বাংলা কি কখনো স্বাধীন ছিল? বাংলার মানুষের ইতিহাস কি কখনো লেখা হয়েছে? আমরা শুধু জানি রাজা, নবাব, সম্রাটদেরই কথা। তাঁদের জয়-পরাজয়ের কাহিনি। এর মধ্যে কিছু বিদ্রোহ দেখেছি। বেশির ভাগই ছিল ব্যর্থ বিদ্রোহ। সেসব বিদ্রোহ সম্পর্কে কিংবা সেসবের কারণে সাধারণ মানুষের অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়েছিল কি না, তা-ও জানা যায় না। ব্রিটিশ শাসন, তুর্কি শাসন, পাঠানদের শাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে জানা যায়, কিন্তু সাধারণ মানুষের অবস্থা কেমন ছিল, তার কোনো বিস্তারিত বিবরণ কেউ লিখে যায়নি।
তাই সর্বক্ষেত্রেই বিষয়গুলো অনুমানভিত্তিক। আমাদের নাটক, চলচ্চিত্র, উপন্যাস, ছোটগল্পেও একই অবস্থা। অল্প কিছু লেখক অবশ্য সৃজনশীল মাধ্যমে এসব বিষয়ে লেখার চেষ্টা করেছেন, যার মধ্যে শওকত আলীর ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ একটি অত্যন্ত উন্নতমানের গবেষণালব্ধ উপন্যাস।
একটি অনুমান সত্য যে রাজ্যেও শাসক পরিবর্তনের যুদ্ধে জনগণ শুধু লুণ্ঠনের শিকার হতো।
বিজয়ী রাজশক্তির লুটেরারা শিকারে অবতীর্ণ হতো এবং সেনারা এটিকে তাদের অধিকার বলেই মনে করত। এককথায় বলা যায়, জনগণের নিরাপত্তার প্রশ্ন ছিল একেবারেই গৌণ। এর মধ্যে শাসকদের সুবিধাভোগী শ্রেণি, নানা সময়ের জয়-পরাজয়ে তারাই উপকৃত হতো। ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর পাকিস্তান বলে একটি রাষ্ট্রের জন্ম হলো, যার ভিত্তি ধর্ম। আর এই রাষ্ট্রের জন্ম দিল ব্রিটিশ, যারা শিক্ষা-সভ্যতায় ছিল অগ্রগামী, কিন্তু জাতি হিসেবে তারা মোটেই সংস্কৃতিবান নয়।
তারা ধর্ম নিয়ে একটি খেলা শুরু করেছিল, যার সফল সমাপ্তি ঘটিয়ে গেল দাঙ্গায়। সেই সব দাঙ্গার কাহিনি শোনার এবং ধ্বংসচিহ্নগুলো দেখার সুযোগ আমাদের হয়েছিল। নেটিভ ব্রিটিশরাও স্বচক্ষে দেখেছে। হাজার বছরের প্রতিবেশীর বুকে ছুরি মারা, অগ্নিসংযোগ-ধর্ষণের চিত্র দেখে তারা উল্লসিত হয়েই দেশে ফিরে যায় লুণ্ঠিত সম্পদ নিয়ে। দম্ভের সঙ্গে বলে, ‘গ্রেটফুল রিট্রিট।’ বাংলাও ভাগ করে দিয়ে যায়। পূর্ব বাংলাও রেখে যায় অচেনা এক জনগোষ্ঠীর কাছে, যারা ভাড়াটে যোদ্ধা হিসেবে পরিচিত। তাদের কোনো সুলভ্য সংস্কৃতি নেই। তারা কোনো রাজনীতি বোঝে না। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ নামে এক উকিলের হাতে ছেড়ে দেয় পাকিস্তান। এই লোকের বাংলার মানুষ, বাংলার সংস্কৃতি সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিল না। অবলীলায় তিনি বলে দিলেন উর্দুই হবে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।
দুই পাকিস্তানের সংস্কৃতি, জানাশোনা, উন্নয়ন পরিকল্পনার কোনো কথাই নেই। পূর্ব বাংলার ওপর সুদীর্ঘ শোষণের কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করলেন না, বরং নতুন করে শোষণের পরিকল্পনা করে চললেন তাঁরা। বাংলা যেখানে ভারতবর্ষের সবচেয়ে উন্নত রাজনীতি এবং সংস্কৃতির ভূখণ্ড, তা এই উকিল সাহেব আমলেই নিলেন না। পূর্ব বাংলার মানুষ তাই আন্দোলন চালিয়ে গেল। আর ওই দেশের ভাড়াটে সেনাবাহিনী শাসক হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় নিজ দেশটি দখল করে নিল। বাংলার মানুষ কিন্তু থামল না। তাহজিব তমদ্দুনের নামে, ধর্মের নামে, শোষণ-শাসন অব্যাহত রাখলেও পূর্ব বাংলার মানুষ সেসব মেনে নেওয়ার নয়। তাই সারাটা সময় আন্দোলন চলতেই থাকল। উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান হলো। একাত্তরে একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে এ দেশ থেকে পাকিস্তানিরা পরাজিত হয়ে চলে গেল।
কিন্তু স্বাধীনতা কী? কবির ভাষায় স্বাধীনতা এক রকম আর বাস্তবের স্বাধীনতা অন্য রকম। স্বাধীনতার লড়াই শুধু বিদেশি শাসকদের বিরুদ্ধেই হয় না। বিদেশি শাসকদের ধ্বজাধারীদের বিরুদ্ধেও হয়। স্বাধীনতাসংগ্রামে যাঁরা অংশ নেন, তাঁদের সঙ্গেও একটা সম্পর্ক থাকে। কখনো পুরনো বন্ধুত্ব, কখনো আত্মীয়তা, কখনো শ্রেণি সম্পর্ক। যেসব দেশে স্বাধীনতার যুদ্ধ হয়েছে, তাদের লড়াই শেষ হলেও এই দোসরদের সঙ্গে লড়াইটা শেষ হয় না। তারা ঘাপটি মেরে থাকতে পারে, এমনকি নতুন শাসকগোষ্ঠীর মধ্যেও তাদের দৃঢ় অবস্থান থাকে। যারা আন্দোলন-সংগ্রাম, যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন, তাঁরাও শাসক হিসেবে নতুন। নানা ভুলভ্রান্তি, শত্রু চিনতে ভুল করা কোনো অসম্ভব ব্যাপার নয়। আবার একত্রে দেশপ্রেমিক বা বন্ধুকে শত্রু ভাবার মতো আত্মঘাতী ভুলও হতে পারে। যাঁরা যোদ্ধা, তাঁরাও রাজনীতির জটিল হিসাব বুঝতে অভ্যস্ত নন। তাই মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় অস্ত্র এবং হত্যার মাধ্যমে স্বাধীনতাকে রক্তাক্ত করা হলো। পাকিস্তানি সামরিক কৌশল ও কায়দায় দেশে সামরিক শাসন চলে এলো। ষাটের দশকের মতো আবার মিলিটারির বুটের আওয়াজ শোনা গেল, সামরিক আদালত, সামরিক প্রশাসন চালু হলো। পুরনো সেই পাকিস্তানি দোসররা যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে, তাদের পুনর্বাসন করা হলো।
এই নব্য শাসকরা আবার পাকিস্তানের সেই সেনা সংস্কৃতির মধ্য থেকেই উঠে আসা। আমলাতন্ত্রও তাই। পাকিস্তানি আমলারা সব সময়ই সেনা শাসকদের সঙ্গে একটা সহাবস্থানের নীতি নিয়ে চলত। এখানেও একই প্রক্রিয়া শুরু হলো। আবার বাংলাদেশের শিল্পী, বুদ্ধিজীবী, ছাত্র, জনতা সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ১৫ বছর লড়াই করল। দেশে নির্বাচনও হলো। নির্বাচনের পর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাও চালু হলো, কিন্তু দুটি বৃহৎ বিভাজন এলো। দলীয় সরকারের অধীনে দলীয় স্বাধীনতা এলো, কিন্তু বৃহত্তর জনগণের স্বাধীনতার বিষয়টি গৌণই থেকে যায়। এই পরিস্থিতিরই ক্রমবিকাশ হতে থাকে। দেশের শাসনপদ্ধতির মধ্যে অর্থনীতিবিদ ঢুকে পড়েন। দেশ শাসনের চিরায়ত নিয়মের মধ্যে ঢুকে পড়ে ব্যবসায়ী শ্রেণি। ছাত্ররাজনীতি নানা কারণে প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ায় ছাত্রসংসদগুলোর নির্বাচন বন্ধ হয়ে যায়। এই ছাত্ররাজনীতির মধ্য দিয়েই যে দেশের বড় বড় আন্দোলন ও পালাবদল সম্ভব হয়েছিল, তার দ্বার রুদ্ধ হয়ে গেল। শাসকগোষ্ঠীর অনুসারী ছাত্ররাই শুধু ছাত্ররাজনীতিতে থেকে গেল। যে শিক্ষাব্যবস্থার মধ্য থেকে মূল্যবোধ, কৃতি, ন্যায়বোধ ও রাজনীতির শিক্ষা পাওয়া যেত, সেই সংস্কৃতি একেবারেই বিপন্ন হয়ে গেল। ছাত্রনেতারা একসময় জনগণের কণ্ঠস্বর বলে বিবেচিত হতেন। সেই নেতারা মূল্যবোধ ও জনসম্পৃক্ততা থেকে বহুদূরে চলে গেলেন। এই সঙ্গে শিক্ষকরাও এই রাজনীতিতে জড়িয়ে গেলেন।
দলীয় রাজনীতির অচলায়তনে বন্দি থাকলে স্বাধীন চিন্তা করা যায় না। সব চিন্তার মধ্যেই এসে যায় একমুখী দলীয় চিন্তা, যার মধ্যে ব্যক্তিস্বার্থও জড়িয়ে থাকে গভীরভাবে। দেশের বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেও সেই একই প্রবণতা। এভাবে দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষিতদের মধ্যে কোনো সুপ্ত নয়, একেবারেই দৃশ্যমান বিভক্তি একটা ভয়ংকর রূপ নিয়েছে। এর মধ্যে কষ্টার্জিত স্বাধীনতার বিষয়টি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়? আমরা স্বপ্ন দেখেছিলাম যে স্বাধীনতার, সেটি ছিল সবার। এর মধ্যে একটি সংবিধানও প্রণীত হয়েছিল, যদিও তাতে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাংবিধানিক অধিকার স্বীকৃত হয়নি। কালক্রমে তা হয়তো যুক্ত হতো, কিন্তু সামরিক শাসন এসে তাকে একটি যুদ্ধাবস্থায় নিয়ে গেল। দীর্ঘদিন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর একটি অংশের সঙ্গে যুদ্ধ চলেছে। সংকট এখনো কাটেনি।
রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার প্রশ্নটি আজও অমীমাংসিত আছে। পৃথিবীর শক্তিশালী রাষ্ট্রও এখন প্রকাশ্যে অন্য রাষ্ট্রের ওপর জোর করে, প্রভাব খাটায়। অপেক্ষাকৃত দুর্বল রাষ্ট্রের সম্পদের ওপর কর্তৃত্ব খাটায়। এসব মিলিয়েই আমরা প্রিয় শব্দ স্বাধীনতার যে অর্থ খুঁজেছি, তা আজও নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। স্বাধীনতার সংগ্রাম চলবেই।
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব