ভারতের লোকসভা নির্বাচন শুরু না হতেই ক্ষমতাসীন বিজেপির বেশি আসনে জয়লাভের বিষয়টি মোটামুটি স্পষ্ট হয়ে গেছে। ফলে ভোট নিয়ে সে দেশের ভোটারদের উৎসাহে ভাটা পড়েছে। সাত পর্বের লোকসভা নির্বাচনের প্রথম ধাপের (১৯ এপ্রিল) ভোট গ্রহণের পরিসংখ্যানে ভোটারদের আগ্রহের চিত্র উঠে এসেছে।
লোকসভা নির্বাচন নিয়ে রোববার ঢাকায় আয়োজিত এক সেমিনারে বিশেষজ্ঞরা এমন মন্তব্য করেন। তাদের মতে, নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি (ভারতীয় জনতা পার্টি) টানা তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসতে যাচ্ছে। বৈশ্বিক শক্তি হিসেবে ভারতের অবস্থান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিজেপি পররাষ্ট্রনীতির বিষয়টি এবার নির্বাচনী ইশতেহারে পরিষ্কারভাবে তুলে ধরেছে। বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারেও জোর দিচ্ছে ভারত।
বেসরকারি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব পলিসি অ্যান্ড গভর্ন্যান্স (এসআইপিজি) ‘ভারতের সাধারণ নির্বাচন ২০২৪: ভোটের ধরন ও কূটনীতির পথ’ শীর্ষক এই আলোচনা সভার আয়োজন করে।
এসআইপিজির পরিচালক অধ্যাপক শেখ তৌফিক এম হকের সঞ্চালনায় সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবদুর রব খান। প্রায় দুই ঘণ্টার সেমিনারে ভারতের দুজন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশের দুজন বিশেষজ্ঞ প্যানেল আলোচক ছিলেন। পরে প্রশ্নোত্তর ও মুক্ত আলোচনা পর্ব ছিল।
দিল্লিভিত্তিক সামাজিক ও মানবিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অব ডেভেলপিং সোসাইটিজের (সিএসডিএস) লোকনীতির সহপরিচালক অধ্যাপক সঞ্জয় কুমার বিজেপির উত্থান ও চলমান লোকসভা নির্বাচন নিয়ে তার বিশ্লেষণ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ভারতের জনগণের বড় অংশের কাছেই নির্বাচনের ফল এরই মধ্যে জানা হয়ে গেছে। বিজেপি এবারের লোকসভা নির্বাচনে আরও বেশি আসনে জয় পাবে। এবারের নির্বাচনে বিরোধীদের সঙ্গে বিজেপির ব্যবধান ২০১৪ ও ২০১৯ সালের নির্বাচনের চেয়ে বেশি হবে। আর ভারতের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলে বিজেপির প্রভাব কমবে না; বরং বাড়বে।
এবারের নির্বাচনে বিজেপির ভালো করার পেছনে অন্যান্য অনেক কারণের পাশাপাশি শরিকদের কলেবর বাড়ানোকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন সঞ্জয় কুমার। তার মতে, গত কয়েক মাসে বিহার, উত্তর প্রদেশ, মহারাষ্ট্র ও অন্ধ্রে জোটের শরিক বাড়িয়ে নিয়েছে বিজেপি। এটা করতে না পারলে বিজেপি হয়তো বেকায়দায় পড়ত।
দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউথ এশিয়ান স্টাডিজের অধ্যাপক সঞ্জয় ভরদ্বাজ বলেন, অতীতে ভারতের পররাষ্ট্রনীতির আলোচনা সমাজের উঁচু স্তর আর গবেষকদের মধ্যে সীমিত থাকত। এই প্রবণতা গত এক দশকে পাল্টে গেছে। তাই বাংলাদেশ ও মালদ্বীপে যখন ‘ইন্ডিয়া আউট’ আন্দোলন চলে, তা নিয়ে ভারতের সাধারণ জনগণের মধ্যে অনেক প্রশ্ন তৈরি হয়। তারা জানতে চান, প্রতিবেশী দেশগুলোতে কী হচ্ছে।
সঞ্জয় ভরদ্বাজের মতে, ২০১৪ সালের নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর থেকে বিজেপি প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে মনোযোগ দিচ্ছে। প্রতিবেশীকে নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার কথা বলা হচ্ছে।
ভারতের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্বের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে সঞ্জয় ভরদ্বাজ বলেন, ভারতের পূর্বাঞ্চলের জন্য বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে উত্তর-পূর্ব ভারতের পরিপ্রেক্ষিতে। তাই বাংলাদেশের কাছে ভারত যতটা গুরুত্বপূর্ণ, তার চেয়ে ভারতের কাছে বাংলাদেশ বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশের সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, লোকসভার প্রথম ধাপের ভোট গ্রহণের পর ভোটারের উপস্থিতি আর ক্ষমতাসীন দল বিজেপির পক্ষে যতটা সমর্থন আশা করা হয়েছিল, বাস্তবতা ততটা ইতিবাচক নয়। বিরোধী দলের পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশনসহ গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাজনীতিকীকরণের অভিযোগ আনা হয়েছে। রাষ্ট্রযন্ত্রবিরোধীদের বিরুদ্ধে আয়করকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে বলেও অভিযোগ এসেছে। অতীতে এ ধরনের অভিযোগ এলে ভারতে দ্রুত তা আমলে নেওয়া হতো। এবার কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না।
এম সাখাওয়াত বলেন, ভারতবিরোধী যে আন্দোলন বাংলাদেশে শুরু হয়েছে, তার প্রতি সমর্থন বাড়ছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের শেষ তিনটি নির্বাচনে ভারত যে হস্তক্ষেপ করেছে, সেটা কারও অজানা নয়। বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দলও ভারতের সমর্থনের কথা জানিয়েছে। ফলে ভারতে ভবিষ্যতে যারা সরকারে আসবে, তারা বাংলাদেশের সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক রাখবে, নাকি জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করবে—এই প্রশ্ন উঠছে।
বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব ও দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার মো. শহীদুল হক বলেন, অতীতে পররাষ্ট্রনীতি আদর্শবাদের ভিত্তিতে পরিচালিত হলেও এখন বাস্তববাদ আর জাতীয় স্বার্থের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়। অথচ পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে আমরা এখনো আদর্শবাদিতাতেই বিশ্বাসী। এটা ভুল। তিনি বলেন, নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর ভারতের পররাষ্ট্রনীতির অবস্থান পরিবর্তন করেছেন। তিনি বাস্তববাদ আর জাতীয় স্বার্থের ভিত্তিতে পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করছেন।
শহীদুল হক বলেন, সাম্প্রতিক কালে, বিশেষ করে ১০-১৫ বছর ধরে ভারতের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র ও চীনও বলছে বাংলাদেশ তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশ কীভাবে ভারসাম্য রেখে ভারত ও চীনের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নেবে।