পৃথিবীর শত আঁধারের মাঝে আলোর সঞ্চারণের প্রতীকী মাধ্যম হলো ফানুস। প্রাচীনকালে সাইরিয়াস নামক নক্ষত্রের উদয় উদযাপনের জন্য ফারাও-রা (ফেরাউন) যে উৎসব উদযাপন করত, সেই উৎসবে ব্যবহৃত মশাল থেকেই প্রকৃত পক্ষে ফানুসের উদ্ভব হয়।
প্রাচীন মিশরীয়রা ফারাও সম্রাটদের জন্মদিন উদযাপন করার সময় রাস্তাগুলোকে আলোকিত করতো ফানুস দিয়ে। তাছাড়াও নেপোলিয়ান মিশর আক্রমণ করার পর তার দখলদারিত্বের প্রতিবাদে পুরো মিশরবাসী আকাশে ফানুস ছেড়ে প্রতিবাদ করেছিল।
আধুনিক মিশরে রমজানে ফানুস প্রচলন নিয়ে বিস্তারিত জানাচ্ছেন মিশরে জাগো নিউজ প্রতিনিধি আফছার হোসাইন।
মিশরে রমজানের সাজসজ্জার উপকরণ হিসেবে ফানুসের প্রথাগত ব্যবহারের সূচনা ধরা হয় ফাতিমীয় খেলাফতের সময় থেকে। ফাতিমীয় খেলাফত মূলত ছিল মিশরকেন্দ্রিক। ৯৫২ খ্রিস্টাব্দে ফাতেমি খলিফা মুইজ ঈল-দ্বীনিল্লাহ আবু তামিম মা’আদ -বিন মানসুর আল-উবাইদি পবিত্র রমজান মাসে তৎকালীন মিশরের রাজধানী ফুসতাত আগমন করেন। তখন তার সম্মান ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য ফুসতাতকে ফানুস দিয়ে আলোক সজ্জিত করা হয়েছিল। সেই থেকে রমজানে ফানুসের ব্যবহার করে আসছে মিশরীয়রা।
প্রতি বছর আরবী মাস শা’বান এর ১৫ তারিখের পর পরেই বিশ্বের প্রাচীন কৃষ্টি সভ্যতা সমৃদ্ধ মুসলিম দেশটির রাজধানী ইসলামিক কায়রোসহ সারাদেশের বিভিন্ন দোকানে বাহারি নামের রংবেরং এর ফানুস এর পসরা সাজিয়ে বসে দোকানিরা। রমজানের শুরু হওয়ার ১৫দিন আগে থেকেই রাস্তায় বের হলেই কানে ভেসে আসে দেশটির ঐতিহ্যবাহী, রমজানের গান ওহাওয়ি -ওয়া- ওহাওয়ি, ইউয়োয়া- উয়াহা…
এদেশে রমজান মাসে সন্ধ্যা থেকে সকাল পর্যন্ত প্রতিটি বাড়ি, রাস্তা ও দোকানে ফানুস জ্বালানো ও আলোকসজ্জা করা রমজানের সংস্কৃতি। দেশটির রাজধানী কায়রোসহ বিভিন্ন শহর ও গ্রামের অলি-গলির দোকানগুলো এখন বাহারি রঙের ফানুসে সয়লাব। রমজান শুরু হওয়ার আগে থেকেই দোকানিরা হরেক রকম ফানুস এনে সাজিয়েছেন দোকান। বিভিন্ন ডিজাইন ও রঙ-বেরঙ এর ফানুসের রয়েছে অদ্ভুত ধরনের যতসব বাহারি নাম। যেমন, আল- খামাসি, আবু শামা, আবু লাদ, আল-দালিয়াইয়া, আল-খুম্মাস, আল-বুর্জ, শামামা ইত্যাদি।
মিশরীয়দের কাছে সব থেকে জনপ্রিয় ফানুসটির নাম খামাসি। লোহা ও তামার কাঠামোতে তৈরি রঙিন কাচ দিয়ে ঝরানো ফানুসটি খুবই শক্ত ও টেকসই। ত্রিশ দশকের দিকে মিশরের সংসদ ভবনে এই ফানুসটি ঝোলানো হয়েছিল বলে বলেই এর এত জনপ্রিয়তা।
ইসলামি কায়রোর মুইজ -ঈল – স্ট্রিটে গিয়ে দেখা যায় ছোট বড় বিভিন্ন আকার এবং মাপের ফানুসে দোকানগুলো সয়লাব। প্রকারভেদে একেকটি ফানুসের দাম ৪০ গিনি (১০০ টাকা) থেকে পাঁচ হাজার গিনি (১২ হাজার ৫০০টাকা)। তবে এর মধ্যে ছোট সাইজের ফানুস বিক্রি হচ্ছে বেশি, যার মূল্য ১০০ থেকে ৩০০ গিনি বা ২৫০টাকা থেকে ৮০০ টাকা। মেট্রোরেল, পাবলিক বাস ও রাস্তায় বসেও ফেরিওয়ালারা চিনের তৈরি ছোট ছোট ফানুস বিক্রি করছে ফেরি করে।
কায়রোর কূটনীতিক পাড়ার নাইন স্ট্রিট, ইসলামিক কায়রোর আল-আজহার, সাঈদা হোসাইন, খান-ঈল খলিলি ও সাঈদা জয়নব এলাকার দোকানিরা জানান, অন্যান্য বছরের তুলনায় এবারের রমজানে ফানুসের চাহিদা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। কারণ, গত বছরের তুলনায় এবছর ফানুসের দাম ৫০ শতাংশের ও বেশি বেড়েছে।
তারা বলেন, এ বছর মিশরীয় পাউন্ডের বিপরীতে অপ্রত্যাশিতভাবে ডলারের উচ্চমূল্যে বাড়ার কারণে ফানুসের উৎপাদন উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। কারণ, ফানুস তৈরির কাঁচামাল আমদানি করতে হয় অন্য দেশ থেকে।
রমজানে ফানুসের বেশি ব্যবহারের জন্যই তা একটি শিল্পে পরিণত হয়েছে মিশরে। এ শিল্পের সঙ্গে বিপুল সংখ্যক মানুষের জীবন-জীবিকা জড়িয়ে আছে। প্রতি বছর নতুন নতুন ডিজাইন নিয়ে ফানুস বাজারে আনার চেষ্টা করে ফানুস ব্যবসায়ীরা। মিশর প্রতি বছর স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে ও মধ্যপ্রাচ্যেসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রমজান ফানুস রফতানি করে থাকে। ক্ষুদ্র পুঁজি নিয়ে বেসরকারি খাতে স্থানীয়ভাবে ফানুস তৈরিতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে মিশর।