ভারতের লোকসভা ভোটের আগে গোটা দেশে চালু হলো সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ)। একটি বিজ্ঞপ্তি দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে সিএএ চালু হওয়ার কথা জানিয়েছে দেশটির কেন্দ্রীয় সরকার। বিল পাস হওয়ার চার বছর পর চালু হলো এটি।
আইনে পরিণত হলেও সাড়ে চার বছর ধরে সিএএর ধারা-উপধারা যুক্ত হয়নি।
ফলে বাস্তবে এই আইন কার্যকরও হয়নি। নিয়ম অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি সই করার ছয় মাসের মধ্যে আইনের নির্দিষ্ট ধারা-উপধারা যুক্ত করতে হয়। অন্যথায় লোকসভা কিংবা রাজ্যসভার নির্দিষ্ট কমিটিগুলোর কাছে বিশেষ অনুমতি নিতে হয়। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২০২০ সাল থেকে আইন কার্যকর করার সময়সীমা বৃদ্ধির আবেদন জানিয়ে আসছিল।
এই বিলম্ব নিয়ে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারকে কটাক্ষও করছিল বিরোধী দলগুলো।
দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর ২০১৯ সালের ১১ ডিসেম্বর সিএএ পাস করিয়েছিল কেন্দ্রের মোদি সরকার। ওই আইন অনুযায়ী, বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মতো মুসলিম ধর্মাবলম্বী দেশ থেকে যদি সে দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা ধর্মীয় উৎপীড়নের কারণে ভারতের আশ্রয় চায়, তাহলে তা দেবে ভারত। সংসদের দুই কক্ষে পাস হওয়ার পরে দেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দও অনুমোদন দিয়েছিলেন সিএএ বিলে। কিন্তু এত দিন ধরে সিএএ কার্যকর করা নিয়ে কোনো বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়নি।
গত ফেব্রুয়ারি মাসে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ জানিয়েছিলেন, লোকসভা নির্বাচনের আগেই দেশে সিএএ কার্যকর হবে। শুধু তা-ই নয়, শাহ এ-ও বলেছিলেন, শিগগিরই সিএএ কার্যকরের বিষয়ে বিজ্ঞপ্তি জারি হয়ে যাবে। তবে মতুয়া অধ্যুষিত নদিয়া ও উত্তর ২৪ পরগনার সভায় গিয়ে সিএএ নিয়ে মুখ খোলেননি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
বনগাঁর বিজেপি প্রার্থী তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শান্তনু ঠাকুর বলেছিলেন, ‘ভোটের আগে সিএএ কার্যকর হচ্ছেই। ভোট ঘোষণার এক-দুই দিন বা তিন দিন আগে হলেও সিএএ কার্যকর হবে। এমনকি নির্বাচন বিধি চালু হওয়ার এক ঘণ্টা আগেও সিএএ কার্যকর হতে পারে।
এ ছাড়া গত মাসেই সংবাদ সংস্থা পিটিআইকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কর্মরত এক কর্মকর্তা জানিয়েছিলেন, সিএএ কার্যকরের বিজ্ঞপ্তি লোকসভা নির্বাচনের অনেক আগেই জারি হয়ে যাবে। এই আইনের নিয়ম বা ধারা তৈরি হয়ে গেছে। নাম নথিভুক্তকরণের জন্য অনলাইন পোর্টালও প্রস্তুত। তিনি আরো বলেছিলেন, ‘সিএএর গোটা প্রক্রিয়াই অনলাইনে হবে। সেখানে আবেদনকারীদের শুধু জানাতে হবে তাঁরা কবে ভারতে প্রবেশ করেছিলেন।
এদিকে সিএএ কার্যকর করা নিয়ে দীর্ঘদিন কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যেই টালবাহানা চলছিল। অন্যদিকে করোনার আগে থেকেই দেশটির নানা প্রান্তে সিএএবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। সারা দেশে আন্দোলনে প্রাণ যায় প্রায় ১০০ জনের। বিজেপিবিরোধী দলগুলোই এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল। পশ্চিমবঙ্গের মতো বিরোধী শাসিত রাজ্যগুলো ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে সিএএ কার্যকরের বিরোধী। এখনো পর্যন্ত লোকসভা নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা করেনি নির্বাচন কমিশন। তার আগেই গোটা দেশে চালু হয়ে গেল সিএএ।
একনজরে সিএএ
২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান থেকে ধর্মীয় কারণে নিপীড়নের জন্য ভারতে যাওয়া শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। ওই দেশগুলো থেকে হিন্দু, শিখ, জৈন, বৌদ্ধ, পার্সি ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের শরণার্থীদের নাগরিকত্ব প্রদানের বিষয়টি সিএএতে উল্লেখ করা হয়েছে। যদিও এই আইনে মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্তদের কথা বলা হয়নি। অর্থাৎ ওই ছয় সম্প্রদায় ছাড়া পাকিস্তান, বাংলাদেশ, আফগানিস্তান বা অন্য কোনো দেশ থেকে আসা অন্য কোনো সম্প্রদায়ের শরণার্থীকে ভারতীয় নাগরিকত্ব দেওয়া হবে না।
আইন অনুযায়ী, ভিসা বা পাসপোর্টের মতো নথি না থাকলেও ভারতীয় নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য আবেদন করতে পারবেন শরণার্থীরা। ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনে বলা হয়েছিল, নাগরিকত্ব পেতে টানা এক বছর ভারতে থাকতে হবে। এ ছাড়াও বিগত ১৪ বছরের মধ্যে ১১ বছর ভারতে থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু সংশোধনী আইনে সেই ১১ বছরের সময়কাল কমিয়ে পাঁচ বছর করা হয়েছে।
বিরোধীদের আপত্তির কারণ
উত্তর-পূর্ব ভারত থেকেই মূলত আপত্তি উঠেছিল সিএএ নিয়ে। অনেকেই আশঙ্কা করছেন, সিএএ কার্যকর হলে শরণার্থীদের ব্যাপক ভিড় বৃদ্ধি পাবে উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোতে। তার ফলে ভাষাগত ও সংস্কৃতিগত সমস্যা প্রকট হতে পারে। নিজেদের ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষার স্বার্থেই অনেকে সিএএবিরোধী আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন। পাশাপাশি আইনে মুসলিমদের বাদ দেওয়া নিয়েও প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। শুধু তা-ই নয়, দক্ষিণ ভারতে সিএএ বিরোধিতার মূল কারণ, কেন তামিলদের উদ্বাস্তুদের বাদ দেওয়া হলো?
সেই সঙ্গে সিএএর ৬এ ধারার সাংবিধানিক বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। সেই আইনে বলা হয়েছিল, ১৯৬৬ সালের ১ জানুয়ারির পর এবং ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের আগে যাঁরা আসামে এসেছেন এবং থেকে গিয়েছেন তাঁদের সবাইকেই নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। তা নিয়েই আপত্তি তোলেন আসামের আদি বাসিন্দারা। সিএএর প্রতিবাদে দেশজুড়ে বিক্ষোভ ও অশান্তিতে হতাহতের ঘটনা ঘটে। দিল্লি, উত্তর প্রদেশ, আসামের মতো বেশ কিছু রাজ্যে সহিংসতা হয়।
বিরোধী তৃণমূল অবশ্য বিষয়টিকে ‘উদ্বাস্তু মানুষদের ভাঁওতা দেওয়ার চেষ্টা’ বলে কটাক্ষ করে। স্বয়ং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সিএএকে ‘ক্যা ক্যা’ বলে কটাক্ষ করেছিলেন। তৃণমূল নেতৃত্ব বরাবরই সিএএ প্রসঙ্গে দাবি করে আসছেন, যে নাগরিকেরা ভোট দেন, আধার কার্ড, ভোটার কার্ড আছে, তাঁরাই এ দেশের নাগরিক। তাই তাঁদের নতুন করে নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রয়োজন নেই।
মমতা বলেন, নাগরিকত্ব দেওয়াই যদি কেন্দ্রীয় সরকারের আসল লক্ষ্য হয় তবে নতুন আইনের প্রয়োজন কেন পড়ছে? পাশাপাশি, আইনে মুসলিমদের বাদ দেওয়া নিয়েও আপত্তি তাঁর। তাঁর কথায়, এভাবেই ‘নাগরিকত্ব’ কেড়ে নেওয়া হবে?
এ ছাড়াও বিরোধীদের দাবি, সিএএ ভারতীয় সংবিধানের মৌলিক নীতি বিরোধী। এই আইনের মাধ্যমে ধর্মের ভিত্তিতে ‘বৈষম্য’ সৃষ্টি করছে। নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমারের মতো দেশগুলোকে কেন বাদ দেওয়া হলো তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছিল। যদিও মোদি সরকার বিরোধীদের সব অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে দাবি করেছে, এই আইন চালু হলে কোনোভাবেই ভারতের কোনো নাগরিকের ওপর প্রভাব পড়বে না।
সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা