প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশ বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনের চেতনায় এগিয়ে যাচ্ছে। মহান একুশ (২১ ফেব্রুয়ারি) যে আদর্শের শিক্ষা দিয়েছিল, সেই আদর্শে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে বলেই দেশের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আদর্শ নিয়ে না চললে কোনো দেশের উন্নতি করা যায় না। আর এই আদর্শ আমাদের শিখিয়েছে একুশ (২১ ফেব্রুয়ারি)। একুশে ফেব্রুয়ারির ত্যাগের মধ্য দিয়ে এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের আত্মত্যাগের ভিত্তিতে সেই আদর্শ নিয়ে বাংলাদেশ আজ এগিয়ে যাচ্ছে বলেই দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৃহস্পতিবার বিকেলে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে অমর একুশে ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগের আয়োজিত আলোচনা সভায় সভাপতির ভাষণে এসব কথা বলেন। শেখ হাসিনা বলেন, একুশ আমাদের শিখিয়েছে মাথা নত না করা। একুশ আমাদের শিখিয়েছে মাথা উঁচু করে চলা এবং আদর্শ নিয়ে চলা। ভাষা আন্দোলন থেকে যে চেতনার উন্মেষ ঘটেছে, তার মাধ্যমেই আমরা পেয়েছি স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতাকে আমাদের অর্থবহ করতে হবে। এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
তিনি বলেন, ইতিহাস বিকৃতি করে স্বাধীনতার ইতিহাস যারা মুছে ফেলতে চেয়েছিল, ধীরে ধীরে তারাই আস্তাকুড়ে যাবে। আর বাঙ্গালি মাথা উঁচু করে স্বাধীন সত্বা নিয়ে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে চলবে। এটাই হলো বাস্তবতা। তিনি বলেন, ভোগে নয়, ত্যাগেই সব থেকে আনন্দ ও অর্জন, এ কথাটা মনে রাখতে হবে। আর সেটা শিখিয়েছেন আমাদের লাখো শহীদ। সেটা শিখিয়েছেন আমাদের ভাষা আন্দোলনের শহীদেরা। সেটা শিখিয়ে দিয়ে গেছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কাজেই তাঁর আদর্শ নিয়েই বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। বাংলাদেশকে আর কেউ পেছনে টানতে পারবে না।
অনুষ্ঠানের শুরুতেই ভাষা আন্দোলনের শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগ মানুষের জন্য কাজ করে বলেই মানুষের আস্থা ও ভালোবাসা এবং বিশ্বাস অর্জন করেছে। যার ফলে জনগণ বারবার ভোট দিয়ে আমাদের নির্বাচিত করেছে। শেখ হাসিনা বলেন, ’৭৫ এর পর থেকে বাংলাদেশে যে কয়টা নির্বাচন হয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে সুষ্ঠু নিরপেক্ষ গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়েছে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির নির্বাচন। হাজার চেষ্টা করে, অপবাদ ছড়িয়ে, দেশে বিদেশে নানা তদবির করেও জনগণকে ঠেকাতে পারেনি, জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট দিয়েছে। সব থেকে বড় কথা- নারী এবং নবীন ভোটাররা সব থেকে বেশি মাত্রায় এবার ভোট দিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী তাঁকে বারবার হত্যা প্রচেষ্টার উল্লেখ করে বলেন, জনগণ ও তাঁর দলের নেতাকর্মীরাই তাঁকে মানবঢাল রচনা করে বারবার বাঁচিয়ে দিয়েছে। তিনি বলেন, আমি যাতে ক্ষমতায় আসতে না পারি, সেজন্য অনেক রকম চক্রান্ত হয়েছে। তারপরও আসতে আসতে (ক্ষমতায়) এই পঞ্চম দফায় এসে গেছি এবং বাংলাদেশটা এই ১৫ বছরে অন্তত বদলে গেছে। বাংলাদেশের মানুষের আর্থসামাজিক উন্নতি হয়েছে। গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত মানুষের উন্নতি হয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার থেকে আমাদের স্বাধীনতা, গণতান্ত্রিক অধিকার অর্জন সব অর্জনই এসেছে অনেক আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে। তিনি বলেন, বাঙালির যা কিছু প্রাপ্তি, সেটা আওয়ামী লীগই দিয়েছে। ইতিহাসকে বিকৃতি করা এবং বঙ্গবন্ধুর অবদানকে অস্বীকার করা এটা বাংলাদেশের একশ্রেণির মানুষের মজ্জাগত, এমন অভিমত ব্যক্ত করে তিনি বলেন, এখনও দেখবেন যা কিছুই করেন, সেটা তাদের ভালো লাগে না, কোনোটাই নাকি ভালো হয় না। এই ভালো না লাগা গ্রুপই বাংলাদেশের বদনাম ছড়ায় সব জায়গায়।
তিনি বলেন, একটি জাতিকে অর্থনৈতিক মুক্তি দেওয়ার জন্য পরিকল্পনা করে ধাপে ধাপে জাতির পিতা এগিয়েছেন এবং মানুষকে সেই স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছেন। ভাষা আন্দোলন যে শুরু ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ থেকে, সেদিন সচিবালয়ের সামনে থেকে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হলো। এরপর ১৫ তারিখ মুক্তি পেলেন সব ছাত্রনেতা।
তিন বলেন, ১৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমতলায় (বর্তমান ঢাকা মেডিকেলের ইমার্জেন্সি গেট সংলগ্ন) যে সভা হয়, সেখানে সভাপতিত্ব করেন বঙ্গবন্ধু। ভাষা সৈনিক গাজিউল হক তাঁর লেখনিতে এই তথ্যটি দিয়ে যান বলে এটা কেউ অস্বীকার করতে পারেনি। এভাবে ভাষার জন্য লিফলেট, প্যামফ্লেট তৈরি করে সারা বাংলাদেশে সেগুলো প্রচার এবং দেশব্যাপী মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার কাজগুলো জাতির পিতা করেছেন। যেজন্য বারবার তিনি গ্রেফতার হন।
শেখ হাসিনা বলেন, এমনকি ’৫২ এর ভাষা আন্দোলনের তারিখে (২১ ফেব্রুয়ারি) ছিল প্রাদেশিক পরিষদের বাজেট সেশন। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের ধ্বসে পড়া ভবনটিতে (বর্তমান অক্টোবর মেমোরিয়াল) প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন বসতো। যার সামনে মিছিল করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গেরও সিদ্ধান্ত হয়। অনেক মেয়েরাও মিছিলে নেমে আসেন এবং সেই মিছিলে গুলিতে সালাম, রফিক, জব্বারসহ ভাষা শহিদেরা প্রাণ দেন। সে সময় কারাগারে থাকা বঙ্গবন্ধুই এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন, যা তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে তিনি নিজে লিখে গেছেন এবং জাতির পিতার বিরুদ্ধে পাকিস্তানের গোয়েন্দা রিপোর্টের সংকলনের ভিত্তিতে রচিত ‘সিক্রেট ডকুমেন্ট অব ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ অন ফাদার অব দ্য ন্যাশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ সিরিজের বইতেও পাওয়া যায়।
তিনি বলেন, এর আগেই ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ জাতির পিতা এসএম হলে বসে ভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন তমুদ্দুন মজলিসসহ আরো কয়েকটি প্রগতিশীল সংগঠনকে নিয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি পূর্ববাংলা ছাত্রলীগও গঠন করেছিলেন এবং ছাত্রসংগঠন গঠন করে আন্দোলন সংগ্রামের প্রস্তুতি নেন। কেননা তখনই ভাষা নিয়ে চক্রান্ত চলছিল। ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরে করাচিতে একটি শিক্ষা সম্মেলন হয় এবং যেখানে রাষ্ট্রভাষা উর্দু হবার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। তারই প্রতিবাদ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা তখনকার প্রাদেশিক মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতে গিয়ে প্রতিবাদ জানান।