প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘পুলিশ জনগণের বন্ধু- এটি কাল থেকে কালান্তরের পথ-পরিক্রমায় প্রতিষ্ঠিত একটি সত্য। পুলিশ ও জনগণের বন্ধুত্বের মিথস্ক্রিয়ার মূল ভিত্তি হলো পেশাদারিত্ব, সততা, নিষ্ঠা, দক্ষতা, নিরপেক্ষতা, ত্যাগ, বীরত্ব ও দেশপ্রেমের ও মানবীয় মূল্যবোধ। এ সকল মানবীয় গুণ ধারণ করে ‘বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী’ দেশপ্রেম ও পেশাদারিত্বের পরীক্ষায় বার বার উত্তীর্ণ হয়েছে।’
আজ মঙ্গলবার রাজধানীর রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে ‘পুলিশ সপ্তাহ ২০২৪’-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে জাতির পিতাকে হত্যার সেই কালরাতে পুলিশের এএসআই সিদ্দিকুর রহমান ঘাতকদের বাধা দিতে গিয়ে বিনা দ্বিধায় নিজের জীবন উৎসর্গ করেন। দেশবিরোধী সাম্প্রদায়িক শক্তির আগুন-সন্ত্রাস মোকাবিলা ও জঙ্গিবাদ দমনসহ সবধরনের সন্ত্রাসবাদবিরোধী লড়াইয়ে জীবন উৎসর্গ করেছেন অনেক অকুতোভয় পুলিশ সদস্য।’
তিনি বলেন, ‘বিগত ২০১৩, ২০১৪ ও ২০১৫ সালে স্বাধীনতাবিরোধী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী সারাদেশে হরতাল-অবরোধ, জ্বালাও-পোড়াও ও আগুন সন্ত্রাসের মাধ্যমে নিরীহ মানুষ হত্যা ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস করে। পুলিশ সদস্যগণ জীবন বাজি রেখে পেশাদারিত্বের সাথে দায়িত্ব পালন করে তাদের ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড রুখে দিয়েছিল। বরাবরের মতোই সেই অপশক্তি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে বানচাল এবং গণতন্ত্রকে নস্যাৎ করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। তারা ট্রেন-বাসে আগুন দিয়ে নির্মমভাবে নিরীহ মানুষ হত্যা, যানবাহনে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর এবং প্রধান বিচারপতিসহ অন্যান্য বিচারপতিদের বাসভবনে হামলা চালিয়েছে। পেশাদারিত্বের সাথে পুলিশ সদস্যগণ এ সকল পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছেন, এজন্য আমি আপনাদের সকলকে ধন্যবাদ জানাই।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে আমরা পুলিশের বাজেট বৃদ্ধি, ঝুঁকিভাতা চালু, রেশন প্রাপ্তির হার দ্বিগুণ এবং প্রয়োজনীয় যানবাহনের ব্যবস্থা করি। ১৯৯৮ সালে আমরাই প্রথম পুলিশ সুপার পদে একজন নারী কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেই। পাঁচ কোটি টাকা সিড মানি দিয়ে পুলিশ কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন করি। ২০০০ সালে পুলিশ স্টাফ কলেজ প্রতিষ্ঠা করি। আমরা ৮০৩ জন এসআই, ৫০৭ জন সার্জেন্ট এবং ১৪ হাজার ৬৮০ জন কনস্টেবল নিয়োগ দেই। কমিউনিটি পুলিশিংয়ের উদ্যোগ নেই। ২৫টি থানা, ৮৬টি তদন্ত কেন্দ্র, ৫৮টি হাইওয়ে ফাঁড়ি, ১৫০টি পুলিশ ক্যাম্প এবং ১০টি ফাঁড়ি স্থাপন করি।’
তিনি বলেন, ‘২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর আমরা দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে পদক্ষেপ নেই। আমরা জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করি। পুলিশ, র্যাবসহ সকল আইনশৃঙ্খলা ও গোয়েন্দা বাহিনীর সক্ষমতা বৃদ্ধি করি। গত ১৫ বছরে আমরা পুলিশের উন্নয়নে বহুমুখী কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন করি।’
দশ তলা ভবন করে রাজারবাগে পুলিশ হাসপাতালকে আধুনিকায়ন করা হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিভাগীয় পর্যায়ে পুলিশ হাসপাতালের উন্নয়নে আমরা উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। ঢাকা বিভাগে একটি বিভাগীয় হাসপাতাল নির্মাণের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। অন্যান্য বিভাগীয় শহরেও পুলিশ হাসপাতাল নির্মাণের পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা পুলিশে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক যানবাহন সরবরাহ করেছি। পুলিশে একটি পূর্ণাঙ্গ এভিয়েশন ইউনিট গঠনের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। পুলিশ বাহিনীর কার্যক্রমে শীঘ্রই দুটি হেলিকপ্টার যুক্ত হতে চলছে। বিভিন্ন অনলাইনভিত্তিক সেবা ও মোবাইল অ্যাপস্ প্রবর্তন, অনলাইন জিডি, ই-ট্রাফিক প্রসিকিউশন এবং পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেটের জন্য ই-সার্ভিস চালু করা হয়েছে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘১৫ বছর আগের বাংলাদেশ আর আজকের বাংলাদেশ এক নয়। বিগত ১৫ বছরে আমাদের প্রবৃদ্ধি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭.২৫ শতাংশে। মাথাপিছু আয় বেড়েছে ৫ গুণ। বাজেটের আকার ১২ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা দারিদ্র্যের হার ৪১.৫১ শতাংশ থেকে ১৮.৭ শতাংশে হ্রাস করেছি। এ সময়ে অতি দারিদ্র্যের হার কমেছে ৫ গুণ। বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ৮ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। মানুষের গড় আয়ু এখন ৭২.৮ বছর। আমরা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করেছি। মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, পাতাল রেলের কার্যক্রম উদ্বোধন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল, ‘বঙ্গবন্ধু টানেল’, ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১’ আমাদের সামর্থ্যরে প্রতীক। তিনি বলেন, আমরা ৩২টি জেলা, ৩৯৪টি উপজেলা ইতোমধ্যে ভূমিহীন-গৃহহীনমুক্ত ঘোষণা করেছি। এ সকল উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা রক্ষায় বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীরও রয়েছে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান।’
‘স্মার্ট পুলিশ, স্মার্ট দেশ; শান্তি প্রগতির বাংলাদেশ’– এই প্রতিপাদ্য নিয়ে আজ মঙ্গলবার শুরু হলো পুলিশ সপ্তাহ। পুলিশ সপ্তাহ উপলক্ষে ২০২৩ সালে অসীম সাহসিকতা, বীরত্বপূর্ণ কাজ, মামলার রহস্য উদ্ঘাটন, অপরাধ নিয়ন্ত্রণ, দক্ষতা প্রদর্শন, কর্তব্যনিষ্ঠা, সততা ও শৃঙ্খলাপূর্ণ আচরণের জন্য ৪০০ জন বিপিএম ও পিপিএম পদক পাচ্ছেন। আগামী ৩ মার্চ ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে প্রধান বিচারপতির সম্মেলনের মধ্য দিয়ে শেষ হবে সপ্তাহের আয়োজন। পুলিশ সপ্তাহে এক বছরের কার্যক্রম পর্যালোচনা করে পরবর্তী বছরের কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করা হয়।