আজ যিনি প্রবীণ, তিনিই ছিলেন এক সময় ‘অধিকাংশ ক্ষেত্রে’ পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম। আজকের প্রবীণ মানুষই পাহারাদার হিসেবে আমাদের নিরাপত্তা দিয়েছেন। আমাদের নিরাপদ পরিবেশে বড় হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। অথচ দিন দিন বেড়েই চলেছে প্রবীণের প্রতি অবহেলা। এক গবেষণায় দেখা যায়, আমাদের সমাজে ছোট্ট পরিবারে বাবা-মাকে অনেকটা বোঝা মনে করা হয়। একান্নভুক্ত পরিবার ভেঙে একক পরিবার গড়ে ওঠার কারণে পরিবারের বয়স্ক সদস্যদের মর্যাদা এবং সম্মানের জায়গা অনেকাংশেই ক্ষুণ্ন হচ্ছে। অথচ এমনটি হওয়া মোটেও উচিত নয়।
বয়স্ক বাবা-মায়ের ঠিকানা হবে তাঁর নিজের ঘর বা তাঁর সন্তানের ঘর। এ বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য একটি আইন পর্যন্ত করতে হয়েছে। এই আইনে বৃদ্ধ বাবা-মায়ের ভরণপোষণে অবহেলা করলে শাস্তির বিধানও রাখা হয়েছে। একই সঙ্গে সরকারি উদ্যোগে বয়স্ক ও বিধবা ভাতার ব্যবস্থা করা হয়েছে; আজীবন পেনশন স্কিম গ্রহণ করা হয়েছে। এগুলো নিঃসন্দেহে ভালো উদ্যোগ। কিন্তু যে উদ্দেশ্যে এ আইন, তা কি পূরণ হচ্ছে? যদি হতো, তাহলে ঘরে ঘরে প্রবীণের অসহায় চাহনি তীব্র হতো না।
আমাদের ছেলেমেয়ে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে; এটা ঠিক। কিন্তু এই শিক্ষায় আমাদের চিরন্তন সামাজিক-পারিবারিক মূল্যবোধ কমই স্থান পাচ্ছে। পুঁজিবাদের ধাক্কায় পশ্চিমা বিশ্বে পারিবারিক প্রথা অনেক আগেই ভেঙে গেছে। একই আর্থসামাজিক ব্যবস্থা আমাদের এখানেও কাজ করছে। অতএব মূল্যবোধের ভাঙনই সত্য হবে এখানে। তবে শিক্ষা তো সেটাই, যা আমাকে রাষ্ট্র ও সমাজের কাজের যোগ্য করে তোলার পাশাপাশি সবার প্রতি মমত্বও শেখায়।
আমাদের সমাজে এখন ছোট ছোট পরিবার গড়ে উঠেছে। এহেন অনেক পরিবারেরই স্বামী-স্ত্রী দু’জনই চাকরি করেন। এটাই স্বাভাবিক। কারণ একদিকে আগের মতো একক আয়ে সংসার চালানো দিন দিন কঠিন হয়ে পড়ছে, অন্যদিকে পরিবারেরর বাইরের কাজে অর্থাৎ রাষ্ট্র ও সমাজের কাজে অংশগ্রহণের অধিকার নারী-পুরুষ সবারই আছে। তাই বলে তাদের অনেকে যে পরিবারের বয়স্ক সদস্যদের সহজে মেনে নিতে পারে না, সেটা কিন্তু ঠিক নয়।
অবশ্য আরও একটি বিষয় হচ্ছে, এক সন্তান আরেক সন্তানের ওপর বাবা-মায়ের দায়িত্ব দিয়ে রাখতে চায়। বাবা-মা নিয়ে শুরু হয় টানাটানি– কে রাখবে? কার বাসায় থাকবে? ফলে এক সময় বাবা-মায়ের আশ্রয় হয় বৃদ্ধাশ্রমে। বৃদ্ধ বাবা-মায়ের আয়-রোজগার কমে যাওয়ায়ও অনেক সন্তানের কাছে তাদের গুরুত্ব কমে যায়, যা মোটেও উচিত নয়। বাবা-মায়ের সঙ্গে সন্তানের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব, সন্তানের উচ্চশিক্ষা ও বিদেশ গমন এবং দেশে আর ফিরে না আসা, অর্থ ও জায়গা-সম্পত্তি নিয়ে সন্তানের সঙ্গে বিরোধ ইত্যাদি কারণেও শেষ কষ্টটা বাবা-মাকেই করতে হয়। বৃদ্ধ বাবা-মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা দেখানো, যত্ন নেওয়া প্রত্যেক সন্তানের পরম দায়িত্ব। আর এটা পরিবারে থেকেই করতে হবে। এটা বাবা-মায়ের অধিকার বললেও ভুল হবে না।
লেখক : শিক্ষক ও গবেষক