ঢাকার বায়ু দিনে দিনে খারাপ হয়ে যাচ্ছে। ভোরের স্নিগ্ধতায় নির্মল বায়ু হারিয়ে যাচ্ছে। ঢাকা নগরীর আবহাওয়া দূষিত হলে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য নিরাপদ নগরী রেখে যাওয়াটা দুরূহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। ইদানীং বায়ুদূষণের আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের কাছে আমাদের এই সমস্যা দৃশ্যমান হচ্ছে। গত ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি থেকে বায়ুদূষণ খারাপের দিকেই যাচ্ছে। ২২ মার্চ, ২০২৪ তারিখে বায়ুদূষণে ঢাকার অবস্থান ছিল শীর্ষে। ঐ দিন ১৯৩ স্কোর নিয়ে বিশ্বের ১২০ দেশের মধ্যে ঢাকার অবস্থান প্রথম স্থান ছিল। ২০২৩ সালে বিশ্বে বায়ুদূষণ পরিস্থিতি নিয়ে সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন দিয়েছে আই-কিউ এয়ার। এতে উঠে এসেছে, বায়ুদূষণে গত বছর শীর্ষে ছিল বাংলাদেশ। রাজধানী শহর হিসেবে ঢাকার স্থান ছিল বিশ্বে দ্বিতীয়।
সুইজারল্যান্ডভিত্তিক আই-কিউ এয়ারের ওয়েবসাইট থেকে এ তথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে। ওদের মানদণ্ড অনুযায়ী স্কোর ১৫১ থেকে ২০০ থাকলে তা অস্বাস্থ্যকর বায়ু। আই-কিউ এয়ারের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার বাতাসে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা (পিএম ২.৫) দূষণের প্রধান উত্স। গত কয়েক দিনে ঢাকার বাতাসে যতটা এই বস্তুকণা ছিল, তা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মানদণ্ডের চেয়ে ১৮ থেকে ১৯ গুণের বেশি!
এমনটি হওয়ার বহুবিধ কারণও আছে। দিনে দিনে জনবসতি বাড়ছে। বাস্তবে ২ কোটির বেশি মানুষের আবাসস্থল ঢাকা। পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহরগুলোর মধ্যে ঢাকার অবস্থানও প্রথম দিকেই। পরিবেশবিদেরা বলেছেন, যেখানে অন্য দেশগুলো তাদের বড় শহরগুলোর বায়ুদূষণ রোধে পদক্ষেপ নিয়ে চলছে, সেখানে ঢাকা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হবে কেন? পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, চার কারণে এই পরিস্থিতির মুখামুখি হচ্ছেন রাজধানীবাসী।
প্রথমত পুরোনো গাড়ির আধিক্য, লক্কড়ঝক্কড় বাস রাজধানীর সড়কে হরহামেশাই দেখা যায়। এগুলোর নির্গত বিষাক্ত ধোঁয়া পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করছে। ভালো খবর হচ্ছে, সম্প্রতি পরিবেশমন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী জানিয়েছেন, রাজধানী ঢাকার বায়ুদূষণ রোধে ২০ বছরের পুরোনো বাসের তালিকা তৈরির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ৮ এপ্রিলের মধ্যে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) তালিকা তৈরি করে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ে পাঠাবে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) ৮ এপ্রিলের মধ্যে ঢাকা শহরে চলাচলকারী ঐ বয়সি বাসের তালিকা পাঠাবে। এটা বাস্তবায়িত হলে ঢাকা শহরের বায়ুর মান কিছুুটা ভালো হতে পারে।
দ্বিতীয়ত, অপরিকল্পিতভাবে শহরের যেখানে-সেখানে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ও উন্নয়নকাজ শুরু হলে যেন শিগিগর শেষ হওয়ার নয়। যার ফলে পরিবেশ কর্দমাক্ত ধুলোবালুতে একাকার হয়ে যাচ্ছে। তৃতীয়ত, শহরের আশপাশে ইটভাটা ও শিল্পকারখানার দূষণ এবং চতুর্থত, শহরের ভেতরে যে আবর্জনা জমে, তা পোড়ানো ধোঁয়া।
দূষণে ঢাকার বর্জ্যও বা কম কীসে? বর্জ্য ব্যবস্থাপনাই আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা। ভয়াবহ খবর হলো, বায়ুদূষণের কারণে মানুষ দিনে দিনে অসুস্থ হচ্ছে। হাঁপানি, ব্রংকাইটিস এমনকি ফুসফুসে ক্যানসারসহ নানা রকম মরণব্যধিতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। এছাড়া নিঃশ্বাসের সঙ্গে ক্ষতিকর ধাতব পদার্থ শরীরে প্রবেশ করায় স্নায়ুজনিত অসুখে মস্তিষ্কের রোগ এবং হূদরোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাও বাড়ছে আশঙ্কাজনকভাবে। বেশি উদ্বিগ্নের কারণ শিশুরা। এরা আক্রান্ত হচ্ছে রোগব্যাধিতে। এটা ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে, যা আমাদের ভবিষ্যত্ প্রজন্মের জন্য আতঙ্কের খবর।
সরকারকে এখনই ভাবতে হবে, জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভর পরিবহন কমিয়ে পরিবেশবান্ধব বৈদ্যুতিক যানকে উত্সাহিত করতে। সরকার তা শুরু করেছে। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে পরিবর্তন আসবে বলা হচ্ছে। তাছাড়া নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিশ্চিত করতে হবে। ব্যক্তিগতভাবে বসতবাড়ি ও কর্মস্থলের বর্জ্য নির্ধারিত স্থানে এবং সঠিকভাবে নিষ্কাশন করতে হবে।
ঢাকার আশপাশের এলাকাগুলোতে রয়েছে ১ হাজারের বেশি দূষণকারী ইটভাটা। এতে ঢাকা ও এর আশপাশের পরিবেশ মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে। ঢাকার বায়ুদূষণের জন্য ইটভাটা প্রায় ৫৮ শতাংশ দায়ী। ইটভাটার ধোঁয়ায় গত ১৫ বছরে ঢাকার বাতাসে দূষণের মাত্রা বেড়েছে ৯০ শতাংশ। রাজধানীর বায়ুদূষণ বন্ধে দুই দফায় বিশ্বব্যাংক প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। মাঝে মাঝে রাস্তায় গাড়ি দিয়ে পানি ছিটানো ছাড়া কোনো কাজ দেখা যাচ্ছে না।
আশার কথা হলো, বর্তমানে বন ও পরিবেশমন্ত্রী দায়িত্ব নেওয়ার পর ১০০ দিনের কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন। কর্মসূচির আওতাধীন পরিকল্পনায় আছে, বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে ঢাকার চারপাশের সব ইটভাটা বন্ধের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। আগামী তিন মাসের মধ্যে কার্যকর হবে। এতে প্রায় অবৈধ ৫০০ ইটভাটা গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে। এছাড়া খোলা ট্রাকে করে নির্মাণসামগ্রী (বালু, সিমেন্ট ও অন্যান্য) বহনেও জরিমানা বাড়ছে। মন্ত্রী মহোদয় আরেকটি বিষয় তার কর্মসূচিতে উল্লেখ করেছেন। বায়ুদূষণ যখন খারাপ পর্যায় চলে যায়, তখন একটি অ্যালাট ইস্যু করা হবে। গাড়ির ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব বিআরটিএর। যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য পরিবেশ মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে। কিন্তু পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বের বাইরে জনসাধারণের সচেতনতাবোধের প্রয়োজন আছে। ব্যক্তি উদ্যোগে প্রত্যেকে বাসার আশপাশে ময়লা-আবর্জনা না ফেলি। নিজস্বার্থে আমরা যেন আমাদের চারপাশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখি। তাছাড়া মন্ত্রণালয়ের ১০০ দিনের কর্মসূচির অপেক্ষায় থেকে মূল্যায়ন করা যাবে, বাস্তবে বায়ুদূষণ বন্ধে কতটুকু কার্যকর পদক্ষেপ হলো। ঢাকা নগরবাসীকে বায়ুদূষণমুক্ত নগরী সৃষ্টির লক্ষ্যে সরকারকেই সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে হবে।
লেখক : সাবেক ব্যাংকার