মৃত্যু সব সময় অনাকাঙ্ক্ষিত। যদি তা হয় আত্মহত্যা, তাহলে বাড়তি হাহাকার তৈরি করে। গত কয়েক দিনে দুটো আত্মহত্যার খবর আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। একজন প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী সাদি মহম্মদ, অন্যজন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্রী ফাইরুজ সাদাফ অবন্তিকা।
অবন্তিকা গত শুক্রবার রাতে কুমিল্লায় নিজ বাড়িতে আত্মহত্যা করে। ফেসবুকে পোস্ট করা সুইসাইড নোটে সে লিখেছে– ‘আর আমি ফাঁসি দিয়ে মরতেসি। আমার উপর দিয়ে কী গেলে আমার মতো নিজেকে এতো ভালোবাসে যে মানুষ সে মানুষ এমন কাজ করতে পারে। আমি জানি এটা কোনো সলিউশন না কিন্তু আমাকে বাঁচতে দিতেসে না বিশ্বাস করেন। আমি ফাইটার মানুষ। আমি বাঁচতে চাইসিলাম! আর পোস্টমর্টেম করে আমার পরিবারকে ঝামেলায় ফেলবেন না। এমনিতেই বাবা এক বছর হয় নাই মারা গেছেন আমার মা একা। ওনাকে বিব্রত করবেন না। এটা সুইসাইড না, এটা মার্ডার। টেকনিক্যালি মার্ডার।’
অবন্তিকা তাঁর পোস্টে আরও লিখেছে– ‘আমি যদি কখনো সুইসাইড করে মারা যাই তবে আমার মৃত্যুর জন্য একমাত্র দায়ী থাকবে আমার ক্লাসমেট আম্মান সিদ্দিকী, আর তার সহকারী হিসেবে তার সাথে ভালো সম্পর্ক থাকার কারণে তাকে সাপোর্টকারী জগন্নাথের সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলাম। আম্মান যে আমাকে অফলাইন-অনলাইনে থ্রেটের ওপর রাখত, সে বিষয়ে প্রক্টর অফিসে অভিযোগ করেও আমার লাভ হয় নাই। দ্বীন ইসলাম আমাকে নানানভাবে ভয় দেখায় আম্মানের হয়ে যে আমাকে বহিষ্কার করা ওনার জন্য হাতের ময়লার মতো ব্যাপার।’
অবন্তিকার আত্মহত্যার পরপরই সেদিন শিক্ষার্থীরা অবন্তিকার ঘটনার বিচার চেয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে এবং তাৎক্ষণিক উপাচার্যের ক্ষমতাবলে উপাচার্য অধ্যাপক সাদেকা হালিম শিক্ষার্থী আম্মানকে সাময়িক বহিষ্কার এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামকে সাময়িকভাবে চাকরিচ্যুত করেন। এটি খুব ভালো সিদ্ধান্ত ছিল। এর পরের দিনই অবন্তিকার আত্মহত্যার ঘটনায় তাঁর মায়ের করা মামলায় সহপাঠী রায়হান সিদ্দিকী আম্মান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামকে আটক করেছে পুলিশ।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, এর আগে দুই পক্ষকে নিয়ে প্রক্টর অফিস বসেছিল। সেখানে অবন্তিকার বিরুদ্ধে জিডি করেছিল আম্মান এবং আরও কয়েকজন শিক্ষার্থী। দুই পক্ষের মীমাংসার শর্ত অনুযায়ী অবন্তিকার বিরুদ্ধে করা জিডি প্রত্যাহার করার কথা থাকলেও সেটি হয়নি বরং অবন্তিকাকে আরও হেনস্তা, ভয়ভীতি দেখানো শুরু হয়। প্রথম বর্ষ থেকেই তাকে উত্ত্যক্ত করা হতো। এ বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে সে প্রক্টর অফিসকে জানিয়েছে; কিন্তু তারা কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। বরং ঘটনার পর থেকেই সহপাঠীরা অনেকেই ক্লাসে অবন্তিকার সাথে বসত না, কথা বলত না এবং নানাভাবে তাকে অপমান করত। তাদের এই অপমান এবং একঘরে করার কারণে সে হল ছেড়ে দেয় এবং আরেক ছাত্রীর সঙ্গে থাকতে বাধ্য হয়।
অবন্তিকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন সংগঠনে সক্রিয় ছিল। তার মধ্যে নেতৃত্বের গুণ ছিল। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী খাদিজাতুল কোবরা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আটকের পর তার মুক্তির দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনেও সে সক্রিয় ছিল বলে জানা যায়। তা হলে তাকে কেন আত্মহত্যা করতে হলো? কারণ একটাই– এত অপমান, অসম্মান, ভয়ভীতি সে আর নিতে পারছিল না। আসলে এই আত্মহত্যার পর্যায়ে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় কী কী করতে পারত? প্রক্টর অফিসের অপরাধগুলো কী কী? দুই পক্ষের মীমাংসা হওয়ার পরও কেন সমঝোতার শর্ত অনুযায়ী জিডি প্রত্যাহার করা হলো না? সে ক্ষেত্রে প্রক্টর অফিসের ভূমিকা কী ছিল? কেন প্রক্টর অফিস থেকে অবন্তিকার আবেদনটি সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নিপীড়ন তদন্ত সেলে পাঠানো হয়নি?
যতদূর জানি, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নিপীড়ন তদন্ত সেল কার্যকর এবং বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক সাদেকা হালিম সেই সেলের একজন বহিঃস্থ বিশেষজ্ঞ সদস্য ছিলেন। তাহলে কেন সেই সেলের কাছে অভিযোগটি পাঠানো হলো না? মেয়েটির নিরাপত্তার জন্য প্রক্টর অফিস কি কোনো ব্যবস্থা নিয়েছিল? কিংবা দুই পক্ষের কাউন্সেলিংয়ের কোনো ধরনের ব্যবস্থা কিংবা পরামর্শ দিয়েছিল? কেন একজন শিক্ষার্থীকে অন্য শিক্ষার্থীরা একঘরে করে রাখবে? কেন তাকে হেনস্তা করবে? এই হেনস্তার বিষয়ে অবন্তিকা কি কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিল? আমার জানামতে, প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়েই আচরণবিধি নিয়ে আইন রয়েছে। সেটিকে কি আমলে নেওয়া হয়েছিল?
শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করলেও অবন্তিকা দীর্ঘদিন ধরে মানসিক নিপীড়ন সয়ে আসছিল। উপাচার্য যদিও তাৎক্ষণিক তাঁর এখতিয়ার অনুযায়ী ব্যবস্থা নিয়েছেন; আরও কয়েকটি বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে কঠোর হতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে কোনো ধরনের যৌন হয়রানির ঘটনা প্রক্টর অফিস জানামাত্র উপাচার্যকে জানানো এবং যৌন নিপীড়ন তদন্ত সেলে পাঠানো। দ্বিতীয়ত, কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করা। আমি নিশ্চিত, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু সেটি হয়তো শিক্ষার্থীরা খুব বেশি আমলে নেয় না। কিংবা তাদের সেই সেবা গ্রহণ করার জন্য সেভাবে পরামর্শও দেওয়া হয় না। শিক্ষার্থীদের কাউন্সেলিংয়ের বিষয়কে অধিক গুরুত্ব দিয়ে আমলে নিতে হবে।
শুধু জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় নয়; সহপাঠী কিংবা শিক্ষকের যৌন নিপীড়নের ঘটনায় বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কিছুদিন ধরে আন্দোলন চলছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে যৌন নিপীড়ন বন্ধের লক্ষ্যে হাইকোর্ট ২০০৯ সালে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে নীতিমালা প্রণয়ন করেন এবং সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে যৌন নিপীড়ন অভিযোগ কমিটি তৈরি করার জন্য নির্দেশ দেন। দুর্ভাগ্যের বিষয়, এখন পর্যন্ত বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে এ বিষয়ে কমিটি তৈরি হয়নি।
সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকার বড় তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়– ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর ও জগন্নাথ, যৌন নিপীড়ন এবং সবশেষ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে এর জেরে আত্মহত্যার ঘটনার মৌলিক প্রশ্নটি সামনে এনেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠাগুলো কি তাহলে যৌন নিপীড়নের ঘটনাকে সামলাতে পারছে না? এর কারণ কী? বারবার কেন একই ধরনের ঘটনা ঘটছে?
এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো কী কী করতে পারে? প্রথমত যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এখনও যৌন নিপীড়ন অভিযোগ সেল গঠিত হয়নি, তাদের জন্য জরুরি হাইকোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী সেটি তৈরি করা। দ্বিতীয়ত, সেই সেলের প্রচার এবং যৌন নিপীড়নবিষয়ক হাইকোর্টর নির্দেশনা শিক্ষার্থীদের ওরিয়েন্টেশনের সময়েই পুস্তিকা আকারে দিয়ে দেওয়া। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের আচরণবিধি (যেখানে কাউকে হেনস্তা, অপমান, হয়রানি এগুলো অপরাধ হিসেবে বিবেচিত) দিয়ে দেওয়া এবং এসব বিষয়ে সতর্ক করা, যেন কেউ কাউকে বুলিং না করে। এসব তাগিদ শিক্ষক, কর্মকর্তা এবং কর্মচারীদেরও দিতে হবে।
মনে রাখতে হবে, অভিযোগকারীর নিরাপত্তা বিধান এবং মানসিকভাবে সমর্থন দেওয়াও প্রশাসনের কাজ। অভিযোগকারী যেন নিরাপদে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে নিতে পারে এবং পরবর্তী সময়ে কোনো হেনস্তার শিকার না হয়, সে ব্যবস্থাও প্রশাসনকে করতে হবে। অভিযুক্তের শাস্তির পাশাপাশি কাউন্সেলিং প্রয়োজন। জরুরি হচ্ছে, প্রতিটি নিপীড়নের ঘটনা প্রকাশ হওয়ার পর বিভিন্ন পক্ষের আলোচনা, সমালোচনা, পরামর্শ মনোযোগ সহকারে আমলে নেওয়া। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যৌন নিপীড়ন থামাতে পারছে না। পরামর্শ শোনার ক্লেশটুকুও কি করতে পারবে না?
লেখক : অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়