রাজধানী ঢাকার বেইলি রোড। খাবারদাবার, শপিং আর সুন্দর সময় কাটানোর স্থান। নামিদামি রেস্টুরেন্ট, বড় বড় শপিং সেন্টারের সমারোহ এই বেইলি রোডে। দিবারাত্র প্রাণচঞ্চল সেই জায়গায় এক ভবনে ঘটেছে ভয়াবহ আগুনের ঘটনা। সর্বশেষ পাওয়া তথ্যে প্রাণ হারিয়েছেন ৪৬ জন। আহত হয়েছেন অনেকে। এমন একটি ভবনে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপন-ব্যবস্থা থাকবে না, ভাবা যায়! খোদ ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার ড. খ. মহিদ উদ্দিন বলেছেন, ভবনটিতে অগ্নিনিরাপত্তা-ব্যবস্থা ছিল না বললেই চলে। এ দায় আসলে কার? প্রতিটি ঘটনায় তদন্ত কমিটি হয় কিন্তু কারো ওপর দায় চাপে না। তাই রাজধানী ঢাকার বাসিন্দাদের অগ্নিকুণ্ডলীতেই বসবাস করতে হয়; লাশ হতে হয়!
অসভ্যতার আগুন নেভায় সাধ্য কার? আমাদের নিশ্চয় মনে আছে ২০১০ সালের ৩ জুন নিমতলীর ৪৩/১ নবাবকাটরায় পাঁচ তলা বাড়িতে স্মরণকালের অন্যতম ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় হারাতে হয় ১২৩ জনকে। আহত হয় কয়েক শ মানুষ। এরপর গত ২৩ বছরে বহু অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এক দশকে পুরান ঢাকায় আগুনে পুড়ে মারা গেছেন ১ হাজার ৪৯৩ জন। তবে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটেছে ২০১১ সালে ৩৬৫ জন। এক দশকে আগুনে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৪ হাজার ২৮৬ কোটি ৮৬ লাখ ৬২ হাজার ৭৯৪ টাকা। তারপরও প্লাস্টিক ও কেমিক্যালের কারখানায় চরম ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে পুরান ঢাকার মানুষ।
২০১৯-এর ২৩ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর পুরান ঢাকার চকবাজারে ফের আগুন লাগে। শতাধিক মানুষ পুড়ে ছাই হয়। ঘনবসতিপূর্ণ রাজধানীর চকবাজার এলাকা। দাহ্য রাসায়নিক পদার্থের কারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। সম্পদের সঙ্গে মানুষও অঙ্গার হয়। সেদিন বনশ্রীর ডি ব্লকের এক বাসিন্দা লিখেছেন—রেডিয়েন্ট কৃষ্ণচূড়া কন্ডেমিনিয়ামে বসবাস করেন ৯০টি পরিবারে প্রায় সহস্রাধিক মানুষ। ঠিক এর মূল ফটকে আছে কেমিক্যাল গোডাউন। তারা বারবার সংশ্লিষ্ট বিভাগকে জানালেও কেমিক্যাল গোডাউনটি আছে বহাল তবিয়তে।
পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় প্রায় চার হাজার কেমিক্যাল গোডাউন, কারখানা রয়েছে। এগুলো সরানোর কথা। উচ্চ আদালতেরও নির্দেশ ছিল। কে সরাবেন? ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বিভাগের সাম্প্রতিক জরিপে ঢাকার জনবহুল ভবন বিশেষ করে হাসপাতাল, শপিংমল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ ২ হাজার ৬১২টি ভবনের অগ্নিনির্বাপণ-ব্যবস্থা খতিয়ে দেখে। সেখানে মাত্র ৭৪টি ভবন ছাড়া বাকি সব ভবন, অর্থাৎ ২ হাজার ৫৩৮টি ভবন ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বলে জরিপে উঠে আসে!
অগ্নিদুর্ঘটনার হাত থেকে নিরাপদ ও কার্যকর ব্যবস্থার নাম ফায়ার হাইড্রেন্ট। বিশ্বের প্রায় সব শহরে অগ্নিদুর্ঘটনা রোধে এই ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। কিন্তু অপরিকল্পিত এই ঢাকা নগরীতে আজও ফায়ার হাইড্রেন্ট ব্যবস্থা গড়ে তোলার কোনো উদ্যোগই নেওয়া হয়নি। নিমতলী ও চকবাজারের ঘটনায় দেখা গেছে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা সরু অলিগলি পেরিয়ে দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছতে পারলেও প্রয়োজনীয় পানি সরবরাহের অভাবে দ্রুত সময়ের মধ্যে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেননি। ফলে আগুনের ব্যাপ্তি ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেশি হয়েছে।
ফায়ার হাইড্রেন্ট হচ্ছে পানির একটি সংযোগ-উৎস। যে কোনো জরুরি প্রয়োজনে এই উৎস থেকে পানি ব্যবহার করা যায়। এর সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, এর সঙ্গে লম্বা পাইপ যুক্ত করে ইচ্ছেমতো যে কোনো দূরত্বে পানি সরবরাহ করা যায়। যতদূর জানি, ঢাকার মানুষের জন্য প্রথম সাপ্লাই পানির ব্যবস্থা করে ঢাকার নবাব পরিবার। তখন পুরান ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ফায়ার হাইড্রেন্টের ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। সেই ফায়ার হাইড্রেন্টে অগ্নিদুর্ঘটনা রোধে ব্যবহার না হলেও সাধারণ মানুষ গোসল খাওয়া-দাওয়াসহ বিভিন্ন কাজেই সেই ফায়ার হাইড্রেন্ট থেকে পানি ব্যবহার করত। পরবর্তীকালে এসব পানির উৎস বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অথচ এগুলো আজ চালু থাকলে প্রয়োজনীয় পানি পেতে বেগ পেতে হতো না। শুধু ফায়ার হাইড্রেন্ট নয়, ঢাকায় একসময় প্রচুর পরিমাণে পুকুর-ডোবাসহ নানা ধরনের জলায়শও ছিল। এসব থেকে অগ্নিদুর্ঘটনারোধে সহজেই পানি পাওয়া যেত। কিন্তু কর্তৃপক্ষের চরম গাফিলতির কারণে এগুলো ভরাট, দখল হয়ে গেছে। আজ উদ্ধারের কোনো ব্যবস্থা নেই।
অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধ ও প্রতিকারে ভবন থেকে বেরিয়ে আসার পথ এবং আগুন নেভানোর ব্যবস্থাপনা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ, আগুন লাগলে মানুষ যাতে বেরিয়ে আসতে পারে, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রশস্ত সিঁড়ি এবং এক ভবন থেকে আরেক ভবনের প্রয়োজনীয় দূরত্ব রক্ষা করা জরুরি।
অগ্নিনির্বাপণ-ব্যবস্থা বলতে লোকজন সাধারণত বোঝে ভবনে ফায়ার এক্সটিংগুইশার থাকা। কিন্তু এটি যথেষ্ট নয়। বহুতল ভবনে আগুন নির্বাপণ ও জরুরি নির্গমনে কয়েকটি বিষয় মেনে চলা জরুরি। এগুলো হলো—রাইজার স্থাপন, স্বয়ংক্রিয় স্প্রিং কলার, আন্ডারগ্রাউন্ড পানির রিজার্ভ, ফায়ার ফাইটিং পাম্প হাউজ, স্মোক ও হিট ডিটেকশন সিস্টেম স্থাপন ও ফায়ার লিফট নির্মাণ। অনিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনার কারণে নিয়ম না মানা ভবন মালিকদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না। ফলে একদিকে অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি বাড়ছে, অন্যদিকে অগ্নিকাণ্ডের পর নির্বাপণ-ব্যবস্থা ও ভবন থেকে জরুরি নির্গমন-ব্যবস্থা আরো অকার্যকর হয়ে পড়েছে। এসব অসংগতি দূর করে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
লেখক : সাংবাদিক, মহাসচিব-কলামিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ