সেই ললিতারা ও মুশতাক-তিশা

হাসান শান্তনু

অসমবয়সী দম্পতি খন্দকার মুশতাক আহমেদ- সিনথিয়া ইসলাম তিশাকে একুশের বইমেলা থেকে তাড়ানোর ঘটনার পক্ষে যারা যুক্তি দিচ্ছেন, তাদের চিন্তাভাবনায় উগ্রতার গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। শেষ বয়সে এসে মেয়ে, বা নাতনির বয়সী কাউকে বিয়ে করে এখানে-ওখানে ‘বালিকা বধূকে’ নিয়ে ঘুরতে যাওয়ার কাজটা এ দেশে মুশতাক প্রথম করেননি। এর আগে কেউ কেউ করেছেন। বইমেলাতে জনপ্রিয় এক লেখক একটা পর্যায় থেকে কমবয়সী স্ত্রীকে নিয়ে প্রায়ই যেতেন। অধ্যাপক, লেখক আসিফ নজরুলের সঙ্গে কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের মেয়ে শীলা আহমেদের বিয়ে অসম বয়সের।

প্রয়াত রাষ্ট্রপতি, ‘নারী-গোলাপের কবি’ এইচ এম এরশাদ সাহিত্যের প্রতি টান বোঝাতে নিজের বয়সী এক কবির মেয়েকে বিয়ে করেন। এরশাদ আগের রাতে বৃদ্ধ আঙুলে আপেল কেটে খাওয়ানোর পরেরদিন সকালে বিএনপি-জামায়াত আমলের হাওয়া ভবনের চাপে ওই বিবিকে তালাক দেন। ওই বিবির বয়স এরশাদের বয়সের অর্ধেকেরও কম। গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের ‘আমার বিষন্ন বেশ্যাদের স্মৃতি’ উপন্যাসের থুড়থুড়ে এক বুড়ো খুঁজছেন অনাঘ্রাতা কুমারীকে।

universel cardiac hospital

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে রানু চিঠি লেখেন যখন, তখন রানুর বয়স বারো। রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন ৫৭। চুলে-দাড়িতে পাক ধরেছে। রবীন্দ্রনাথ লেখেন, ‘দাড়ি-গোঁফওয়ালা আমাকে দেখলে তুমি ভয় পাবে।’ রানু জবাব দেন, ‘আমার কাছে আপনার বয়স ২৭।’ রানু বড় হলে তার বিয়ে হয় আরেকজনের সঙ্গে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘রানু ও ভানু’ উপন্যাসে প্রশ্ন উচ্চারিত, রবীন্দ্রনাথ কি রানুর বিয়েতে বৃদ্ধ বয়সে পেয়েছিলেন ‘চোখের জলে দুখের শোভা?’

এর আগে রবীন্দ্রনাথের বড় প্রেরণা ছিলেন তাঁর বউদি কাদম্বরী দেবী। নারী-পুরুষের সম্পর্কের রসায়ন যুগে যুগেই বিচিত্র। চার্লি চ্যাপলিনের ৫৪ বছর বয়সে তাঁর চতুর্থ স্ত্রী বিশ্বখ্যাত নাট্যকার ইউজিন ও’নীলের কন্যা ওনা ও’নীলের পরিচয় হয়, তখন তাঁর বয়স মাত্র ১৭। ৩৭ বছর বয়সের ব্যবধান নিয়েই বিয়ে করেন দুজন। মার্কেজের ‘কলেরার দিনগুলোতে প্রেমে’ দুই নারী-পুরুষ প্রথম জীবনে প্রেমে পড়ে আলাদা আলাদা বিয়ে করে দাদা-দাদি হয়ে যাওয়ার পর নিজেরা আবার বিয়ে করেন জীবনসায়াহ্নে এসে।

ভ্লাদিমির নাবোকভের ‘ললিতা’র কথা আমরা মনে করতে পারি। যা বিংশ শতাব্দির সাহিত্যের ইতিহাসে ‘সবচেয়ে বিতর্কিত উপন্যাস’। ‘ললিতা’ নিয়ে নির্মিত ষাটের দশকের সিনেমা আজ ‘ক্ল্যাসিক’। মধ্যবয়স্ক এক অধ্যাপক পুরুষের বারো বছর বয়সী বালিকার অসম ভালোবাসার ঘটনা। কিশোরী ললিতার প্রেমে পড়া ওই অধ্যাপক একপর্যায়ে তার বিধবা মাকে বিয়ে করেন। ললিতা এখন তার মেয়ের মতো হলেও তিনি তাকে ভালোবাসেন। সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান ললিতার মা। কাহিনি মোড় নেয় অন্যদিকে।

এবারের একুশের বইমেলায় আসা মুশতাকের বই দুটির (‘তিশা অ্যান্ড মুশতাক’, ‘তিশার ভালোবাসা’) সাহিত্যমান থেকে থাকলে সেগুলো সাহিত্যে ঠাঁই পাবে। মানহীন ছাইপাঁশ হলে সেগুলো ছুড়ে ফেলবেন পাঠকরা। অসমবয়সী প্রেম, বিয়ের কথা লেখায় মুশতাককে স্ত্রীসহ এবারের বইমেলা থেকে বের করে দেয়া অসহনশীলতার উদাহরণ। অসম প্রেমকথা সাহিত্য ও সমাজে অসংখ্য বছর ধরে চলমান। তাদেরকে অপমান করে বইমেলা থেকে বের করে দেওয়ার বিষয়টি সমর্থনযোগ্য নয়।

হাসান শান্তনু: গণমাধ্যম গবেষক, সাংবাদিক।

শেয়ার করুন