বিগত ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে ধারাবাহিকভাবে গণমুখী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতি প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়নে বহুলাংশে সফল হওয়ার সুবাদে বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতি যে একটি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েছে, তা সর্বজনবিদিত। একই সঙ্গে এটিও মানতে হবে যে বিদ্যমান ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং তার জেরে আমাদের অভ্যন্তরীণ কাঠামোগত চ্যালেঞ্জগুলো আরো প্রকট হয়ে সামনে আসায় এই সামষ্টিক অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার পথে বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে। এসব প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলায় স্বল্পমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি—দুই ধরনের পরিকল্পনাই দরকার।
সামনের যে সামষ্টিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলো কার্যকরভাবে মোকাবিলা করা একান্ত জরুরি, তার মধ্যে প্রথমেই রয়েছে মুদ্রা বিনিময় হারে স্থিতিশীলতা নিশ্চিতকরণের পাশাপাশি মূল্যস্ফীতির প্রকোপ থেকে জনগণকে, বিশেষ করে নিম্ন আয়শ্রেণির পরিবারগুলোকে সুরক্ষায় কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া।
আশার কথা, নবগঠিত সরকারের নীতি অগ্রাধিকারের তালিকায় এই বিষয়টি সর্বাগ্রেই স্থান পাচ্ছে (নির্বাচনী ইশতেহারে তেমন প্রতিশ্রুতিই দেখা গেছে)। তবে মনে রাখতে হবে, সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার স্বার্থেই মুদ্রা বিনিময় হারকে যতটা সম্ভব বাজারভিত্তিক করতে হবে (ফলে টাকার আরো অবমূল্যায়ন হতে পারে)। তবে হঠাৎ করেই তা সম্ভব নয়। সে কারণেই ‘ক্রলিং পেগ’-এর কথা বলা হচ্ছে।
ধীরে ধীরে বাজার হারের কাছে পৌঁছানোর জন্য আপাতত এই সাময়িক বা ট্রানজিশনাল ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। আইএমএফ এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে কারিগরি সহায়তা দিতে প্রস্তুতও রয়েছে। পাশাপাশি ভর্তুকি যৌক্তিকীকরণের কারণেও নিত্যপণ্যের দাম বাড়তে পারে কিছুটা। ফলে মূল্যস্ফীতি ৫-৬ শতাংশে নামিয়ে আনা আসলেই কঠিন হবে।
সে কারণেই হয়তো এবারের মুদ্রানীতিতে অর্থবছর শেষে (অর্থাৎ জুন ২০২৪ নাগাদ) ৭.৫ শতাংশ মূল্যস্ফীতির কথা বলা হয়েছে। ২০২৪ সালের শেষে হয়তো এই হার ৫-৬ শতাংশ নামিয়ে আনা সম্ভব হবে। সরবরাহ চেইনের ত্রুটিবিচ্যুতিসহ কাঠামোগত সীমাবদ্ধতাগুলো কাটিয়ে উঠতে পারলে নিত্যপণ্যের খুচরা বিক্রয়মূল্য লাগামহীনভাবে বৃদ্ধি পাওয়া ঠেকানো খুবই সম্ভব। সরকারের নানা বিভাগ সমন্বিতভাবে সরবরাহ চেইন মেরামত করার কাজটি করতে শুরু করেছে।
করোনাজনিত অর্থনৈতিক স্থবিরতা এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক সরবরাহ চেইনে সংকটের পরও রপ্তানিতে বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবে ভালো করে চলেছে।
পর পর দুই বছর ৫০ বিলিয়ন ডলারের বেশি রপ্তানি করার পাশাপাশি মোট বার্ষিক রপ্তানি তিন থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও আমরা দেখছি। কিন্তু অচিরেই যেহেতু বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে শামিল হবে, তাই তখন স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে রপ্তানির ক্ষেত্রে পাওয়া নানা সুবিধা আর না-ও পাওয়া যেতে পারে। অবশ্য চেষ্টা চলছে যাতে এই সুযোগ অন্তত ২০৩২ সাল পর্যন্ত ধরে রাখা যায়। এখনই প্রস্তুতি না নিলে সে সময় আমাদের মোট রপ্তানি ৭ থেকে ১৪ শতাংশ কমে যাওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল হওয়ার মধ্যবর্তী কয়েকটি বছরে রপ্তানির ক্ষেত্রে সুবিধাসহ আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে সহজ শর্তে ঋণ পাওয়া নিশ্চিত করতে অর্থনৈতিক কূটনীতি তো জোরদার করতেই হবে। তবে আগামী দিনে বিশ্ববাজারের প্রতিযোগিতায় টিকতে একই সঙ্গে রপ্তানি বহুমুখীকরণেও আমাদের মনোনিবেশ করতে হবে। পণ্য ও গন্তব্যস্থল—উভয় ক্ষেত্রেই তা করতে হবে। তার মানে, কেবল আরএমজির ওপর নির্ভরশীল না থেকে রপ্তানি পণ্যের তালিকায় নতুন নতুন পণ্য যেমন যোগ করতে হবে, তেমনি নতুন নতুন দেশের রপ্তানির বাজার ধরতেও তৎপর হতে হবে।
রপ্তানিকে আরো বলশালী করতে বিনিয়োগ, বিশেষত সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের প্রবাহ তথা এফডিআই আরো জোরদার করা একান্ত জরুরি। সর্বশেষ ১০ থেকে ১২ বছরে জিডিপির শতাংশ হিসেবে আমাদের রপ্তানি কখনোই ২ শতাংশের বেশি ছিল না। সর্বশেষ হিসাব অনুসারে বাংলাদেশের রপ্তানি জিডিপির মাত্র ০.৩ শতাংশ (ভারতের ১.৫ শতাংশ, ভিয়েতনামের ৪.৪ শতাংশ)। বোঝাই যাচ্ছে এফডিআই বৃদ্ধির ক্ষেত্রে আমাদের আরো অনেক ভালো করার সুযোগ আছে। ভিশন ২০৪১-এও এই অনুপাত ২০৪১-এর মধ্যে ৩ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। কাজেই এ জন্য কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া খুবই দরকার। এফডিআই প্রবাহ যেসব কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে তার মধ্যে আছে—বাণিজ্যের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও লজিস্টিকসের ঘাটতি, বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নানা রকম রেগুলেটরি জটিলতা, দক্ষতা ও প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা, আর্থিক সেবার ক্ষেত্রে গভীরতার অভাব (বিশেষত পুঁজিবাজারের সংকট) এবং সর্বপোরি বিনিয়োগে প্রতিকূলতা সৃষ্টিকারী করনীতি।
এফডিআইয়ের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে করকাঠামোর চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে আলাদা করে আলাপ হওয়া দরকার। কেননা আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে যে করকাঠামো সহজ করা গেলে বিনিয়োগপ্রবাহ দ্রুতই বৃদ্ধি পায়। তা ছাড়া করকাঠামো সহজীকরণের মাধ্যমে বিনিয়োগপ্রবাহ বাড়ানো গেলে তাতে সরকারের রাজস্ব আয়ও বাড়ে। বাংলাদেশের ফরেন ইনভেস্টর চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ফিকি) প্রক্ষেপণ অনুসারে বিনিয়োগে কর ৩০ শতাংশ হ্রাস করতে পারলে দেশে এফডিআইয়ের পরিমাণ ২০২৫ থেকে ২০৪১-এর মধ্যে ৬.৬৪ বিলিয়ন থেকে বেড়ে ৫১.৪০ বিলিয়ন ডলার হতে পারে। আর এর ফলে একই সময়ের ব্যবধানে সরকারের মোট রাজস্ব আয় ৪৫.৮৬ বিলিয়ন থেকে বেড়ে ২২৭.২১ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাতে পারে। এ নিয়ে তাই বিস্তর গবেষণার সুযোগ রয়েছে।
স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল হওয়ার পথের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা এবং দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে আমাদের অবশ্যই এফডিআই প্রবাহ বৃদ্ধিকে যথাযথ নীতি অগ্রাধিকার দিতে হবে। বিনিয়োগপ্রবাহ বৃদ্ধি আমাদের অন্যান্য সামষ্টিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার ক্ষেত্রেও সহায়ক হবে। যেমন—দারিদ্র্যের হার প্রশংসনীয় মাত্রায় কমানোর পরও (বর্তমানে ১৮.৭ শতাংশ) এখনো তিন কোটির বেশি মানুষ দারিদ্র্য রেখার নিচে বাস করছে। কেবল সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি দিয়ে তাদের অর্থনৈতিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা যাবে না। তাদের জন্য কাজের সুযোগ তৈরি করতে হবে (বর্তমানে আনুষ্ঠানিক খাতে বছরে দুই লাখ কাজ সৃষ্টি হচ্ছে, অথচ শ্রমবাজারে নতুন মুখ ঢুকছে বছরে ২০ লাখ)। এফডিআই বাড়লে চাহিদামতো কর্মসংস্থান সৃষ্টি খুবই সম্ভব। একই সঙ্গে আইটি পার্ক ও বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো চালু হলে কর্মসংস্থানের সুযোগ বিপুল হারে বাড়বে।
বাংলাদেশের সামনে রয়েছে অমিত সামষ্টিক অর্থনৈতিক সাফল্যের সম্ভাবনা। ২০৩০ সালের মধ্যেই আমরা হব বিশ্বের নবম বৃহত্তম কনজিউমার অর্থনীতি। তখন তিন কোটি মানুষ থাকবে মিডল অ্যান্ড অ্যাফ্লুয়েন্ট শ্রেণিতে (ম্যাক) (তাদের পরিবারের মাসিক আয় হবে ৪০ হাজার টাকা বা তার বেশি)। ফলে বিনিয়োগের যথাযথ পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারলে এখানে আসতে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহের অভাব হওয়ার কথা নয়। তবে কেবল করকাঠামো আর অবকাঠামোগত সুবিধাই যথেষ্ট হবে না। সবার আগে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। দুর্নীতি দমনে আপসহীনতার জাতীয় প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন ঘটাতে হবে প্রতিটি ক্ষেত্রে। আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতার পাশাপাশি সামাজিক-রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাও নিশ্চিত করতে হবে। সর্বোপরি একটি ভরসার পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। ঠিক যেমনটি রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘সমবায় নীতি’ নিবন্ধে লিখেছেন, ‘দেশে টাকার অভাব আছে বলিলে সবটা বলা হয় না। আসল কথা, আমাদের দেশে ভরসার অভাব।’ এই ভরসার অভাব দূর করাটিই আমাদের প্রধান লক্ষ্য হতে হবে। আর সমাজকে এ জন্য রাষ্ট্রের সমান সক্রিয়তা দেখাতে হবে।
লেখক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর