‘শেষ পর্যন্ত আমরা শ্বাস নিতে পারছি,’ সেনেগালের রাজধানী ডাকারে আমেরিকান ফুড স্টোর সুপারমার্কেটের হিসাবরক্ষক একটি দইয়ের পাত্র সরাতে সরাতে কথাটি বললেন। গত ২৪ মার্চ সেনেগালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের তিন দিনের মাথায় একথা বলেন তিনি। ততোক্ষণে দেশটির প্রদেশগুলোর ভোটের ফল ঘোষণা করা হয়েছে। তাতে অনেকটা স্পষ্ট যে, দৃশ্যপট বদলে যাচ্ছে। নির্বাচনে জয়ী হতে চলেছেন বিরোধী প্রার্থী বাসিরু দিওমায়ে ফায়ে।
একটি বড় সময়ের রাজনৈতিক অস্থিরতা পেরিয়ে মঙ্গলবার সেনেগালের নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন ৪৪ বছর বয়সী ফায়ে। বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ম্যাকি সল ১২ বছর ধরে দেশটির ক্ষমতায় ছিলেন। তিনি তাঁর শাসনকাল তৃতীয় মেয়াদে টেনে নিতে চেষ্টা করবেন এমন শঙ্কার অবসান ঘটে ফায়ের শপথগ্রহণের মধ্য দিয়ে।
কয়েক মাস ধরে অনিশ্চয়তায় কেটেছে সেনেগালবাসীর। তবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ও গেল সপ্তাহে তাতে তরুণ ও প্রতিষ্ঠানবিরোধী প্রার্থী, যিনি ২০ দিন আগেও কারাগারে ছিলেন, তাঁর বিজয় দেশবাসীর মধ্যে স্বস্তির অনুভূতি এনেছে যে, পরিবর্তন ঘটছে।
বিদ্যমান ব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনরায়
নির্বাচনের দিন ভোটারেরা ভোর হতে না হতেই কেন্দ্রগুলোতে আসতে থাকেন। তখনও ভোট শুরু হওয়ার কয়েক ঘণ্টা বাকি ছিল।
ভোটকেন্দ্রগুলোর একটি ডাকারের নাফিসাটু নিয়াং ইলিমেন্টারি স্কুলের খেলার মাঠে দেখা যায় ভোটারদের দীর্ঘ সারি। প্রবীণেরা প্যান্ট–শার্ট পরে হাতে পত্রিকা নিয়ে এবং টি–শার্ট পরা তরুণদের নীরবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।
তাঁদের একজন ৩৭ বছর বয়সী জুলিয়া সাগনা বলেন, ক্ষমতাসীনদের রুখে দেওয়ার জন্য তিনি তাঁর ভোটাধিকার প্রয়োগে বদ্ধপরিকর।
ধূসর রঙের স্যুট পরা জুলিয়া ভোটারদের সারিতে দাঁড়িয়ে কিছুটা স্নায়ুচাপে ভুগছিলেন। কারণ এর আগে কখনো ভোট দেননি তিনি। জুলিয়া বলেন, ভোট দেওয়াটা যে গুরুত্বপূর্ণ তা এর আগে এতটা বোঝেননি তিনি। ‘এবার তরুণ ভোটারেরা বিদ্যমান ব্যবস্থার বিপক্ষে ভোট দেবেন, এ বিষয়ে তিনি নিশ্চিত,’ বলেছিলেন জুলিয়া সাগনা।
হাসিমুখে ভোটকেন্দ্র থেকে বেরিয়ে রঙ লাগানো আঙুল তুলে ধরেন জুলিয়া। তিনি যে ভোট দিয়েছেন, সেটা বোঝানোর জন্য এটা করেছিলেন। ভোট দিতে পারায় তিনি ভাগ্যবতী বলেও উল্লেখ করেন।
সেনেগালে এই নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল গত ফেব্রুয়ারিতে। কিন্তু নির্বাচনী প্রচার শুরু হওয়ার কয়েক দিন আগে প্রেসিডেন্ট সল দেশটির ইতিহাসে প্রথমবারের মতো নির্বাচন স্থগিত করেন। দুর্নীতিবাজদেরও প্রার্থীর তালিকায় রাখার অভিযোগ তুলে ওই পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তিনি। সমালোচকেরা এটাকে দেখেন, তাঁর ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টা হিসেবে।
পরে সেনেগালের সাংবিধানিক পরিষদ প্রেসিডেন্টের ওই সিদ্ধান্ত বাতিল করে ২ এপ্রিলে তাঁর সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে নতুন নির্বাচন আয়োজনের নির্দেশ দেয়। ২৪ মার্চের নির্বাচনে সেনেগালের ৭০ লাখ বাসিন্দার ৬৬ শতাংশ ভোটকেন্দ্রে গিয়ে তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন।
গ্রেপ্তারের পর মুক্তি
নির্বাচনের দিন ডাকারের একটি ভোটকেন্দ্রে ছিল বিপুল সংখ্যক মানুষের ভিড়। তাঁদের কেউ এসেছেন ন্যায়বিচারের জন্য, কেউ নিতে চান প্রতিশোধ।
শেষের কয়েক বছরে রাজনৈতিক টালমাটাল অবস্থা প্রেসিডেন্ট সলের ১২ বছরের শাসনকালকে মলিন করে দিয়েছে। ২০২০ সালে করোনা মহামারির সময় যেসব বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছিল, সেগুলো সেনেগালের অর্থনীতি ও মানুষের জীবনমানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল। আর পরের বছর বিরোধী দলীয় নেতা ওউসমানে সোনকোকে গ্রেপ্তারের চেষ্টার জেরে সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।
এসবের পরিপ্রেক্ষিতে সেনেগালে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। সংঘাত প্রাণঘাতী রূপ নেয়। সশস্ত্র ও মুখোশধারী হামলাকারীদের হাতে নিহত হন বহু মানুষ। আহত হন শত শত। সেনেগালের বিরোধী দল ও নাগরিক সমাজ মনে করে, ওই হামলাকারীদের পেছনে ছিল ক্ষমতাসীন দল।
২০২১ সালের মার্চ থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সেনেগালে হাজার হাজার মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়। বাসিরু দিওমায়ে ফায়েও ছিলেন তাঁদের মধ্যে। প্রতিবাদ জানাতে ফেসবুককে বেছে নেন সাবেক এই কর পরিদর্শক। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এক ফেসবুক পোস্টে তিনি অভিযোগ করে বলেন, ম্যাজিস্ট্রেটরা সরকারের হয়ে কাজ করছেন, আর প্রকৃত অপরাধগুলো এড়িয়ে যাচ্ছেন।
তবে ফায়ের ওই পোস্টগুলো রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য হুমকি বলে মনে করেছিল সেনেগাল কর্তৃপক্ষ। সে বছরের এপ্রিলে তাঁকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়। ১১ মাস কারাগারে থাকার পর গত মাসে নির্বাচনের ঠিক আগে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়।
গ্রেপ্তারের সময় ফায়ে কাজ করছিলেন ওউসমানে সোনকোর পক্ষে। তিনিও একজন কর পরিদর্শক। সেনেগালের করসংক্রান্ত কার্যালয়ের কর্মীদের ইউনিয়নের নেতৃত্বে ছিলেন এই দুজন। কর বিভাগের অন্যায় ও বৈষম্য নিয়ে ক্ষুব্ধ ছিলেন এই কর্মীরা।
২০১৪ সালে সোনকো পিএএসটিইএফ নামে একটি রাজনৈতিক দল গড়ে তোলেন। সরকারের মধ্য পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নজর কেড়েছিল এই দলটি। উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অর্থ লোপাট এবং অপরাধ করেও দায়মুক্তির বিষয়গুলো দেখে একেবারেই হতাশ হয়ে পড়েছিলেন তাঁরা। নিজেদের ক্ষমতাহীনও মনে করতেন।
২০১৪ সালেই সেনেগালে প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুত আবিষ্কার হয়। এরপর দেশটির তেল ও গ্যাস খাতের বিভিন্ন চুক্তিতে দুর্নীতির নিন্দা জানিয়ে জনপ্রিয়তা কুড়ান সোনকো। ২০২৩ সালে তাঁকে বেশ কয়েকটি অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। কিছু সময় পরই তাঁর দলকে নিষিদ্ধ করে সরকার।
২০১৮ সালে সোনকোর সাক্ষাৎকার নেয় সংবাদমাধ্যম আল–জাজিরা। তখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়ন্ত্রণে নতুন এক আইন জারি করেছিল সরকার। সোনকো ওই আইনের তীব্র সমালোচনা করেন। তবে তিনি হয়তো জানতেন না, পাঁচ বছর পরে সেই আইন–ই সেনেগালের ভবিষ্যৎ প্রেসিডেন্ট ফায়েকে গ্রেপ্তারে ব্যবহার করা হবে।
চলতি বছরের মার্চে নির্বাচনের ১৮ দিন আগে একটি দায়মুক্তি আইনের বিলে অনুমোদন দেন প্রেসিডেন্ট সল। ২০২১ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সেনেগালে রাজনৈতিক সহিংসতার সময় অপরাধে জড়িত সবাইকে ক্ষমা ও মুক্তি দেওয়ার জন্য ওই বিল পার্লামেন্টে তোলা হয়েছিল।
ওই আইনের সমালোচনা করেছে বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা। তাঁদের ভাষ্য, বিক্ষোভের সময় পুলিশের নৃশংসতা এবং বিক্ষোভকারীদের হত্যার পেছনে নিরাপত্তা বাহিনীর যেসব সদস্য ও ভাড়াটে লোকজন ছিলেন, তাঁদের সুরক্ষা দিতেই ওই আইন করা হয়েছিল।
তবে ওই আইনের কারণেই অবশ্য সুফল পেয়েছিলেন সোনকো ও ফায়ে। অন্যদের সঙ্গে তাঁরাও মুক্তি পেয়েছিলেন। আর নির্বাচনের দুই সপ্তাহের কম সময় আগে কারাগার থেকে ছাড়া পেয়েও ফায়ে নির্বাচনী প্রচার–প্রচারণা চালিয়েছেন এবং জয় নিজের পক্ষে এনেছেন।