‘ছেলে রিদুয়ানকে (১৯) আমি মুরগি ও মাছের খামার করে দিয়েছিলাম। সেসব নিয়ে তার ভালোই দিন কাটছিল। কিন্তু অকস্মাৎ একদিন সে উধাও হয়ে যায়। সব জায়গায় খুঁজেও তারে আর পাচ্ছিলাম না। আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম, ছেলেকে আর ফিরে পাবো না। এভাবে কেটে যায় এক বছর। হঠাৎ বিদেশি একটি নম্বর থেকে কল আসে। ও প্রান্ত থেকে রিদুয়ান বলছিল, সে মিয়ানমারের কারাগারে বন্দি। মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে আটক হয়েছিল সেসহ আরও বেশ কয়েকজন। কবে ফিরতে পারবে সেটা অনিশ্চিত ছিল। কিন্তু দৈবক্রমে বন্দি সময়ের ১৮ মাসের মাথায় আজ ফিরে এসেছে রিদুয়ান। তারে পেয়ে মনে হলো, জীবনের ডুবে যাওয়া সূর্য মেঘমুক্ত আকাশে আবার উদিত হয়েছে।’
দীর্ঘদিন মিয়ানমারের কারাগারে বন্দি থাকার পর ছেলে রিদুয়ান দেশে ফেরত আসায় এভাবেই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছিলেন কক্সবাজারের টেকনাফের হোয়াইক্যং বাজার এলাকার বাসিন্দা হাসান আলী।
মিয়ানমারে অনুপ্রবেশের দায়ে দীর্ঘসময় কারাভোগের পর বুধবার (২৪ এপ্রিল) দেশে ফিরে এসেছেন ১৭৩ জন বাংলাদেশি। দুপুর দেড়টার দিকে তাদের বহনকারী জাহাজটি ঘাটে পৌঁছায়। এর আগে মঙ্গলবার (২৩ এপ্রিল) সকালে মিয়ানমারের সিটওয়ে বন্দর থেকে তাদের নিয়ে মিয়ানমারের একটি জাহাজ বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়।
সকালে জাহাজটি বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় পৌঁছানোর পর বাংলাদেশি একটি জাহাজে তাদের তুলে নেওয়া হয়। পরে জাহাজটি কক্সবাজারের বাঁকখালী নদীর মোহনায় নুনিয়ারছড়া বিআইডব্লিউটিএ ঘাটের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে দুপুর দেড়টার দিকে গন্তব্যে পৌঁছায়। এরপর দুপুর পৌনে ২টা থেকে ১০ জন করে দলবদ্ধভাবে তাদের জাহাজ থেকে নামিয়ে এনে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
জেলা প্রশাসনের সূত্রমতে, মিয়ানমার থেকে ফেরত আসা ১৭৩ জনের মধ্যে ১২৯ জনের বাড়িই কক্সবাজারে। বাকিদের মধ্যে ৩০ জন বান্দরবান, সাতজন রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ির বাসিন্দা। এছাড়া নোয়াখালী, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, রাজবাড়ী, নরসিংদী ও নীলফামারী জেলার রয়েছেন একজন করে।
ফেরত আসা ১৭৩ জনের মধ্যে ১৪৪ জন বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত হয়ে মিয়ানমারে বন্দি ছিলেন। তাদের সাজার মেয়াদ শেষ হয়েছে আগেই। বাকি ২৯ জনের সাজার মেয়াদ শেষ না হলেও তাদের বিশেষ ক্ষমার আওতায় আনা হয়।
বিকেল ৪টা নাগাদ হস্তান্তর প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলেও যাদের স্বজনরা আসেননি তাদের জেলা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে নেওয়া হয়। সেখান থেকেই তাদের ঘরে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা হবে।
এদিকে, সকাল থেকেই কক্সবাজার শহরের নুনিয়ারছড়া বিআইডব্লিউটিএ ঘাট এলাকায় অপেক্ষার প্রহর গুনছিলেন বাবা-মা-ভাইবোনসহ স্বজনরা। সেখানে কথা হয় টেকনাফের হ্নীলার খারাংখালীর বাসিন্দা ছেনোয়ারা বেগমের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘১২ বছর আগে আমার ভাই খোরশেদ আলম (৩০) নিখোঁজ হন। মঙ্গলবার খবর পেয়েছি মিয়ানমার কারাগার থেকে অনেক বাংলাদেশিকে আনা হচ্ছে। তাই ভাইয়ের জন্য অপেক্ষায় আছি। ছেলের জন্য কাঁদতে কাঁদতে শোকে আমার মা মারা গেছেন। একযুগ পর ভাইকে ফিরে পেয়ে আমরা আবেগাপ্লুত।’
উখিয়ার পালংখালী মধ্যম ফারিরবিল এলাকার ফরিদা খাতুন বলেন, ‘আমার ছেলে আরাফাত হোসেন (২০) অটোরিকশা চালাতো। দালালের খপ্পরে পড়ে ১৪ মাস আগে মালয়েশিয়া যাওয়ার কথা বলে ঘর থেকে বের হয়ে নিখোঁজ হয়। ৯ মাস পরে তার চিঠি পেয়ে নিশ্চিত হয়েছি সে মিয়ানমারের কারাগারে রয়েছে। নিকটাত্মীয়ের মাধ্যমে খবর পেয়েছি মিয়ানমার থেকে তাদের আনা হচ্ছে। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আমার ছেলেকে ফিরে পেয়েছি।’
একইভাবে, উখিয়ার জালিয়াপালংয়ের মনখালীর বদিউল আলমের ছেলে সালাহউদ্দিন, শাহ আলমের ছেলে ফারুক আহমদ, ফরিদুল আলমের ছেলে মাহমুদুল হক এবং টেকনাফের বাহারছরার হাজমপাড়ার নুরুল ইসলামের ছেলে নুরুল আলমসহ ১৭৩ জন বিভিন্ন মেয়াদে মিয়ানমারের কারাগারে ছিলেন।
ফেরত আসা বাংলাদেশিরা জানান, মিয়ানমার কারাগারে তাদের ওপর নিয়মিত নির্যাতন চালানো হয়েছে। দিনে একবেলা খাবার দেওয়া হতো, তা-ও খাওয়ার অনুপযোগী। তাদের সঙ্গে আরও বাংলাদেশি দেশটির কারাগারে বন্দি রয়েছেন। এদের মধ্যে বেশিরভাগই সাগরপথে মালয়েশিয়া যেতে গিয়ে বন্দি হন। তারাও ফিরে আসার আকুতি জানিয়েছেন।
যে জাহাজে বাংলাদেশি বন্দিরা এসেছেন, ওই জাহাজেই বৃহস্পতিবার (২৫ এপ্রিল) বাংলাদেশ থেকে ফেরত যাবেন রাখাইনে চলমান সংঘাত থেকে প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে আসা ২৮৫ জন বিজিপি (দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনী) ও সেনাসদস্য।
মিয়ানমারে বাংলাদেশ দূতাবাস সূত্র জানায়, যাদের ফেরত পাঠানো হয়েছে তারা বিভিন্ন সময় মিয়ানমারে অনুপ্রবেশের দায়ে আটক হয়েছিলেন। যাচাই-বাছাই শেষে বাংলাদেশের নাগরিক বলে নিশ্চিত হওয়ার পরই তাদের ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়।
এর আগে সোমবার (২২ এপ্রিল) প্রধানমন্ত্রীর থাইল্যান্ড সফর নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ জানিয়েছিলেন, বন্দি বাংলাদেশিদের নিয়ে যে জাহাজটি দেশে পৌঁছাবে তাতে করেই মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা বিজিপি সদস্যদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হবে।
মিয়ানমারে বাংলাদেশ দূতাবাসের কাউন্সিলর এ এস এম সায়েম আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে জানান, সবার আগে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ যাচাই-বাছাই করে দেখেছে আটকরা বাংলাদেশের বৈধ নাগরিক কি না। সেটি নিশ্চিত হওয়ার পরই ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়। বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর আগে তাদের রাখা হয় সিটওয়ের কারাগারে। পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর তাদের কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে তোলা হয় দেশটির নৌবাহিনীর জাহাজে।
সূত্রমতে, মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্তের দৈর্ঘ্য প্রায় পৌনে ৩০০ কিলোমিটার। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশিরা এ সীমানা পাড়ি দিয়ে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া বা থাইল্যান্ড যাওয়ার চেষ্টাকালে মিয়ানমার সীমানায় আটক হন।
এদিকে, কক্সবাজারের রামুর গর্জনিয়া মরিচ্যাচর গ্রামের ৯ যুবক মানব পাচারকারীর কবলে পড়ে মিয়ানমারের কারাগারে বন্দি রয়েছেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি নেজাম উদ্দিন। তারা হলেন গর্জনিয়া ২ নম্বর ওয়ার্ড়ের মরিচ্যাচর গ্রামের মো. মোক্তারের ছেলে এবাদুল্লাহ, মোতাহের আহমদের ছেলে ফোরকান, বদিউল আলমের ছেলে নুর হোসেন, ছৈয়দ আলমের ছেলে জসিম উদ্দিন, আহমদুর রহমানের ছেলে মিছবাহ, মোক্তার আহমদের ছেলে মনির আহমদ, নুরু জব্বরের ছেলে জিয়াউর রহমান ও আবুল হাসেমের ছেলে ছৈয়দ হোসেন।
১৮ থেকে ২৫ বছর বয়সী এসব যুবককে থাইল্যান্ড হয়ে খুব সহজেই মালয়েশিয়া যাওয়ার স্বপ্ন দেখিয়ে মাস ছয়েক আগে নিয়ে যায় দালাল চক্র। এরপর তাদের জিম্মি করে প্রতি পরিবার থেকে হাতিয়ে নেওয়া হয় ৫-৬ লাখ টাকা। এরা সবাই মিয়ানমারের কারাগারে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন ফেরত আসারা।