পরিবেশবান্ধব পর্যটন এলাকায় প্রকৃতি, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের কোনো প্রকার ক্ষতি না করে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য উপলব্ধি, উপভোগ ও অধ্যয়নের নাম হলো ইকো-ট্যুরিজম। ইকো-ট্যুরিজম পর্যটনের এমন একটি উন্নয়ন ধারণা, যা পরিবেশের সুরক্ষা ও সংরক্ষণ, পরিবেশগত ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি এবং স্থানীয়দের সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিকাশের নিশ্চয়তা প্রদান করে। হেক্টর সেবালাস ল্যাসকুরেন ১৯৮৩ সালে মেক্সিকোতে ‘প্রোন্যাচারা‘ (PRONATURA) নামক এনজিও প্রতিষ্ঠার সময় ইকো-ট্যুরিজম শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন। হেক্টর লক্ষ করেন যে, পর্যটক, প্রকৃতি ও সংস্কৃতির মধ্যে এক জটিল সম্পর্ক বিদ্যমান। ১৯৭০ ও ১৯৮০-এর দশকে পরিবেশ আন্দোলনের মাধ্যমে ইকো-ট্যুরিজমের প্রয়োজনীয়তা শুরু হয়। ইন্টারন্যাশনাল ইকো-ট্যুরিজম সোসাইটি (১৯৯১)-এর মতে, ইকো-ট্যুরিজম হলো প্রাকৃতিক অঞ্চলে দায়িত্বশীল ভ্রমণ; যা পরিবেশ সংরক্ষণ ও স্থানীয় মানুষের মঙ্গল সাধন করে।
জলবায়ু পরিবর্তনের এই সময়ে ইকো-ট্যুরিজমের ধারণা দেশে ও আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। ইকো-ট্যুরিজমের উদ্দেশ্য হলো সুসংগত ও স্থিতিশীল পর্যটন নিশ্চিত করা, দর্শনকারীদের ভিন্ন ভিন্ন বন্য উদ্ভিদ ও প্রাণী প্রজাতি এবং স্থানীয় বাসিন্দা সম্পর্কে অভিজ্ঞতা প্রদান, ইকো-ট্যুরিজমকে সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য পরিকাঠামোর সুব্যবস্থা করা, স্থানীয় আর্থসামাজিক বিকাশ সাধন, প্রকৃতি ও পরিবেশের সংরক্ষণ, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং সর্বোপরি কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা। জাতিসংঘের বিশ্ব পর্যটন সংস্থার মতে, প্রতি বছর ১২০ কোটির বেশি পর্যটক বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করে থাকে। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে প্রতি বছর প্রায় ৭ লাখের বেশি বিদেশি পর্যটক বাংলাদেশে ভ্রমণ করে থাকে। এছাড়া প্রতি বছর প্রায় ১ কোটির বেশি দেশি পর্যটক ভ্রমণ করে। ইকো-ট্যুরিজম পরিকল্পনায় পর্যটকের সংখ্যা যেমন বাড়বে, তেমনি প্রকৃতি-পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যকেও রক্ষা করা যাবে।
প্রাকৃতিক রূপবৈচিত্র্যে ভরপুর বাংলাদেশকে ইকো-ট্যুরিজমের স্বর্গরাজ্য বলা যায়। পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার, সিলেটের চা বাগান, জীববৈচিত্র্যে ভরপুর পৃথিবীর একমাত্র ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন, সমুদ্রকন্যা খ্যাত কুয়াকাটা, নয়নাভিরাম সেন্টমার্টিন, মনপুরাসহ অন্যান্য দ্বীপ, পার্বত্য চট্টগ্রামের বনাঞ্চল, রাঙামাটির কাপ্তাই লেক ও অন্যান্য পরিবেশগত পর্যটন স্পট, বান্দরবানের সাজেক ভ্যালি, নীলগিরি, চিম্বুক পাহাড়সহ পরিবেশগত অন্যান্য পর্যটন স্পট, খাগড়াছড়ির আলুটিলা গুহাসহ অন্যান্য পর্যটন স্পট, সিলেটের বিছানাকান্দি ও রাতারগুল, সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর, চলনবিল, মৌলভিবাজারের লাউয়াছড়া বন, নোয়াখালীর নিঝুম দ্বীপ, পাহাড়পুর, ময়নামতি, উয়ারী বটেশ্বর, বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক, ষাট গম্বুজ মসজিদসহ বিভিন্ন নদ-নদীর উপকূল, পহাড়-পর্বত, বিভিন্ন জলপ্রপাত, হাওর, বনভূমি, উদ্যান প্রভৃতি পর্যটনকেন্দ্র সমৃদ্ধ করেছে বাংলাদেশকে। সুন্দরবন হচ্ছে বাংলাদেশের ফুসফুস এবং বাংলাদেশের জনগণকে এই সুন্দর ও মহত্ প্রাকৃতিক উপহারের যত্ন নিতে হবে। সুন্দরবন হলো বঙ্গোপসাগর উপকূলবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত একটি প্রশস্ত বনভূমি; যা বিশ্বের প্রাকৃতিক বিস্ময়াবলির অন্যতম। সুন্দরবনের মধ্যে আন্দারমানিক, আলিবান্দা, কচিখালী, কটকা, করমজল, কলাগাছিয়া, কলাবগী, দুবলার চর, দোবেকি, শেখেরটেক ইকো-ট্যুরিজম সেন্টার, হারবাড়িয়া প্রভৃতি ইকো-ট্যুরিজম স্পট।
ইতিমধ্যে বাংলাদেশের অনেক পর্যটন স্পট ইকো-ট্যুরিজমের আওতায় এসেছে। আবার অনেক পর্যটন স্পটকে ইকো-ট্যুরিজমে রূপান্তরিত করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। শুধু বিখ্যাত পর্যটন স্পটগুলো নয়, উপজেলা, ইউনিয়ন ও গ্রামপর্যায়ে জলাধার, উদ্যান এবং ঐতিহাসিক স্থানগুলো ইকো-ট্যুরিজমের অন্তর্ভুক্ত করা হলে জীববৈচিত্র্য রক্ষার পাশাপাশি গ্রামীণ অর্থনীতিও হবে শক্তিশালী। বাংলাদেশে ইকো-ট্যুরিজমের সম্ভাবনা উন্মোচনের লক্ষ্যে সরকারি, আধাসরকারি, বেসরকারি সংস্থাগুলোর সমন্বিত ও যৌথ পরিকল্পনা গ্রহণ করা আবশ্যক। বিশেষ করে বাংলাদেশের তিন পার্বত্য জেলা ইকো-ট্যুরিজমের জন্য অনেক বেশি সহায়ক। এখানকার স্থানীয় বাসিন্দাদের সম্পৃক্ত করে বৈচিত্র্যপূর্ণ সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশ অক্ষুণ্ন রেখে অন্তর্ভুক্তিমূলক টেকসই পর্যটন সবচেয়ে বেশি কার্যকর। সুন্দরবন, কক্সবাজার, কুয়াকাটাসহ বিখ্যাত পর্যটন স্পটকে কেন্দ্র করে ‘কমিউনিটি বেজড কালচারাল ইকো-ট্যুরিজম’ গড়ে তোলা যেতে পারে। এ দেশের বৈচিত্র্যময় প্রাকৃতিক সম্পদ, দর্শনীয় স্থান, এমনকি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বাসস্থানগুলো ইকো-রিসোর্ট হিসেবে গড়ে তোলা গেলে পরিবেশ সুরক্ষার পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে ও জাতীয়ভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখবে।
ইকো-ট্যুরিজম পরিবেশ সুরক্ষার পাশাপাশি টেকসই উন্নয়নের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে স্থানীয় এলাকার পরিকাঠামোগত বিকাশ ঘটে, যেমন :রাস্তাঘাট, বিদ্যুত্, হোটেল প্রভৃতি। ভূকৌশলগত অবস্থান ও বৈচিত্র্যময় প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়ে বাংলাদেশ ইকো-ট্যুরিজমের জন্য অনুকূল অবস্থানে রয়েছে। ষড়্ঋতুর বাংলাদেশে ঋতুভিত্তিক ইকো-ট্যুরিজমের সম্ভাবনাকে আরো কাজে লাগানো প্রয়োজন। মালদ্বীপ, তাইওয়ান, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের মতো দেশগুলো পর্যটন খাতকে পরিকল্পিতভাবে কাজে লাগিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। এসব দেশের অর্থনীতি পর্যটন খাতের ওপর অনেকাংশেই নির্ভরশীল। এছাড়া আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, জাপান, জার্মানি, ভারতসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ ইকো-ট্যুরিজমের সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হচ্ছে।
ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম কাউন্সিল (ডব্লিউটিটিসি) আশাবাদ ব্যক্ত করেছে, পর্যটনের হাত ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতি বদলে যেতে পারে। ইকো-ট্যুরিজম প্রকৃতি ও পরিবেশ সংরক্ষণ এবং টেকসই উন্নয়নে যেমন সহায়ক, তেমনি বিপরীতভাবে ইকো-ট্যুরিজমের কোনো প্রকল্প যেন প্রকৃতি ও পরিবেশের জন্য ক্ষতি বয়ে না আনে সেদিকেও লক্ষ রাখতে হবে। পর্যটন থেকে যে আয় হয়, তার দ্বারাই প্রকৃতির বাস্তবিক সংরক্ষণ সম্ভব। ইকো-ট্যুরিজমের সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো গেলে বাংলাদেশ এশিয়ার রোড মডেল হবে।
লেখক : শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়