দেশ এখন যেন আগুনে পুড়ছে। একদিকে খরা, তাপপ্রবাহ, আরেক দিকে জিনিসপত্রের লাগামছাড়া দাম। শহর-নগর-গ্রামে উত্তাপ, বাজারেও উত্তাপ। এ এক অসহনীয় পরিস্থিতি। কাঠফাটা রোদ আর গুমোট গরমে হাঁসফাঁস দশা। এই গরমে মাথা গরম হয়ে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। যে কারণে গরমকালে আমরা খুব সহজেই মেজাজ হারিয়ে ফেলি। কিন্তু সাবধান, মেজাজ হারাবেন না। যে কোনো মূল্যে মেজাজ ঠান্ডা রাখুন। তা না হলে কিন্তু হিট-স্ট্রোকে পটল তুলতে হতে পারে। ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রার কারণে আবহাওয়া অধিদপ্তর ইতিমধ্যে তিন দিনের জন্য দেশে তাপপ্রবাহের সতর্কতা জারি করেছে। আবহাওয়া অফিসের ভাষ্য মতে, এপ্রিল মাস জুড়েই তাপপ্রবাহ থাকবে। তবে সময়ভেদে এর মাত্রা কমবেশি হতে পারে। সবাইকে সাবধানে থাকতে হবে।
শীতকালে আমরা একটু গরমের জন্য কত না হা-হুতাশ করি। আর গরমে ঠিক উলটো। একটু ঠান্ডার জন্য সবার মধ্যে হাহাকার। ঠিক যেমন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে কিছু লোক বিএনপির জন্য হা-হুতাশ করেন। আবার বিএনপি ক্ষমতায় এলে আওয়ামী লীগের জন্য কান্নাকাটি শুরু করে দেন! গরমের ব্যাপারটা অবশ্য একটু ভিন্ন। গরম চা, গরম কফি, হটকেক, হটডগ এবং শীতকালে গরম ভাত, গরম পানি, গরম গরম ইলিশ ভাজা, গরম কাপড়—হাতে গোনা এমন কয়েকটি আইটেম ছাড়া আমাদের জীবনে গরমের বড় বেশি কদর নেই। বর্তমানে আমরা প্রাকৃতিক গরমে ভীষণ রকম নাজেহাল। না, রাজনৈতিক উত্তাপ নয়, দেশ আপাতত খরায় পুড়ছে। দেশ জুড়ে চলছে তীব্র তাপপ্রবাহ।
এই খরতাপ মানুষসহ প্রাণিকুলের জন্য এখন অসহনীয় হয়ে উঠেছে। এই আবহাওয়ায় গরমও চরম গরম হয়ে উঠেছে। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বেড়ে গেছে। আকাশে নেই কোনো মেঘের বলয়। এতে সূর্যের তাপ বায়ুমণ্ডলে কোনো বাধা না পেয়ে সরাসরি ভূপৃষ্ঠে চলে আসায় বেড়ে যাচ্ছে গরমের তীব্রতা। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাতাসে জলীয় বাষ্প যত বেশি থাকবে, তত বেশি পরিমাণে বজ্রগর্ভ মেঘ তৈরি হবে। গরমকালে বঙ্গোপসাগরের ওপরে তৈরি হওয়া উচ্চচাপ বলয় থেকেই রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য স্থানে জলীয় বাষ্প প্রবেশ করে। সেই জলীয় বাষ্পের প্রভাবেই গ্রীষ্মে কালবৈশাখী বা ঝড়-বৃষ্টি হয়। কিন্তু চলতি বছরে সেই উচ্চ চাপগুলো বিএনপির সরকার পতনের আন্দোলনের মতো এতই দুর্বল যে ঝড়-বৃষ্টি ঘটাতে পারছে না। উচ্চ চাপের দুর্বলতার সুযোগে শুষ্ক-গরম হাওয়া ঢুকে পড়ছে। ফলে দেশ জুড়ে শুষ্ক গরম অনুভূত হচ্ছে। সবাই চাতকের মতো বৃষ্টির আশা করছে। কিন্তু বৃষ্টির দেখা নেই।
তীব্র গরমে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ডায়রিয়ার প্রকোপ বাড়ছে। প্রচণ্ড গরমে বিশুদ্ধ খাওয়ার পানির তীব্র সংকট দেখা যাচ্ছে। খাল-বিল-নদী-নালা শুকিয়ে গেছে। কুয়া কিংবা নলকূপের পানিও তলানিতে চলে গেছে। যারা সিটি করপোরেশন কিংবা পৌরসভার সরবরাহ করা পানি পান করেন, তাদের বেশির ভাগ মানুষ নিরাপদ পানি পাচ্ছেন না। এছাড়া খোলা ও বাসি খাবারের কারণেও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। দেশের সাধারণ মানুষের এ এক নিদানহীন নিদারুণ অবস্থা। চিকিত্সকেরা অবাস্তব সব পরামর্শ দিচ্ছেন। তারা বলছেন, সবারই এ সময় গরম পরিহার করা উচিত। যথাসম্ভব ছায়াময় স্থানে থাকা উচিত। কিন্তু প্রশ্ন হলো, দেশের কয়জন মানুষের ছায়ায় বসে কাজ করার সুযোগ আছে? বাঁচার জন্য মানুষকে খেতে হয়। আর খাওয়ার জন্য তাকে কাজ করতেই হয়। কাজ না করলে মানুষ খাবে কী? আর কাজ করতে গেলে রোদ বা গরম পরিহার করবে কীভাবে?
চিকিত্সকেরা আরো বলছেন, মাঠে যারা কাজ করেন কিংবা শ্রমিকদের দেহ থেকে এ সময় ঘামের সঙ্গে প্রচুর পানি ও লবণ বের হয়ে যায়। এর অভাব পূরণ করতে প্রচুর নিরাপদ পানি পান করতে হবে। পানিতে একটু লবণ মেশাতে হবে। লবণ-চিনির যা দাম, তাতে দেশের সাধারণ মানুষের পক্ষে এখন লবণ, চিনি সংগ্রহ করাও কঠিন। আর নিরাপদ পানি সে কোথায় পাবে? দেশে বর্তমানে শ্যাওলা-ময়লা-দুর্গন্ধ-জীবাণু-পোকামাকড় ছাড়া পানি সত্ মানুষের মতোই দুর্লভ! চিকিত্সকেরা এ সময় ফুটপাতের খাবার না খাওয়ারও পরামর্শ দিচ্ছেন। শ্রমজীবী মানুষের পক্ষে এই উপদেশ মানাও সম্ভব হচ্ছে না। কারণ শ্রমজীবীদের বেশির ভাগেরই ভরসা ঐ ফুটপাতের দোকানের খাবার। তাদের পক্ষে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত পরিচ্ছন্ন হোটেলের খাবার খাওয়ার সামর্থ্য নেই। সেই সময়ও নেই। স্বল্প মূল্যে হাতের কাছে তারা যা পায়, তা-ই খায়। এটা তাদের অভ্যাসও বটে। আর অভ্যাস তো আর এত সহজে পালটানো যায় না! এই গরমে কোনো কিছুই সস্তা বা সুলভ নয়। সারা দিন হাড়ভাঙা খাটুনির পর বাসায় এসে একটু লেবুর শরবত পান করে প্রাণ জুড়াবেন? লেবু পাবেন না। বাজারে লেবুর নামে যা ৩০ থেকে ৪০ টাকা
হালিতে বিক্রি হচ্ছে, তাতে এক ফোঁটা রস নেই। চিপতে চিপতে আঙুলে ফোসকা পড়ে যাবে, কিন্তু রস বেরোবে না। এই গরমে শখ করে একটু ডাব খাবেন, তাও পারবেন না। একটা ডাবের দাম জোগাতে আপনাকে প্রায় ভিটে-মাটি বন্ধক দিতে হবে! বেশি তাপে যে কোনো কঠিন পদার্থই নাকি প্রসারিত হয়। আকার-আকৃতির পরিবর্তন হয়। বর্তমানে দেশে যা তাপ, তাতে অন্যসব কঠিন পদার্থ তো বটেই, মানুষের মগজও কেমন যেন ঢিলা হয়ে যাচ্ছে। মাথার গন্ডগোল দেখা দিচ্ছে। খুন, ধর্ষণ, জঙ্গি আস্তানার সন্ধান, সবই বেড়ে যাচ্ছে। সবচেয়ে বড় সংকট হচ্ছে, মানুষজন তুচ্ছ কারণে খেঁকিয়ে উঠছেন। কাউকে ভাই বললেও প্রত্ত্যুত্তরে শালা সম্বোধন শুনতে হচ্ছে। কুশল জিগ্যেস করলে এমন সব জবাব শোনা যাচ্ছে, যেন আপনি তার সম্পত্তি লিখে নেওয়ার প্রস্তাব করছেন! সবার মধ্যে তাপ, চাপ, মেজাজ। বস তার কলিগদের সহ্য করতে পারছেন না। অকারণে গালাগাল করছেন। গণপরিবহনে যাত্রীর সঙ্গে যাত্রীর, যাত্রীর সঙ্গে পরিবহন শ্রমিকদের কথা কাটাকাটি মারামারি-ঝগড়া বেড়ে গেছে। পরিবারগুলোতেও আফগানিস্তান কিংবা পাকিস্তানের মতো আত্মঘাতী সংঘাত বেড়ে গেছে। গরমে অতিষ্ঠ গিন্নিরাও টি-টোয়েন্টির ব্যাটসম্যানদের মতো মারমুখী হয়ে উঠেছেন। পান থেকে চুন খসলেই পুরুষ সদস্যরা যেমন খেঁকিয়ে উঠছেন, নারীরাও পালটা আঘাত হানছেন। এতে করে ঘরে ঘরে দাম্পত্য কলহ বাড়ছে। সবাই এখন সবকিছুর দায় চাপাচ্ছেন গরমের ওপর।
এক ক্রেতা ক্রুদ্ধ হয়ে লেবু বিক্রেতাকে বলছেন, আমি এক ডজন লেবু কিনে নিয়ে গেলাম। বাসায় গিয়ে দেখি, তুমি ১০টা লেবু দিছো। এই জোচ্চুরির মানে কী? তুমি কী মগের মুল্লুক পেয়েছ নাকি, যে এক ডজন লেবুতে দুইটা কম দিবা?
লেবু বিক্রেতা কাঁচুমাঁচু হয়ে বলছেন, স্যার, যা গরম পড়ছে, তাতে মাথামুথা ঠিক নাই, বারোডার জায়গায় দশটা দিয়া দিছি।
ক্রেতা ভদ্রলোক রাগত কণ্ঠেই বললেন, কিন্তু বারোটার জায়গায় তেরো কিংবা চোদ্দোটা তো দিলা না!
এবার দোকানি ভদ্রলোক বেশ একটা রহস্যের হাসি হেসে বললেন, স্যার, গরম পড়ছে ঠিকই, কিন্তু অত গরম কি আর পড়ছে যে বারোটার জায়গায় চোদ্দোটা দিমু!
পরিশেষে ধন্যবাদ জানাই আবহাওয়া দপ্তরকে! আবহাওয়া বিভাগের কর্তাব্যক্তিরা ঠান্ডা ঘরে বসে, অন্তত সত্য কথাটা সাফ জানিয়ে দিয়েছেন যে, আপাতত গরম কমার কোনো সম্ভাবনা নেই! গরম কমবে কীভাবে? মৌসুমি বায়ু তো আর কারো আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী চলে না। উত্পন্নও হয় না। পুকুর নেই, ডোবা নেই, আছে শুধু মালটিস্টোরিড বিল্ডিং, শপিংমল, মালটিপ্লেক্স, ফুললি এয়ার কন্ডিশনড ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। ভেড়ার পালের মতো বাড়ছে মানুষ, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে গাড়ি, বাড়ছে এসি, বাড়ছে জেনারেটর, বাড়ছে রেফ্রিজারেটর। বিদ্যুত্ উত্পাদন সীমিত কিন্তু চাহিদা প্রচুর।
যাহোক, এই গরমে ভারী ভারী কথা না বলে বরং একটু উপদেশ প্রদান করি। প্রচণ্ড গরমে মাথা ও মেজাজ গরম হয়ে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু, সাবধান, মেজাজ গরম করা যাবে না। মেজাজ গরম হলে অনেক রকম শারীরিক সমস্যা হতে পারে। তাই যে কোনো মূল্যে মাথা ও চাঁদি ঠান্ডা রাখুন।
কথাতেই আছে চাঁদি ফাটা রোদ। যতটা সম্ভব মাথা রোদ থেকে বাঁচিয়ে রাখুন। আপনার মাথার তালু কিন্তু ত্বকেরই অংশ। রাস্তায় বেরোলে হ্যাট ব্যবহার করুন। অথবা ছাতা ব্যবহার করুন। মাথায় পানি দিন। তবে তা ভালোভাবে মুছে নিতে হবে। না হলে ঠান্ডা লেগে যেতে পারে। অ্যালয় ভেরা জেল মাথা ঠান্ডা রাখতে খুবই উপকারী। এই জেল সরাসরি মাথায় লাগিয়ে ম্যাসাজ করতে পারেন। অথবা অ্যালয় ভেরা বা মিন্ট অয়েল দিয়েও ম্যাসাজ করতে পারেন। এতে মাথার তালু ঠান্ডা থাকবে। মনে রাখবেন, এই গরমে মাথা ঠান্ডা রাখা সবচেয়ে জরুরি।
লেখক : রম্যরচয়িতা