মুসলমান সমাজে ব্যাঙের বিয়ে, হুদমা গানের লোকাচার

হাসান শান্তনু

বৃষ্টির জন্য ব্যাঙের বিয়ে, ইসতিসকার নামাজ নিয়ে তীব্র তাপপ্রবাহের এ সময় অসহনশীল ঠাট্টা-মশকরা চলছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এ দুটিসহ বৃষ্টির প্রত্যাশায় গ্রামীণ সমাজে প্রচলিত লোকাচারগুলো বিজ্ঞানসম্মত কী না, এমন প্রশ্ন ওঠছে। ইসলামে বিশ্বাসী কতিপয় উগ্রের দাবি, ‘শুধু নামাজ ছাড়া ব্যাঙের বিয়ে, পুজা, হুদমা গান, ব্রত কোনোভাবেই বিজ্ঞানসম্মত নয়। সনাতন, বৌদ্ধসহ নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর সমাজে চর্চিত এসব আচারে বৃষ্টি নামে না।’ বাঙালির সংস্কৃতির প্রায় সবকিছুকে ‘হিন্দুয়ানি’ বলা, গ্রামীণ জনপদের নানা আচার-আচরণকে ‘হিন্দু সমাজের বিষয়’ বলে দাবি করার জামায়াত, হেফাজতেরর মতো উগ্রপন্থী গোষ্ঠীর দেশে ভয়ংকর বিকাশ, বিস্তার ঘটেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে ইসতিসকার নামাজ পড়তে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির প্রশাসনের অনুমতি না দেওয়ার বিষয়টিকে জামায়াত, হেফাজত ‘ইসলামের অবমাননা’ বলে অপপ্রচার করছে। ইসতিসকার নামাজ খোলা মাঠে পড়া সুন্নত, প্রয়োজনে মসজিদে অবশ্যই পড়া যায়। নামাজ নিয়ে রাজনীতি না করে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয়, বা কোনো হলের মসজিদে পড়ার আয়োজন ওই গোষ্ঠী চাইলেই করতে পারে। যদিও তাদের মূল উদ্দেশ্য নামাজ পড়া নয়।

যুক্তিবাদীরা বলছেন, ‘নামাজ পড়লে বৃষ্টি নামে, এর বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।’ তবে বৃষ্টি নামাতে নামাজ পড়ার পাশাপাশি ব্যাঙের বিয়ে দেওয়া, তালতলার শিন্নির আয়োজন, হুদমা গানের আদলে নাচানাচি মুসলমান সমাজেও প্রচলিত। শুধু বাংলাদেশ নয়, মুসলমানপ্রধান অনেক দেশের ইতিহাসেই তা আছে। এসব লোকজ সংস্কৃতি ‘হিন্দুয়ানি’ নয়। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস, ব্যাঙের বিয়ে দিলে বৃষ্টির দেবতা বরুণ দেব সন্তুষ্ট হয়ে পর্যাপ্ত বৃষ্টি নামান। এ বিয়ের আয়োজন হয় পাহাড়ি সমাজেও।

বৃহত্তর ফরিদপুরের লোকজ সংস্কৃতি বলে, বৃষ্টির জন্য ব্যাঙের বিয়ে দেওয়া অনগ্রসর মুসলমান সমাজেও প্রচলিত ছিলো। কৃষিপ্রধান এ দেশে বৃষ্টির প্রার্থনায় তালতলার শিন্নির আয়োজন করেন মূলত মুসলমানরা। উত্তরবঙ্গের দিকে বৃষ্টি নামাতে হুদুমদ্যাও, বা মেঘপূজার আয়োজন করেন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নারীরা। তাদের মতে, এতে মেঘের দেবতা হুদমা সন্তুষ্ট হয়ে বৃষ্টি দেন। বৃষ্টি নামাতে গ্রামবাংলায় সনাতন ধর্মের অনুসারীরা ‘পুণ্যিপুকুর ব্রত’ করেন।

ভারতের গুজরাটে হিন্দু-মুসলমান বয়স্ক নারী, বালিকারা মিলে মেঘরাজকে আহবান জানান বৃষ্টির জন্য। বুলগেরিয়ায় বৃষ্টি কামনায় ‘প্রজাপতি নৃত্য’ করেন মুসলমান রমণীরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে, যা অনেকটা হুদমা গানের আদলে। সার্বিয়াতে বৃষ্টি কামনায় একইরকম আচার পালন হয়। ধর্মীয় যে কোনো বিশ্বাস ও অসংখ্য বছর ধরে চর্চিত লোকাচারকে সবসময় বিজ্ঞানের নিরিখে যাচাই-বাছাইয়ের সুযোগ নেই। ধর্মকে বিজ্ঞানের কাছে পরীক্ষা দিয়ে পাসের দরকার হয় না।

ইসতিসকার নামাজ কবুল হলে স্রষ্টা বৃষ্টি দেন, বিজ্ঞান না মানলেও ইসলামে বিশ্বাসী কারো কাছে তা নিরেট সত্য। লোকাচার সবসময় ধর্মজাত হয় না, সেখানে ভ্রান্ত বিশ্বাসও জড়িয়ে থাকতে পারে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজের সৃষ্টির কোথাও ধর্মকে অস্বীকার করেননি। তিনি একে অবলম্বন করেন মানবমুক্তির উৎস হিসেবে। তাঁর মতে, ‘ধর্ম মানে মানবধর্ম। মানুষের জন্যই ধর্ম, ধর্মের জন্যে মানুষ নয়। ধর্ম মানে মনুষ্যত্ব। যারা ধর্মের এ মূল কথা মানেন না, তারা আর যাই হোক মনুষত্বের বোধ নিয়ে পৃথিবীতে জন্মাননি। কোনো ধর্মেরই ধর্ম মানুষের অনিষ্ট করা নয়।’

ধর্ম নিঃসন্দেহে শক্তিশালী ‘সাইকোট্রপিক’ প্রক্রিয়া, যা বিশ্বাসীদের শরীরে সুখানুভূতির হরমোনগুলোর নিঃসরণ ঘটায়। জীবন ও জগতের যা কিছু মানুষের বোধবুদ্ধির বাইরে, ধর্ম সে সবের ব্যাখ্যা দেয়। বিশ্বসংসারের একটা গভীর অন্তর্লীন অর্থ খুঁজে দিয়ে সেখানে মানুষের অবস্থান নির্ধারণে সাহায্য করে। বিশ্বাসীদের সব রকম সমস্যার মোকাবেলায় ভরসা জোগায় ধর্ম। ধর্মের এ ভূমিকা ব্যক্তিমানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রেও। আবেগ আর মনন- দুইদিক থেকেই ধর্ম মানুষের বিরাট অবলম্বন। ‘ফাংশনালিস্ট’ সমাজতত্ত্ববিদরা ধর্মকে গুরুত্বপূর্ণ সমাজবন্ধন হিসেবে দেখেন।

ধর্মের সামাজিক জায়গাটায় ধর্মলালিত নৈতিকতারও বড় ভূমিকা থাকে। ধর্মের যে কোনো দিককে বিজ্ঞানের আলোকে যাচাই করে ঠাট্টামশকরা সমর্থনযোগ্য নয়। সবার নিষ্পাপ বিশ্বাস টিকে থাকুক। রাজনৈতিক অঙ্গন ও রাষ্ট্রীয় পর্যায় পর্যন্ত গড়িয়ে তা ফ্যাসিবাদের জন্ম না দিলেই হয়। ব্যক্তি, বা জনগোষ্ঠীর যে বিশ্বাস অন্যের ক্ষতি করে না, অশ্রদ্ধা উস্কে দেয় না, সেই বিশ্বাস নিয়ে জুজুর ভয় দেখানোর কিছু নেই।

হাসান শান্তনু: সাংবাদিক, গণমাধ্যম গবেষক।

শেয়ার করুন