নির্বাচনী সহিংসতা: ‘সংখ্যালঘু নির্যাতনের দায় এড়াতে পারে না আ.লীগ’

নিজস্ব প্রতিবেদক

সংগৃহীত ছবি

এবার নির্বাচনকেন্দ্রিক সংখ্যালঘু নির্যাতনের যেসব ঘটনা, তার দায় আওয়ামী লীগ কোনোভাবেই এড়াতে পারে না বলে মনে করেন বিশিষ্ট নাগরিকেরা। তারা বলছেন, এবার জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছে মূলত আওয়ামী লীগের নিজেদের প্রার্থীদের মধ্যে। এরপরও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর হামলা-নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনার জন্য বিএনপি-জামায়াত দায়ী বলে পার পাওয়ার সুযোগ নেই।

শুক্রবার বিকেলে জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতা, সংখ্যালঘু মানুষের নিরাপত্তা ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়বদ্ধতা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বিশিষ্টজনদের আলোচনায় এসব বিষয় উঠে এসেছে। বৈঠকে মানবাধিকারকর্মী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, আইনজীবী, গবেষক ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতারা অংশ নেন। এই বৈঠকের আয়োজন করেছে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন বাস্তবায়ন জাতীয় নাগরিক সমন্বয় সেল।

বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল। তিনি বলেন, দেশের সংখ্যালঘুরা ত্রিশঙ্কু অবস্থায় আছে। ভোট দিতে গেলেও বিপদ, ভোট না দিলেও বিপদে পড়তে হয়। নির্বাচন এলেই সংখ্যালঘুদের মধ্যে শঙ্কা কাজ করে, তাদের ভয়ার্ত অবস্থায় থাকতে হয়। এটি প্রকৃতপক্ষে নির্যাতনের চেয়েও ভয়াবহ।

বৈঠকে জানানো হয় গত ৭ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনের আগে-পরে মোট ১০ দিনে (৪-১৩ জানুয়ারি) সংখ্যালঘু নির্যাতন ও হামলার অন্তত ১৩টি ঘটনা ঘটেছে। এর সবই নির্বাচনকেন্দ্রিক। এসব ঘটনায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ১ জন নিহত ও ৩৭ জন আহত হয়েছেন।

অন্যদিকে বেসরকারি সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস) চলতি ফেব্রুয়ারি মাসের ১ তারিখে গণমাধ্যমে পাঠানো এক প্রতিবেদনে বলেছে, দেশের ১২ জেলায় সংখ্যালঘুদের ওপর নির্বাচনকেন্দ্রিক হামলা–নির্যাতন, ঘরবাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর এবং হুমকির ঘটনা ঘটেছে। এসব হামলা–নির্যাতনের ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের বেশিরভাগ ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে এইচআরএসএস।

সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর নির্বাচনকেন্দ্রিক নির্যাতনের ঘটনা সম্পর্কে গোলটেবিল বৈঠকে মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল বলেন, সরকার বলতে পারে, এগুলো ঘটেনি, বানোয়াট, দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। সরকারের লোকজন নিজেদের দায়বদ্ধতা স্বীকারই করেন না। তারা যেভাবে কথা বলেন, তাতে গা শিউরে ওঠে। মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি হিসেবে তারা দায়বদ্ধতার প্রমাণ দিক।

বৈঠকের শুরুতে ধারণাপত্র উপস্থাপন করেন অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম ইন বাংলাদেশের (এএলআরডি) নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা। ধারণাপত্রে বলা হয়, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ ভেবেছিল, এবার নির্বাচনে সাম্প্রদায়িক শক্তির আক্রমণ তেমন প্রকট হবে না। কিন্তু নির্বাচনের পর সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে হামলা চালানো হয়েছে, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি ও মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দাবিদার দল আওয়ামী লীগের একাংশের হাতে অথবা আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীর নামে এসব হামলা হয়েছে। যার শিকার হয়েছেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ।

সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলেও ঘটে, বিএনপি ক্ষমতায় এলেও তা চলবে বলে মন্তব্য করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না। তার মতে, লুটেরাদের সপক্ষে সুশাসন চলছে। সমাজের পরিবর্তন ঘটাতে হলে তরুণদের বলিষ্ঠভাবে এগিয়ে আসতে হবে।

বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ আর বর্তমান আওয়ামী লীগ এক নয় বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এম এম আকাশ। তিনি বলেন, নির্বাচনের আগে বিএনপির জনসভায় যেভাবে আক্রমণ হলো, জামায়াতের সভায় সেভাবে হয়নি। তার মানে ভোটের জন্য কোনো না কোনো আপস করেছে। হেফাজতে ইসলামের জন্যও ব্যাপারটা তা-ই।

নৌকার প্রার্থীর পক্ষে কাজ করায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এক ব্যক্তিকে কুপিয়ে হত্যা করার বিষয়টি উঠে আসে গতকালের গোলটেবিল আলোচনায়। ঝিনাইদহ শহরের ঘোষপাড়া এলাকায় ৯ জানুয়ারি এ ঘটনা ঘটে। নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর (ঝিনাইদহ-২ আসন) অনুসারী ও স্থানীয় বাসিন্দা বরুণ কুমার ঘোষ হত্যাকাণ্ডে স্বতন্ত্র প্রার্থীর (আওয়ামী লীগের নেতা) লোকজন জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে।

এই বিষয়টি তুলে ধরে গোলটেবিল বৈঠকে অধ্যাপক এম এম আকাশ বলেন, এবার আওয়ামী লীগের সমর্থককে হত্যা করা হয়েছে। দলের মনোনীত প্রার্থীর পক্ষে কাজ করায় মারা গেছেন—এর কি বিচার হবে? আমরা দেখতে চাই আওয়ামী লীগ কী করে।

নির্বাচন মানেই এখন ধর্মীয় সংখ্যালঘুর ওপর নির্যাতন বলে মনে করেন বাংলাদেশ পূজা উদ্‌যাপন পরিষদের উপদেষ্টা কাজল দেবনাথ। তিনি বলেন, এই জায়গা থেকে নির্বাচনকে ফেরাতে না পারলে মুখে ফেনা তুলে ফেললেও বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব হবে না। এবার নৌকা, ট্রাক ও ঈগল—তিনটি প্রতীকের প্রার্থী একই দলের ছিলেন। নৌকা জিতলে ট্রাক ও ঈগল, ট্রাক জিতলে নৌকা ও ঈগল মারামারি করেছে।

ভিন্নমত, ভিন্ন চিন্তা ও ভিন্ন ধর্মকে কোণঠাসা করা হচ্ছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস। তিনি বলেন, সমাজের মধ্যে ধর্মান্ধতা প্রবলভাবে ছড়িয়ে গেছে। সহিষ্ণুতা বিষয়টি কমে গেছে। বাংলাদেশজুড়েই দুর্বলের ওপর নানাভাবে নির্যাতন চলছে।

সংখ্যালঘু নির্যাতন প্রসঙ্গে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক ফারুখ ফয়সাল বলেন, অত্যাচারের লক্ষ্য শুধু ধর্মীয় নয়, স্বার্থের, সম্পদের এবং জমি দখলের লক্ষ্যেও নির্যাতন হয়।

সংখ্যালঘু নির্যাতনের পেছনে সরকারের দায় রয়েছে বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মণীন্দ্র কুমার নাথ। তিনি বলেন, সরকার ন্যায়সংগত কাজ করছে না। এত ঘটনা ঘটার পরও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। সরকার ব্যবস্থা নিলে এসব ঘটত না।

আলোচনায় অধ্যাপক মেসবাহ কামাল বলেন, টানা ১৫ বছর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার পরেও সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিষয়ে কেন উদাসীনতা দেখা যাচ্ছে? এবারের নির্বাচন আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগ হয়েছে। সংখ্যালঘুদের ওপর যারা হামলা করেছে, তারা কারা? নৌকা প্রতীকের আওয়ামী লীগ, আওয়ামী লীগের লোক যারা অন্য প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেছে, তারা হামলা করেছে। এবারের হামলার জন্য বিএনপি-জামায়াত দায়ী, এটা বলে পার পাওয়া যাবে না। সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনায় এবার আওয়ামী লীগ তাদের দায় এড়াতে পারে না।

শেয়ার করুন