ইসরায়েলের ভূখণ্ড লক্ষ্য করে ইরান ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। বহুদিনের বৈরিতা থাকলেও এবারই প্রথমবারের মতো সরাসরি ইসরায়েলে হামলা চালালো দেশটি।
ইরান বলছে, ইসরায়েলে হামলার আগে তারা যুক্তরাষ্ট্রসহ আশপাশের দেশগুলোকে সতর্ক করেছিল। তবে যুক্তরাষ্ট্র বলছে, ইরানের এই দাবি সত্য নয়। তারা ইসরায়েলের উল্লেখযোগ্য ক্ষতিই করতে চেয়েছিল।
সোমবার (১৫ এপ্রিল) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে বার্তাসংস্থা রয়টার্স।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তুরস্ক, জর্ডান এবং ইরাকের কর্মকর্তারা রোববার বলেছেন, ইসরায়েলে ড্রোন এবং ক্ষেপণাস্ত্র হামলার কয়েক দিন আগে তাদেরকে বিস্তৃত নোটিশ দিয়েছে ইরান। তবে মার্কিন কর্মকর্তারা বলেছেন, তেহরান ওয়াশিংটনকে সতর্ক করেনি এবং হামলায় ইসরায়েলের উল্লেখযোগ্য ক্ষতি করার লক্ষ্যেই এটি করেনি ইরান।
সিরিয়ার রাজধানীতে তেহরানের কনস্যুলেটে সাম্প্রতিক হামলার জবাবে শনিবার গভীর রাতে তিন শতাধিক ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন দিয়ে ইরান এই হামলা চালায়। যদিও বেশিরভাগ ড্রোন এবং ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলি ভূখণ্ডে পৌঁছানোর আগেই ধ্বংস করা হয়েছে বলে ইসরায়েল দাবি করেছে, তারপরও উত্তেজনার আরও বৃদ্ধি হতে পারে বলে ব্যাপক উদ্বেগ ছিল।
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির-আবদুল্লাহিয়ান রোববার বলেছেন, ইরান প্রতিবেশী দেশ এবং ইসরায়েলের মিত্র যুক্তরাষ্ট্রকে ৭২ ঘণ্টার নোটিশ দিয়ে জানিয়েছিল- তারা হামলা চালাবে।
তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, তারা হামলার আগে ওয়াশিংটন এবং তেহরান উভয়ের সাথেই কথা বলেছিল এবং হামলার পর প্রতিক্রিয়া যেন আনুপাতিক থাকে তা নিশ্চিত করার জন্য আঙ্কারা মধ্যস্থতাকারী হিসাবে একে অপরের বার্তা উভয়পক্ষের কাছে পৌঁছে দিয়েছে।
তুরস্কের একটি কূটনৈতিক সূত্র বলেছে, ‘ইরান জানিয়েছিল- দামেস্কে তার দূতাবাসে ইসরায়েলের হামলার প্রতিক্রিয়ায় এই হামলা চালানো হবে এবং তারা এর বাইরে আর কিছুই করবে না। আমরা এই হামলার সম্ভাবনার বিষয়ে অবগত ছিলাম। আর তাই ইসরায়েলে ইরানের এই হামলা আমাদের কাছে অবাক করার মতো কিছু ছিল না।’
তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসনের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির-আবদুল্লাহিয়ানের বিবৃতি অস্বীকার করে বলেছেন, ওয়াশিংটন সুইস মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে ইরানের সাথে যোগাযোগ করেছিল, কিন্তু ৭২ ঘণ্টা আগে তারা কোনও নোটিশ পায়নি।
ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘এটি একেবারেই সত্য নয়। তারা কোনও নোটিশ দেয়নি, বা তারা (হামলার বিষয়ে) কোনও ধারণাও দেয়নি … এমন কোনও ধারণা দেয়নি যে, ‘এরা লক্ষ্যবস্তু হবে, তাই তাদের সরিয়ে দিন’।’
এই কর্মকর্তা আরও বলেছেন, হামলা শুরু হওয়ার পরেই তেহরান যুক্তরাষ্ট্রকে একটি বার্তা পাঠিয়েছিল এবং তাদের উদ্দেশ্য ছিল ‘অত্যন্ত ধ্বংসাত্মক’।
মার্কিন এই কর্মকর্তা বলেছেন, ‘হামলার মধ্যেই আমরা ইরানিদের কাছ থেকে একটি বার্তা পেয়েছি, সুইসদের মাধ্যমে। সেই বার্তায় হামলা সম্পন্ন হয়েছে বলে মূলত ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছিল, তবে হামলা তখনও চলমান ছিল। সেসময় আমাদের কাছে এটিই ছিল (তাদের) বার্তা।’
অন্যদিকে ইরাকি, তুর্কি এবং জর্ডানের কর্মকর্তাদের প্রত্যেকে বলেছেন, ইরান গত সপ্তাহে কিছু বিশদ বিবরণসহ হামলার বিষয়ে প্রাথমিক সতর্কতা দিয়েছে। ড্রোন, ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র এবং ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হামলায় বড় ধরনের প্রাণহানি ঘটতে পারে এবং সংঘর্ষ বাড়তে পারে।
মার্কিন কর্মকর্তারা শুক্রবার এবং শনিবার বলেন, তারা ইরানের কাছ থেকে অল্প সময়ের মধ্যে আক্রমণের আশঙ্কা করছেন এবং সেসময় তেহরানের কাছে কঠোরভাবে বাইডেনের একমাত্র বার্তা ছিল: ‘(ইসরায়েলে হামলা) করবেন না।’
ইরাকের একজন সরকারি নিরাপত্তা উপদেষ্টা এবং একজন নিরাপত্তা কর্মকর্তাসহ দুটি ইরাকি সূত্র জানিয়েছে, ইরান হামলার অন্তত তিন দিন আগে কূটনৈতিক চ্যানেল ব্যবহার করে বাগদাদকে এ বিষয়ে জানিয়েছিল।
সেই সময়ে হামলার সঠিক সময় প্রকাশ করা হয়নি, তবে হামলার কয়েক ঘণ্টা আগে ইরাকি নিরাপত্তা ও সামরিক কর্তৃপক্ষের কাছে বার্তা পাঠানো হয়েছিল, যেন বাগদাদ তার আকাশসীমা বন্ধ করতে পারে এবং মারাত্মক দুর্ঘটনা এড়াতে পারে।
ইরাকি নিরাপত্তা কর্মকর্তা বলেন, ‘সরকার ইরানি কর্মকর্তাদের কাছ থেকে স্পষ্টভাবে বুঝতে পেরেছিল, ইরাকে মার্কিন সামরিক বাহিনীও হামলার বিষয়ে আগে থেকেই অবগত ছিল।’
জর্ডানের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেছেন, ইসরায়েলে সম্ভাব্য হামলা চালানোর উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানাতে ইরান গত বুধবার তেহরানে অবস্থানরত আরব রাষ্ট্রদূতদের তলব করেছিল। যদিও সেসময় ইরান হামলার সময় সম্পর্কে নির্দিষ্ট করে কিছু জানায়নি।
ইসরায়েলে হামলার সময় ইরান ঠিক কোন অবকাঠামোকে লক্ষ্যবস্তু করবে এবং কোন ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করা হবে সে সম্পর্কে বিশদ বিবরণ দিয়েছে কিনা জানতে চাইলে, জর্ডানের ওই সূত্রটি সরাসরি উত্তর দেননি। তবে তিনি ইঙ্গিত দেন, সেখানে বিষয়বস্তু এটিই ছিল।
অন্যদিকে একটি ইরানি সূত্র বলেছে, কাতার, তুরস্ক এবং সুইজারল্যান্ডের কূটনৈতিক চ্যানেলের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রকে হামলার নির্ধারিত দিন সম্পর্কে অবহিত করেছিল ইরান। সূত্রটি আরও বলেছে, হামলাটি এমনভাবে পরিচালিত হবে যাতে প্রতিক্রিয়া উসকে দেওয়া না হয়।
অবশ্য ইরানের হামলার পর উত্তেজনার বৃদ্ধি কতটা এড়ানো যাচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। প্রেসিডেন্ট বাইডেন ইসরায়েলকে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি প্রতিশোধমূলক হামলায় যোগ দেবে না।
যাইহোক, ইসরায়েল এখনও ইরানি হামলার বিষয়ে তার প্রতিক্রিয়া ঠিক কী হবে তা পরিমাপ করছে। তবে ইসরায়েলের যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভার সদস্য বেনি গ্যান্টজ বলেছেন, যখন উপযুক্ত সময় আসবে, তখনই ইরানের ওপর প্রতিশোধ নেবে ইসরায়েল।