সম্প্রতি ইরান এবং ইসরায়েলের মধ্যে নতুন করে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ইসরায়েলি ভূখণ্ড লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে ইরান। শনিবার মধ্যরাতে ইরানি হামলার মুখে সক্রিয় হয়ে ওঠে ইসরায়েলের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দে নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটতে হয় ইসরায়েলের বাসিন্দাদের।
মুহুর্মুহু আক্রমণ আর সেসব আক্রমণ প্রতিহত করার সময়টাতে আলোর ঝলকানি রাতের আকাশকে আলোকিত করে তুলছিল। ইসরায়েলের মিত্ররাও অবশ্য সক্রিয় ছিল। ইসরায়েলের সীমানায় প্রবেশের আগেই অনেক ড্রোন এবং ক্ষেপণাস্ত্র ভূপাতিত করা হয়েছে।
বেশ কয়েকটি দেশ শনিবার রাতের এই সামরিক তৎপরতায় সম্পৃক্ত ছিল। ইরান, ইরাক, সিরিয়া ও ইয়েমেন থেকে ছোঁড়া হয় ক্ষেপণাস্ত্র। সেগুলোকে ভূপাতিত বা প্রতিহত করেছিল ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জর্ডান। এখন পর্যন্ত সেই হামলা সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য জানা গেছে।
রোববার ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী জানায়, ইরান ইসরায়েলের দিকে তিন শতাধিক ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র রিয়ার অ্যাডমিরাল ড্যানিয়েল হ্যাগরির একটি বিবৃতি টেলিভিশনে প্রচারিত হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, ১৭০টি ড্রোন ও ৩০টি ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হামলা চালানো হয়। সেগুলোর কোনোটিই ইসরায়েলি সীমানায় প্রবেশ করতে পারেনি। একইসঙ্গে ১০০টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র দিয়েও হামলা চালানো হয়। এর মধ্যে অল্প কিছু ইসরায়েল অব্দি পৌঁছায়। অবশ্য এগুলো নিরপেক্ষভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি।
ইরান থেকে ইসরায়েলের নিকটতম দূরত্ব ১০০০ কিলোমিটার (৬২০ মাইল)। এই দূরত্ব পেরোতে ইরাক, সিরিয়া এবং লেবানন পাড়ি দিতে হয়। শনিবার রাতে ইরানের রিভল্যুশনারি গার্ডস কর্প (আইআরজিসি) ড্রোন এবং ক্ষেপণাস্ত্র হামলার কথা জানায়।
ইরাকের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা রয়টার্সকে জানিয়েছেন, তাদের আকাশসীমার ওপর দিয়ে ইসরায়েল অভিমুখে ক্ষেপণাস্ত্র উড়ে যেতে দেখা গেছে। আইআরজিসির তথ্য, ড্রোন পাঠানোর প্রায় এক ঘণ্টা পর ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালান তারা। ধীরগতির ড্রোন আর দ্রুতগতির ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র মোটামুটি কাছাকাছি সময়েই আঘাত হানে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগ বলছে, ইরান, ইরাক, সিরিয়া ও ইয়েমেন থেকে ছোঁড়া কয়েক ডজন ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোন প্রতিহত করা হয়েছে। লেবাননের ইরান-সমর্থিত হিজবুল্লাহও জানায়, গোলান হাইটসে অবস্থিত ইসরায়েলি সামরিক ঘাঁটিতে দুই দফায় রকেট হামলা চালিয়েছে তারা। সিরিয়ার কাছ থেকে মালভূমিটি দখল করে নিয়েছিল ইসরায়েল। কিন্তু তাদের কর্তৃত্বের অনুকূলে তেমন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মেলেনি।
রিয়ার অ্যাডমিরাল হ্যাগারি বলেন, ৯৯ শতাংশের কাছাকাছি আক্রমণই হয় ইসরায়েলের আকাশসীমার বাইরে অথবা সংশ্লিষ্ট দেশের অভ্যন্তরে প্রতিহত করা হয়েছে। হামলায় ব্যবহৃত ড্রোন এবং ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর গতিপথ সরলরৈখিক। আর বেশিরভাগ ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর গতিপথ ছিল ধনুকের মতো বাঁকানো। এতে নিচের দিকে নামার সময় অভিকর্ষের টানে তাদের গতি বহুগুণ বেড়ে যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, যত ড্রোন এবং ক্ষেপণাস্ত্র ইরানের পক্ষ থেকে রোববার নিক্ষেপ করা হয়েছিল মার্কিন বাহিনী তার প্রায় সবগুলোকেই নামাতে ইসরায়েলকে সহায়তা করেছে। এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ওই নজিরবিহীন হামলার আগেই যুক্তরাষ্ট্র ওই অঞ্চলে বিমান ও রণতরী মোতায়েন করে।
পরে ইউএস সেন্ট্রাল কমান্ড(সেন্টকম) একটি হালানগাদ তথ্য প্রকাশ করেছে। এতে উল্লেখ করা হয়েছে, তাদের মিত্র বাহিনীগুলো ৮০টির বেশি ড্রোন এবং ছয়টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করেছে।
এগুলোর মধ্যে একটি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের উৎক্ষেপণ যানে থাকা অবস্থায়ই ধ্বংস করা হয়। ইয়েমেনের হুথি নিয়ন্ত্রিত এলাকাটিতে আরো সাতটি ড্রোনকেও নিক্ষেপের আগেই ভূমিতে থাকা অবস্থায় ধ্বংস করে তারা।
নিরাপত্তা সূত্রের বরাত দিয়ে রয়টার্স জানায়, ওই অঞ্চলের গোপন মার্কিন ঘাঁটিগুলো থেকে গুলি করেও বেশ কিছু ইরানি ড্রোন নামায় দেশটির সেনারা। সিরিয়ার দক্ষিণাঞ্চলের জর্ডান সীমান্তবর্তী এলাকা দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল ড্রোনগুলো।
যুক্তরাজ্যের বিমানবাহিনীর টাইফুন জেটগুলোও ইরানের কিছু ড্রোনকে ভূপাতিত করেছে বলে নিশ্চিত করেছেন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক। তিনি বলেন, ইরানের আক্রমণ বিপজ্জনক এবং অপ্রয়োজনীয় বাড়াবাড়ি যার তীব্র প্রতিবাদ জানাই আমি।
জর্ডানের সঙ্গে ইসরায়েলের শান্তি চুক্তি আছে। আবার গাজায় হামাসের সঙ্গে ইসরায়েলের যুদ্ধের ঘোর বিরোধী দেশটি। তারাও নিজেদের নাগরিকদের নিরাপত্তাকে কারণ হিসেবে দেখিয়ে তাদের আকাশসীমা ব্যবহার করা কিছু ড্রোনকে প্রতিহত করেছে।
ফ্রান্স আকাশে টহল জারি রাখতে সহায়তা করেছে। তবে তারা কোনো ড্রোন বা ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত করছে কিনা সেটা পরিষ্কার নয় বলে জানিয়েছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী।
ইসরায়েলের আয়রন ডোম ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার তৎপরতাও চোখে পড়েছে। আয়রন ডোম ব্যবস্থাটি রাডার ব্যবহার করে রকেট শনাক্ত করতে সক্ষম। আগত রকেটের মধ্যে কোনগুলো নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে আঘাত করবে আর কোনগুলো করবে না সেটাও আলাদা করতে পারে এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা।
যেসব রকেট জনবসতিপূর্ণ এলাকায় আঘাত হানবে বলে প্রতীয়মান হয় সেগুলোকে ঠেকাতে পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয় আয়রন ডোম থেকে। অল্প কয়েকটি ব্যালিস্টিক মিসাইল আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেদ করে যেতে সক্ষম হয় এবং ইসরায়েলি ভূখণ্ডে আঘাত হানে বলে জানান রিয়ার অ্যাডমিরাল হ্যাগরি।
এগুলোর মধ্যে একটি ইসরায়েলে দক্ষিণাঞ্চলের নেগেভ মরুভূমিতে অবস্থিত নোটাম বিমান ঘাঁটিতে মৃদু আঘাত করেছে। হ্যাগারি জানান, ওই ঘাঁটির কার্যক্রম এখনো চলমান রয়েছে।
পাঁচটি ব্যালিস্টিক মিসাইল আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ফাঁকি দিতে সমর্থ হয় এবং ইসরায়েলের মাটিতে গিয়ে পড়ে। দু’জন মার্কিন কর্মকর্তা এ তথ্য জানিয়েছেন। কর্মকর্তাদের ধারণা, ইরানের মূল লক্ষ্য ছিল নোটাম সামরিক ঘাঁটি, যেখানে ইসরায়েলের এফ-৩৫ যুদ্ধ বিমানগুলোর অবস্থান। প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে আসা পাঁচটি মিসাইলের চারটিই এখানে হামলে পড়ে।
এর মধ্যে একটি মিসাইল রানওয়েতে আঘাত হানে। আরেকটি গিয়ে পড়ে ফাঁকা এয়ারক্র্যাফট হ্যাঙ্গারে। আরেকটির আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় একটি পরিত্যক্ত হ্যাঙ্গার। পঞ্চম একটি মিসাইল ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলের একটি রাডার নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের উদ্দেশে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। যদিও সেটি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়।
কর্মকর্তাদের একজন বলেন, ইরানের ছোঁড়া ১২০টি ব্যালিস্টিক মিসাইলের অর্ধেকই নিক্ষেপের সময় ব্যর্থ হয়েছে কিংবা মাঝপথে বিধ্বস্ত হয়েছে। ইরানের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা আইআরএনএ বলছে, বিমানঘাঁটিতে বড় ধরনের আঘাত হেনেছে এই হামলা।
বিস্ফোরণের ফলে ধারালো বস্তুর আঘাতে সাত বছরের এক শিশু আহত হয়েছে বলে জানিয়েছেন রিয়ার অ্যাডমিরাল হ্যাগরি। একটি ইরানি ড্রোনকে প্রতিহত করার সময় এ দুর্ঘটনা ঘটে বলে জানান তিনি। দক্ষিণাঞ্চলের আরাদ শহরের আরব বেদুইন সম্প্রদায়ের ওই শিশুটিকে বর্তমানে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে।
জর্ডানের সীমানার মধ্যেও কিছু ধারালো বস্তু পড়েছে বলে জানিয়েছে দেশটির কর্তৃপক্ষ। যদিও তাতে, উল্লেখ করার মতো কোনো ক্ষতি বা কোনো নাগরিক আহত হননি।