ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ একটি নির্বুদ্ধিতা

সম্পাদকীয়

বুয়েট
ফাইল ছবি

ছাত্ররাজনীতি বাংলাদেশের শেকড়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এটিকে একটি সামাজিক আন্দোলনও বলা যেতে পারে। ১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশ দুই ভাগে (ভারত ও পাকিস্তান) বিভক্ত হওয়ার পর ১৯৪৮ সালে প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের গোড়াপত্তন ঘটে। তখন থেকে সংগঠনের ছাত্ররা বিভিন্ন ধরনের সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন রচনা করেন। সেসময় তারা বাঙালির ভাষা ও তার সংস্কৃতিকে রক্ষা করার বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে এবং সেখান থেকেই ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। সেই সূত্র ধরে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের উন্মেষ ঘটে।

মানবেতিহাসে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ক্ষেত্রে পৃথিবীর কম সংখ্যক দেশেই ছাত্ররা রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হলো বাংলাদেশ। কেননা বাংলাদেশের প্রতিটি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে ছাত্ররা অগ্রভাগে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। বিশেষ করে ছাত্রলীগের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। এটি ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীনতম ছাত্রসংগঠনের একটি। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক সরকার নির্বাচন, ১৯৫৮ সালের স্বৈরশাসক আয়ুব বিরোধী আন্দোলন, ৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬’র ছয় দফা, ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান, ৭০’র জাতীয় নির্বাচন এবং ৭১’র মহান মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রনেতারাই নেতৃত্বের অগ্রভাগে ছিল। সুতরাং আমরা বলতেই পারি, ছাত্ররাজনীতি বাংলাদেশে সবসময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

এমনকি পঁচাত্তর সালে রাষ্ট্রপিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর দেশে যখন স্বৈরশাসন জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসে এবং বাংলাদেশ বিরোধী অপশক্তি তথা উগ্র মৌলবাদের উত্থান ঘটে, তখন ছাত্রসংগঠনগুলোই এসবের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তুলেন।

কাজেই আমরা মনে করি, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ছাত্ররাজনীতি অফিশিয়ালি কোথাও বন্ধ করার যৌক্তিকতা নেই। এটি একটি নির্বুদ্ধিতা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এধরনের প্রাকটিস চালু হলে নিঃস্বার্থ কোনো আন্দোলন গড়ে উঠার সুযোগ থাকবে না। কেননা ছাত্ররাই মূলতঃ নিঃস্বার্থ আন্দোলন অগ্রভাগে থাকে। তাদের মধ্যে ক্ষমতা দখলের কোনো প্রবণতা থাকে না। তারা যে কাজটি করে, সেটি দেশপ্রেম নিয়ে করে। তবে এটা ঠিক যে, বর্তমান ছাত্ররাজনীতিতে অনেক সুবিধাবাদী শ্রেণি প্রবেশ করেছে। কিন্তু তারপরও বৃহৎ একটি অংশ নিঃস্বার্থভাবে দেশের জন্য কাজ করে।

আমাদের মনে আছে, ২০১৯ সালে একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র আবরার ফাহাদ নিহত হওয়ার পর সেখানে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়। যদিও অভিযোগ রয়েছে, ছাত্রশিবির যথারীতি তাদের নিয়মমাফিক গোপন সাংগঠনিক তৎপরতা অব্যাহত রেখেছিল। গত বুধবার মধ্যরাতে বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রবেশ করলে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে পড়ে। সাধারণ শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করেছেন, পরীক্ষাও বর্জন করেছেন। অভিযোগ রয়েছে সাধারণ শিক্ষার্থীর ব্যানারে এই বিক্ষোভের নেতৃত্ব দিচ্ছে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির। ওদিকে ছাত্রলীগ ক্যাম্পাসে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি চালুর দাবি জানিয়েছে। এমতাবস্থায় মহামান্য হাইকোর্ট বুয়েটে নিয়মতান্ত্রিক ছাত্ররাজনীতি চালুর পক্ষে আদেশ দিয়েছেন। আমরা এই রায়কে স্বাগত জানাই। আমরা আশা করব বুয়েট প্রশাসন এই ঐতিহাসিক রায় বাস্তবায়নে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

শেয়ার করুন