক অভিযান পরিচালনা করে থাকে। আটক কর্মীদের মধ্যে বাংলাদেশির সংখ্যা বাড়ার অন্যতম কারণ পর্যটক হিসেবে গিয়ে ফিরে না আসা। এ ছাড়া যেসব কর্মীর পাসপোর্ট-ভিসা কম্পানির কাছে জব্দ রয়েছে, সেসব কর্মী বের হলে তাঁদের আটক করা হয়। তবে বাংলাদেশি কত কর্মী আটক হয়েছেন, এর সঠিক হিসাব নেই।
২০২২ সালের শেষ দিকে পর্যটক হিসেবে মালয়েশিয়ায় ঘুরতে যান কিশোরগঞ্জের হোসেনপুরের ইব্রাহিম হোসেন। মাস তিনেক থাকার পর তিনি একটি নির্মাণ কম্পানিতে কাজ পান। এ ব্যাপারে তিনি কোনো ভিসা পাননি। অবৈধ কর্মী হিসেবেই কাজ করতে থাকেন। ২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর জহুররাল শহরের এক শপিং মলে গেলে তিনি গ্রেপ্তার হন। ১১ দিন পর কম্পানির লোকজন তাঁকে ছাড়িয়ে আনলেও আর কোনো কাজ দেওয়া হয়নি।
একটি গণমাধ্যমকে ইব্রাহিম হোসেন বলেন, আমার ২০২২ সালের ভিসা কম্পানি লাগায়নি। তারপর আমি নববর্ষ পালন করতে শপিং মলে যাই। সেখানে মালয়েশিয়ার অভিবাসন পুলিশ আমাকে গেপ্তার করে। ১১ দিনের মতো জেল হয়। এরপর কম্পানি আমাকে ছাড়িয়ে আনে। এখন এই ১১ দিন ইস্যু করা হচ্ছে। ওই ১১ দিন আমাকে অনুপস্থিত দেখানো হয়েছে। এ কারণে এখন ভিসা দিচ্ছে না। কম্পানির এইচআরের কাছ থেকে আমি কাগজপত্র নিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু পুলিশ ওই কাগজপত্র দেখেনি।
তিনি বলেন, দেশে ছয়-সাত লাখ টাকা ঋণ রয়েছে। যখন কম্পানির খারাপ সময় ছিল, তখন অনেক কাজ করেছি। এখন কম্পানি ভালো অবস্থানে, অথচ ভিসা দেবে না। ভিসা না থাকায় কম্পানির সীমানার বাইরে যেতে পারি না। আমার মতো আরো অনেকের একই অবস্থা।
৯ মাস ধরে কাজ নেই, ভিসা-পাসপোর্টও কম্পানির কবজায়। একটা ঘরের মধ্যে কাটছে ২৭ জনের বন্দিজীবন। তাঁরা বাংলাদেশি প্রবাসীর একটি দল। বৈধ কাগজ ছাড়া বের হয়ে আটক হন তাঁদের একজন। সাত দিন জেল খাটতে হয় তাঁকে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই কর্মী বলেন, ‘আমরা এখন খুব সমস্যার মধ্যে আছি। আমাদের যে কম্পানিতে পাঠানো হয়েছে, সেই কম্পানি কোনো কাজ দেয়নি। বরং নির্যাতন করছে। খাবার দেয় মাত্র এক বেলা। অনেকে এই নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে পালিয়ে গেছেন।’
তাঁর ভাষ্য, মালয়েশিয়ায় অভিবাসন বিভাগ এখন কঠোর অভিযান চালাচ্ছে। বৈধ কাগজ ছাড়া কেউ বের হলেই তাঁকে আটক করা হচ্ছে।
অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটা অনেক দিনের সমস্যা। অবৈধ কর্মীদের বৈধ করা ও বৈধ কর্মীদের কাগজপত্র তাঁদের কাছে রাখার ব্যাপারে যেসব প্রক্রিয়া রয়েছে, সেগুলো সঠিকভাবে করা হয় না। এখানে মালয়েশিয়া সরকারের তেমন দায়দায়িত্ব থাকে না। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়েরও আশাব্যঞ্জক ভূমিকা দেখা যায় না। তবে মালয়েশিয়ার বেকায়দায় পড়া বাংলাদেশি প্রবাসীদের জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে জানান বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) সভাপতি আবুল বাশার।
তিনি বলেন, ‘এই ঘটনাগুলো অবশ্যই শ্রমবাজারে প্রভাব ফেলবে। এসব সমস্যা দূর করার জন্য বায়রার পক্ষ থেকে আমরা নানা ধরনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। ওই দেশের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের কাছে সমস্যার সমাধানে অনুরোধ জানিয়েছি। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে রেখেছি। আশা করি, শিগগিরই সমাধান হবে।’
সরকারের সদিচ্ছার অভাবে একই ঘটনা বারবার ঘটছে বলে মনে করছেন অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনির। তিনি বলেন, ‘সরকারের উচিত, আমাদের শ্রম উইংকে ব্যবহার করে কর্মীদের বৈধতা দেওয়া ও বৈধ কাগজপত্র তাঁদের থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করা। এটা নিশ্চিত না হওয়ার কারণে ঘুরেফিরে একই জিনিস বারবার ঘটছে। কারণ মালয়েশিয়া এসব অভিযানে যাঁদের আটক করা হয়, বেশির ভাগই বাংলাদেশি। প্রতিবারই তাত্ক্ষণিক কিছু সামাধান করা হয়। কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী কোনো সমাধান নেই। অথচ এটার সমাধান কঠিন কাজ নয়। এ ব্যাপারে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।’