বাঙালি খুবই অনুভূতিপ্রবণ জাতি। সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারকদের এই সত্য অনুধাবন করতে হবে। বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব শহীদুল হক বৃহস্পতিবার একটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ–ভারতের সম্পর্কের গতিপ্রকৃতি নিয়ে এই মন্তব্য করেন।
ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের সাবেক হাইকমিশনার পিনাকরঞ্জন চক্রবর্তী ওই বইয়ের লেখক। ‘ট্রান্সফর্মেশন: ইমার্জেন্স অব বাংলাদেশ অ্যান্ড ইভোলিউশন অব ইন্ডিয়া–বাংলাদেশ টাইজ’ নামের ওই বইয়ের একটি লাইন উদ্ধৃত করে শহীদুল হক বলেন, তিনিও গভীরভাবে বিশ্বাস করেন বাংলাদেশ ও ভারতের নিয়তি একসূত্রে গাঁথা। এই সম্পর্ক অনন্তকালের। চিরায়ত বন্ধুত্বের। তিনি বলেন, এই সম্পর্ক যে নিছক কৌশলগত নয়, তার ঊর্ধ্বে, সে কথা ২০১৫ সালে দুই দেশের যৌথ বিবৃতিতে স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এখন বাস্তবেও তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে।
দিল্লির ‘থিঙ্ক ট্যাংক’ অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনে (ওআরএফ) বৃহস্পতিবার বিকেলে ওই বইয়ের মোড়ক উন্মোচন উপলক্ষে এক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানে দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বিভিন্ন দিক, সাম্প্রতিককালে ‘ইন্ডিয়া আউট’ আন্দোলনের অন্তর্গত ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক, বিএনপির নির্বাচন বর্জন, জামায়াতে ইসলামীর প্রভাব কিংবা তিস্তার মতো নিষ্পত্তিহীন বিষয় নিয়ে বিভিন্ন বক্তা তাদের মনোভাব জানান। ভোট নিয়ে আলোচনায় চলে আসে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার প্রসঙ্গও।
বাংলাদেশের নির্বাচনের সময় যুক্তরাষ্ট্রের অতিসক্রিয়তা প্রসঙ্গে পিনাকরঞ্জন বলেন, ভারত সে সময় পরিস্থিতির যে বিশ্লেষণ করেছিল, তা মানতে যুক্তরাষ্ট্র শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়। সেই বোধোদয়ের কারণে সে সময় ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাসকে নিঃসাড়ে চলে যেতে হয়েছিল। যিনি বিএনপি নেতাদের সঙ্গে সারাক্ষণ গা ঘেঁষাঘেঁষি করছিলেন, ভোটের সময় তাকে কোথাও দেখা গেল না!
পিনাকরঞ্জন বলেন, কোনো দল নিজে থেকে ভোটে অংশ না নিলে তার দায় বিজয়ী দলের ওপর বর্তায় না। বিজয়ী দলকে সে জন্য দোষারোপ করাও ঠিক নয়। পিনাকরঞ্জন এ প্রসঙ্গে ভারতের প্রসঙ্গও টেনে আনেন। তিনি বলেন, ভারতেও নির্বাচন ঘিরে অভিযোগ শোনা যায়। যারা জানেন ভোটে হার অনিবার্য, তারা আগে থেকেই ইভিএমের কারচুপি নিয়ে সরব হন। কোনো দেশেই অজুহাতের অভাব নেই।
আলোচনা সভায় ভারতীয় পণ্য বর্জন প্রসঙ্গের অবতারণা করেন ওআরএফ কলকাতা শাখার পরিচালক অনসূয়া বসু রায় চৌধুরী। তিনি বলেন, এই প্রচারণা চলছে প্রধানত সামাজিক মাধ্যমে। জনভিত্তিহীন কিছু মানুষ এভাবে ভারতবিরোধী মানসিকতায় উসকানি দিতে চাইছেন। অনসূয়া এ প্রসঙ্গে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই বিষয়টি স্পষ্ট করে দিয়েছেন। তাদের স্বরূপ প্রকাশ করে বুঝিয়ে দিয়েছেন, এর কোনো জনভিত্তিই নেই। অতএব এ নিয়ে দুশ্চিন্তারও কোনো কারণ নেই। সম্পর্কের ধারাবাহিকতা রক্ষার ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর কড়া মন্তব্য বলিষ্ঠ পদক্ষেপ বলে অনসূয়া মনে করেন। তার মতে, রোজা উপলক্ষে পেঁয়াজ রপ্তানিতে ছাড় দেওয়া ভালো কূটনীতি।
আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্র ও জামায়াতে ইসলামী সম্পর্কও উঠে আসে। প্রবীণ কূটনীতিক ও ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের সাবেক হাইকমিশনার বীণা সিক্রি এ বিষয়ে বলেন, জামায়াতকে যুক্তরাষ্ট্র মনে করে তারা মধ্যপন্থী ইসলামপন্থী দল। তারা মানতেই চায় না যে, ওরা উগ্রপন্থী। এই ভুল ধারণার জন্য জামায়াত ও তার সঙ্গী বিএনপি যুক্তরাষ্ট্রের প্রশ্রয় পেয়ে চলেছে।
এই মনোভাবের সঙ্গে পিনাকরঞ্জন অবশ্য সহমত নন। তিনি মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রও জানে জামায়াতের চরিত্র কী। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে আওয়ামী লীগকে যুক্তরাষ্ট্র মেনে নিতে পারেনি। সারাক্ষণ একটি বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব তাদের ছিল। তার রেশ এখনো কাটেনি। তাই তারা আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষদের এখনো সাহায্য করে চলেছে। মদদ দিচ্ছে।
দুই দেশের মধ্যে নিষ্পত্তিহীন বিষয়গুলোর মধ্যে অন্যতম তিস্তা। সেই প্রসঙ্গে বীণা বলেন, পানি না থাকলে চুক্তি অর্থহীন। চুক্তি করার আগে তাই পানির জোগান কতটা, সে বিষয়ে নিশ্চিন্ত হওয়া দরকার। তার পরামর্শ, তা নিশ্চিত করার জন্য তিস্তার উৎসস্থল থেকে দুই দেশের উচিত সমীক্ষা করা।