দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন : চরম আবহাওয়ায় খাপ খাওয়ানোর সক্ষমতা হারাচ্ছে বাংলাদেশ

মত ও পথ ডেস্ক

প্রতীকী ছবিটি সংগৃহীত

প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের কারণে শাহনাজ আলী এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ছুটে চলেছেন। শুরুটা হয়েছিল ১৯৭০ সালে। তখন ঘূর্ণিঝড় ভোলা বাংলাদেশে আঘাত হানে। সে সময় তাঁর পরিবার বাস্তুচ্যুত হয়। তার পর থেকেই তারা ছুটছেন; কোথাও পাননি নিজের বাড়ির মতো শান্তির আশ্রয়। ঘূর্ণিঝড় ভোলার আঘাতে শাহনাজ আলীর দাদা-দাদিসহ পাঁচ লাখ মানুষ মারা গিয়েছিল। দেশের ইতিহাসে এটি ছিল ভয়াবহতম ঘূর্ণিঝড়।

গতকাল বুধবার প্রভাবশালী ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। এতে বলা হয়, বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বারবার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব নিয়ে এসেছে। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এটি জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতির ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর অন্যতম। তথাপি প্রতিকূলতার বিপরীতে বাংলাদেশ যতটা সম্ভব মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছে।

সম্প্রতি ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইসিসিসিএডি) নামে ঢাকার গবেষণা প্রতিষ্ঠান এক প্রতিবেদনে সতর্ক করে বলেছে, বাংলাদেশ চরম আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষমতার সীমায় পৌঁছে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগ যেভাবে উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে তাতে যা বর্তমান নীতি, অভিযোজন কৌশল দেশের মানুষ এবং অবকাঠামো ও বাস্তুতন্ত্রের সুরক্ষার জন্য যথেষ্ট হবে না।

আইসিসিসিএডি বলছে, ২০০০ সাল থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে বাংলাদেশ ঘূর্ণিঝড়, তাপপ্রবাহ, বন্যা ও খরার মতো ১৮৫টি চরম আবহাওয়ার ঘটনার সম্মুখীন হয়েছে।

আইসিসিসিএডির উপপরিচালক গবেষণা প্রতিবেদনের প্রধান লেখক অধ্যাপক মিজান খান বলেন, গবেষণায় দেখা গেছে, গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমন কমিয়ে আনলেও শতকের শেষ দিকে আগের তুলনায় বাংলাদেশে উষ্ণায়ন বাড়বে দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ১৯৭১ থেকে ২০০০ সালের তুলনায় প্রবল বর্ষণ বেড়ে নদীর তীর প্লাবিত হওয়ার শঙ্কা বাড়তে পারে ১৬ শতাংশ। এতে বন্যার ঝুঁকি বাড়বে। ফলে এখন যেভাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতি হচ্ছে, তা আরও বেড়ে যাবে। জলবায়ু সংকটে সাড়া দেওয়ার জন্য বাংলাদেশের সক্ষমতার জন্য একাধিক পদক্ষেপের প্রয়োজন। জাতীয় সমন্বয়, সরকারি বিনিয়োগ দরকার। সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে। চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় বাংলাদেশকে অবশ্যই জলবায়ু-পরিবর্তনের প্রভাব মূল্যায়ন করতে হবে এবং অবিলম্বে পদক্ষেপ নিতে হবে। দেশের সবচেয়ে দরিদ্ররা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ, তাদের প্রতিকূলতা মোকাবিলার সামর্থ্য নেই। উন্নয়ন সহযোগীদের স্থানীয় অভিযোজনের জন্য অর্থায়ন বাড়াতে হবে।

দেশে তাপপ্রবাহ বাড়ছে, বলছে আরেকটি গবেষণা গত মঙ্গলবার প্রকাশ হয় পৃথক আরেকটি গবেষণার ফল। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর ও নরওয়ের আবহাওয়া দপ্তরের পাঁচ আবহাওয়াবিদের ওই যৌথ গবেষণায় বলা হয়েছে, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের নানা নেতিবাচক প্রভাব এখন মোকাবিলা করতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। দেশে বর্ষা মৌসুমে তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। বর্ষা আসছে দেরিতে, যাচ্ছেও দেরিতে। দেশে তাপপ্রবাহের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। আবার শীতের মধ্যেও তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রবণতা দেখছি।

আবহাওয়াবিদ বজলুর রশীদ বলেন, সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো দাবদাহের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। বিশেষ করে বর্ষাকালে। সারাদেশেই এটি বাড়ছে। শীতেও স্থানীয়ভাবে আবহাওয়ার বেশ পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। শীতকালে ঠান্ডা অনুভূত হচ্ছে বেশি। তিনি বলেন, এ দাবদাহ ও শৈত্যপ্রবাহের প্রভাব পড়বে কৃষিতে। সেচের জন্য জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খরচ বাড়বে; এসি লাগবে বেশি। সাধারণত তাপপ্রবাহ দেখা যেত গ্রীষ্মকালে– এপ্রিল ও মে মাসে। এখন অক্টোবর পর্যন্ত চলে গেছে। আগে গ্রীষ্মকালে যে দাবদাহ হতো, গত ১২ বছর থেকে দেখা যাচ্ছে, এটা দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে। শুধু গ্রীষ্মকালে না, বর্ষাকালেও হচ্ছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক আজিজুর রহমান বলেন, দেশে চরমভাবাপন্ন আবহাওয়া দেখা যাচ্ছে। বর্ষা আসছে দেরিতে, যাচ্ছেও দেরিতে। তাপপ্রবাহের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বর্ষা, শীত ও গ্রীষ্মেও তাপ বেড়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশে নিযুক্ত নরওয়ের রাষ্ট্রদূত এসপেন রিক্টার সেভেন্ডসন বলেন, বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর একটি। আবহাওয়া পরিস্থিতি সম্পর্কে কার্যকর বৈজ্ঞানিক গবেষণা, তথ্য-উপাত্তের ব্যবহার জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় বাংলাদেশের জন্য সহায়ক হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারপারসন ফাতিমা আকতার বলেন, শুধু গবেষণার পরিসংখ্যান নয়, চরমভাবাপন্ন আবহাওয়ার প্রভাব প্রতিনিয়ত টের পাচ্ছি। আমাদের কৃষি ও জীববৈচিত্র্যের ওপর এর প্রভাব পড়ছে। ভবিষ্যতে খাদ্য নিরাপত্তা, অবকাঠামো আরও ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে।

শেয়ার করুন