আমি ২০১৬ সালে প্রথম ইউরোপ যাই। একাডেমিক দায়িত্ব সম্পাদনের জন্য পর্তুগালের ইভোরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমার যাত্রা শুরু হয়েছিল। এরপর সফর করেছিলাম পশ্চিম ইউরোপের আরও কয়েকটি দেশে। সব দেশেই নিজ ভাষার প্রতি নাগরিকের শ্রদ্ধাবোধ দেখে আমি বিস্মিত হয়েছি। পাশাপাশি মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় লড়াইয়ে জীবন দেওয়া বাঙালির আজ মাতৃভাষার প্রতি অবহেলা দেখে ভবিষ্যৎ নিয়ে হচ্ছি শঙ্কিত। আমি ইউরোপের অভিজ্ঞতার কয়েকটি খণ্ডচিত্র আগে উপস্থাপন করতে চাই।
পর্তুগালের পর্যটননগরী ইভোরার দুর্গ শহরের ভেতর ‘ইভোরা ইন’ নামের গেস্টহাউজে আমার থাকার জায়গার বন্দোবস্ত হয়েছিল। মাঝরাতে আমি গেস্টহাউজে পৌঁছি। সকালে পানির বোতল কেনার জন্য নিচে নামলাম। অদূরেই একটি দোকান খোলা। এখানে কেউ ইংরেজি বলে না। বলতে পারলেও বলে না। আমি ইশারায় দুই লিটারের পানির বোতল চাইলাম। ইংরেজিতে দাম জিজ্ঞেস করলাম। বলতে পারত। কিন্তু মুখে ইংরেজি ব্যবহার না করে ক্যালকুলেটরে বাটন টিপে দেখাল ২ ইউরো। আমি দাম মিটিয়ে ফিরে এলাম। এরপর আমাকে ইশারা-ইঙ্গিতেই চলতে হলো। বাংলাদেশি কয়েকজন ছাত্র দোভাষীর ভূমিকা পালন করে আমাকে উদ্ধার করেছিল।
পিএইচডির জুরিবোর্ড বসেছে। আমি ছাড়া বাকি বোর্ড সদস্যরা পর্তুগিজ। গবেষক পর্তুগিজ নন বলে অধ্যাপকরা ইংরেজিতে প্রশ্ন-উত্তর পর্ব চালালেন। সেই সুবাদে আমি ইংরেজিতে আমার বক্তব্য উপস্থাপন করতে পারলাম। বোর্ড চলাকালীনই সভাপতির ডিকটেশনে সেক্রেটারি রিপোর্ট টাইপ করছিলেন। পুরো রিপোর্টটি তৈরি হলো পর্তুগিজ ভাষায়। সভাপতি প্রফেসর ফাতিমা নান আমাকে ইংরেজিতে তর্জমা করে শোনালেন।
দ্বিতীয় অভিজ্ঞতা হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা ইনস্টিটিউটে আমার একক বক্তৃতার দিন। এটি ছিল গোলটেবিল আয়োজন। শ্রোতাতের বেশির ভাগ পর্র্তুগিজ গবেষক ছেলেমেয়ে। কয়েকজন পর্তুগিজ অধ্যাপক। আমি লক্ষ করছিলাম আমার বক্তৃতা ছেলেমেয়েগুলো মনোযোগে শুনছে বটে, তবে যেন বুঝতে পারছে না। সভাপতিত্ব করছিলেন ইনস্টিটিউটের প্রধান অধ্যাপক ফিলিপ বারাতা। বক্তৃতার কোনো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় এলে অধ্যাপক বারাতা হাতের ইশারায় আমাকে থামাতেন। তারপর বক্তব্যের মূল কথা পর্তুগিজ ভাষায় অনুবাদ করে দিতেন। আমি বুঝলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পড়াশোনা করতেও এদের জন্য ইংরেজি জানা আবশ্যক নয়।
তৃতীয় অভিজ্ঞতা স্পেনে। মাদ্রিদ শহরে যে গেস্টহাউজে উঠেছি, তা পরিচালনা করে এক স্প্যানিশ তরুণী। ইংরেজি বলতে পারে না। ওর সঙ্গে আমার ভাষা লেনদেন হয়েছে মোবাইলে গুগুল ট্রান্সলেটর ব্যবহার করে। এবার চূড়ান্ত অভিজ্ঞতা হলো ও গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা পেলাম প্যারিসে। বিখ্যাত লুভ্যর জাদুঘরের মহামূল্যবান সংগ্রহ দেখে একদিকে আমি মুগ্ধ, অন্যদিকে মহাবিরক্ত। বিরক্ত হওয়ার কারণ প্রদর্শিত প্রত্নবস্তুর গায়ে পরিচিতি সব ফরাসি ভাষায়। ইংরেজির নামগন্ধ নেই। এ বিরক্তি নিয়ে রাতে হোটেলের ফরাসি ম্যানেজারকে চেপে ধরলাম। হোটেল চালানোর প্রয়োজনে তারা ইংরেজি বলেন। বললাম নানা দেশের লাখ লাখ মানুষ তোমাদের জাদুঘরে যায়। তোমরা কি পারতে না ফরাসির পাশাপাশি ইংরেজি ব্যবহার করতে? তাছাড়া ইংরেজি তো আন্তর্জাতিক ভাষা। তোমরা ইংরেজি ব্যবহার এড়িয়ে চলছ কেন? মনে হলো আমার প্রশ্নে তিনি কিছুটা বিরক্ত। তার কাছ থেকে আমি মূল্যবান শিক্ষা পেলাম। বললেন, দেখ তোমরা আমাদের উন্নত দেশের কাতারে রেখেছ। আমরা বিশ্বাস করি আমাদের সার্বিক উন্নয়নের বড় শক্তি আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতি। মাতৃভাষা ও সংস্কৃতিচর্চা থেকে আমাদের যে শক্তি তৈরি হয়, তাতে আমরা সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা পাই। আজ যদি আন্তর্জাতিক ভাষার অজুহাতে আমরা ইংরেজির প্রবেশকে অবারিত করি, তবে দুর্বল হয়ে পড়বে আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতিচর্চা। তাতে আমাদের অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোর শক্তির অবনতি ঘটবে। উন্নত বিশ্বের আজকের অবস্থানে আমরা আর থাকতে পারব না। আমি বললাম, এই যে তোমরা ইংরেজিবিমুখ থাকছ, তাতে জ্ঞানচর্চায় কি সংকট হবে না? ফরাসি মঁশিয়ে বললেন, কিছুমাত্র না। আমাদের হোটেল থেকে খুব বেশি দূরে নয় প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়। তুমি কাল সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে যাও। দেখবে ইংরেজি ভাষায় লেখা পৃথিবীর বিখ্যাত বই সব এক মাসের মধ্যে ফরাসি ভাষায় অনূদিত হয়ে লাইব্রেরিতে চলে এসেছে। সুতরাং মাতৃভাষায় আরও ভালোভাবে জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব হচ্ছে ফরাসি শিক্ষার্থী-গবেষকদের। একই সঙ্গে তিনি জুড়ে দিলেন চীন, জাপানের কথা। বললেন সেসব দেশের মানুষ কি মাতৃভাষা চর্চা করে পিছিয়ে আছে?
এমন ব্যাখ্যায় আমি অভিভূত হলাম। বিপন্নবোধ করলাম ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে বাঙালি জাতিসত্তার গর্বিত পরিচিতি রয়েছে, তারা মাতৃভাষা চর্চায় আজ যেন আর আনন্দ পান না। ইংরেজি ভালো জানাকে শিক্ষিত হওয়ার প্রতীক মনে করেন। কিছুদিন আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিসার নিয়োগের বোর্ডে ছিলাম আমি। যিনি নিয়োগ পেলেন, তিনি মৌখিক পরীক্ষায় যোগ্যতা প্রমাণ করতে পেরেছিলেন। তারপরও প্রার্থীর অনুপস্থিতিতে বোর্ডের একজন জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক মন্তব্য করলেন নিয়োগ দিতে আমরা একমত হলাম বটে; তবে আমি নিশ্চিত ইংরেজিতে দুলাইন লিখতে বললে সে শুদ্ধ করে লিখতে পারবে না। অর্থাৎ যোগ্য হতে হলে ইংরেজিতে শুদ্ধ করে লেখাটা যেন আবশ্যক। আমার মনে হয় এমন উৎকট ইংরেজিপ্রীতির পেছনে একধরনের হীনম্মন্যতা কাজ করে। আমি অনুসন্ধান করে দেখেছি, পৃথিবীর যে যে দেশ ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসনে বন্দি ছিল, উগ্র ইংরেজিপ্রীতি তাদেরই গ্রাস করেছে। এ সত্য মানতেই হবে, নানা ভাষা শিক্ষার মূল্য রয়েছে। সচেতন মানুষ একাধিক ভাষা শিখলেও মাতৃভাষাচর্চাকে পিছিয়ে রাখে না। কিন্তু স্বাজাত্যবোধের দুর্বলতার কারণে রক্তঝরা ভাষা আন্দোলনের প্রেরণা আমরা আজ যেন হারাতে বসেছি। গত সপ্তাহেই আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন শিক্ষকের সন্তানের বিয়ের নিমন্ত্রণপত্র পেয়েছি। দুটিই লেখা ইংরেজি ভাষায়। আরও দুমাস আগে একজন স্বল্পশিক্ষিত আত্মীয়ের মেয়ের বিয়ের কার্ডও পেয়েছি ইংরেজি ভাষায় লেখা। আমরা সবকিছু বাংলা ভাষায় করলেও কেন যেন দাওয়াতপত্র ইংরেজি ভাষায় লিখতে পছন্দ করি।
শ্রদ্ধেয় সরদার ফজলুল করিম স্যারকে একবার চায়ের টেবিলে এ ব্যাপারে মন্তব্য করতে অনুরোধ করেছিলাম। স্যার স্বভাবসুলভ ভদ্রতা বজায় রেখে বলেছিলেন, দেখুন এটি এক ধরনের শ্রেণি চরিত্রের প্রকাশ। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থেকে শুরু করে শিক্ষিত আমলাদের একাংশ মনে করেন, ইংরেজি ভাষায় লেখাটা তাদের আভিজাত্যের প্রকাশ। ধনী ব্যবসায়ী মনে করেন, ইংরেজি না লিখলে তার বিত্তবৈভবের ঠিক প্রকাশ হয় না। আর স্বল্পশিক্ষিত সাধারণ মানুষের একাংশ মনে করেন, ইংরেজিতে দাওয়াতপত্র লিখে তিনি উপরে ওঠার আভিজাত্য খুঁজে পাবেন। যে দেশের ভাষা আন্দোলনের শক্তিতে আজ ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা পেয়েছে, সেদেশের মানুষের এমন হীনম্মন্যতা হতাশ করে বটে। মাঝেমধ্যে ভাবি, আমরা কি ফরাসিদের মতো ভাবতে পারি না মাতৃভাষা ও সংস্কৃতিচর্চা আমাদের এগিয়ে চলাকে আরও গতিশীল করতে পারে?
আমি নিশ্চিত স্পেনবাসী, ফরাসি আর জার্মানদের যদি বলি, ২১ ফেব্রুয়ারির দেশ বাংলাদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষাচর্চার মাধ্যম বাংলা নয়, ইংরেজি-তাহলে তাদের একথা বিশ্বাস করানো কঠিন হবে। মাতৃভাষার শক্তি যে কতটা প্রবল, তা আমাদের জাতীয় নীতিনির্ধারকদের কাছে সম্ভবত খুব স্পষ্ট নয়। যোগ্য মানুষের কি দুর্ভিক্ষ চলছে এদেশে? মনে পড়ে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের বিখ্যাত অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী স্যারের কথা। আমাদের ছাত্রাবস্থায় তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন। তার ইংরেজি ও বাংলা দুই ভাষার বক্তৃতাই মুগ্ধ হয়ে শোনার মতো ছিল। স্যার যখন বাংলা ভাষায় বক্তৃতা করতেন, আমরা খোঁজার চেষ্টা করতাম পুরো বক্তৃতায় একটিও ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করতেন কি না। কখনো পেতাম না। এ ইংরেজির অধ্যাপক বিশ্বাস করতেন, নিজ ভাষাকে মর্যাদা দেওয়া সবচেয়ে মহৎ কাজ। মুক্তচেতনার মানুষ মাতৃভাষাচর্চায় আনন্দ খুঁজে পান। ভাষা আন্দোলনের শক্তি আমাদের কতটা শক্তিমান করেছিল, তা বিশ্ববাসীও জানে।
সাধারণভাবে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের অনুপ্রেরণা খোঁজা হয় ভাষা আন্দোলনের উৎসভূমি থেকে। বলা হয়, ভাষা আন্দোলন বাঙালির মধ্যে যে চৈতন্য জাগিয়েছিল, তা তাকে টেনে নিয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে। পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের আগেই ভাষা নিয়ে চক্রান্ত প্রকাশ্যে উন্মোচিত হয়েছিল। উর্দুভাষী মুসলিম লীগ নেতাদের ভীতি ছিল বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির শক্তির ব্যাপারে। ১৯৪৭ সালের ১৭ মে হায়দরাবাদে এক উর্দু সম্মেলনে সভাপতির ভাষণে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের ওয়ার্কিং কমিটির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য চৌধুরী খালিকুজ্জামান বলেছিলেন, ‘উর্দুই পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা হবে’ (আজাদ, ১৯ মে ১৯৪৭)। বাঙালি লেখক, সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের মধ্যে এ ধরনের বিবৃতির বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। অনেকেই বাংলা ভাষার পক্ষে পত্রপত্রিকায় নিবন্ধ লিখতে থাকেন। পাকিস্তানের জন্মবছরেই ভাষা প্রশ্নে বাঙালি লেখক-চিন্তাবিদদের মধ্যে সচেতনতা লক্ষ করা যায়। আজাদ, ইত্তেহাদ, মিল্লাতসহ নানা পত্রিকায় প্রতিক্রিয়া প্রকাশিত হতে থাকে। মিল্লাত পত্রিকার এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে (২৭ জুন ১৯৪৭) লেখা হয়, ‘মাতৃভাষার পরিবর্তে অন্য কোনো ভাষাকে রাষ্ট্রভাষারূপে বরণ করিবার চাইতে বড় দাসত্ব আর কিছু থাকিতে পারে না।’ অধ্যাপক এনামুল হক লেখেন, ‘উর্দু বাহিয়া আসিবে পূর্ব পকিস্তানবাসীর মরণ-রাজনৈতিক, রাষ্ট্রীয়, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক মৃত্যু’ (মাসিক কৃষ্টি)। ড. কাজী মোতাহার হোসেন লেখেন, ‘যদি গায়ের জোরে উর্দুকে বাঙালি হিন্দু-মুসলমানের ওপর রাষ্ট্রভাষারূপে চালাবার চেষ্টা হয়, তবে তা ব্যর্থ হবে।’ তার মতে, ‘বাংলা ও উর্দু উভয় ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করা উচিত।’ এমন আরও উদাহরণ রয়েছে।
আজ দুর্বল স্বাজাত্যবোধের কারণে নিজেদের কক্ষচ্যুত করে ফেলেছি যেন। বর্তমান প্রজন্মের কাছে একুশের চেতনা এবং বাংলা ভাষাচর্চার শক্তিকে যেন স্পষ্ট করতে পারছি না। দেশকে উন্নত দেশের মর্যাদায় পৌঁছে দেওয়ার স্বপ্ন যারা দেখছেন, মাতৃভাষাচর্চার শক্তি তাদের অনুভব করা জরুরি।
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়