সমাজ-জীবনে ধনী-গরিব

ফনিন্দ্র সরকার

প্রতীকী ছবিটি সংগৃহীত

বিকাশমান মানবসভ্যতায় ধনী-গরিব বিষয়টি খুবই প্রাসঙ্গিক। সমাজসভ্যতা যত দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে, ধনী-গরিব ততটাই হাত ধরাধরি করে এগিয়ে যাচ্ছে। সমাজে ধনী লোকের সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি পাল্লা দিয়ে গরিবের সংখ্যাও বাড়ছে। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, ধনীর সংখ্যা বাড়লে গরিবের সংখ্যা বাড়ে কীভাবে? অবশ্যই কমে যাওয়া উচিত। কিন্তু হিসাবটি এভাবে করা সমীচীন নয়।

মানবসমাজে ছয়টি স্তর রয়েছে। আমরা সাধারণত ছয়টি স্তর নিয়ে কখনো চিন্তা করি না। কেবল ধনী-গরিব নিয়ে আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখি। এই ছয়টি স্তর হচ্ছে—(১) অতি উচ্চবিত্ত/অতিরিক্ত ধনী বা উপচে পড়া ধন-সম্পদের মালিক; (২) উচ্চবিত্ত/ধনী বা ধনবান; (৩) উচ্চ মধ্যবিত্ত যথার্থ সচ্ছল বা প্রয়োজনীয় ধন-সম্পদের মালিক; (৪) মধ্যবিত্ত চাহিদার তুলনায় কিছু কম সম্পদের মলিক; (৫) নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানে কোনো রকম জীবন ধারণের জন্য সম্পদের মালিক; (৬) নিম্নবিত্ত দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করা, চাহিদার তুলনায় ৮০ ভাগ কম আয় থাকা বা মানবেতর জীবন যাপনকারী।

universel cardiac hospital

উপরোক্ত ছয়টি স্তরে মানুষ বসবাস করে। বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোতে এমন ছয়টি স্তরের সামাজিক জীবনচিত্র রয়েছে। এর মধ্যে আমাদের বাংলাদেশ একটি। বাংলাদেশে ধনীর সংখ্যা বাড়ছে গাণিতিক হারে, গরিবের সংখ্যা বাড়ছে জ্যামিতিক হারে। উচ্চমধ্যবিত্তরা মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তরা নিম্নবিত্তে রূপান্তরিত হচ্ছে। সর্বমোট জনসংখ্যায় অতি উচ্চবিত্ত ২ ভাগ, উচ্চবিত্ত ১০ ভাগ, উচ্চমধ্যবিত্ত ২০ ভাগ, মধ্যবিত্ত ৩০ ভাগ, নিম্নমধ্যবিত্ত ৩৫ ভাগ, নিম্নবিত্ত ১৩ ভাগ।

মধ্যবিত্ত সমাজটা বিলুপ্তির পথে। সুষ্ঠু ও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় এই মধ্যবিত্ত সমাজটাই ক্ষমতার নিয়ামক শক্তি হিসেবে কাজ করে আসছে। কিন্তু এই সমাজটা যখন সম্পূর্ণ উঠে যাবে, তখন গণতন্ত্র ও রাজনীতি সংকটের মুখে পড়বেই। ফলে সুশাসন বলে কিছু থাকবে না। সামাজিক জীবনে এটা একটা বড় শঙ্কার কারণ। দিনে দিনে মানবসমাজের মধ্যে অস্থিরতা বেড়েই চলেছে। এর মূল কারণ হচ্ছে সীমাহীন অর্থনৈতিক বৈষম্য। এক শ্রেণির কাছে উপচে পড়া ধন-সম্পদ রয়েছে, আরেক শ্রেণি আছে ঠিকমতো পেট পুরে খেতেও পায় না। এটা কেবল আমাদের বাংলাদেশের চিত্র নয়, আফ্রিকা মহাদেশে মরু অঞ্চলে বেশ কিছু দেশ রয়েছে, যেখানে সাধারণ মানুুষের ভাগ্যে খাদ্য জোটে না। কঙ্কালসার মানুষের সংখ্যাই সেখানে বেশি। অথচ ঐ সব দেশে প্রচুর সম্পদ রয়েছে। যে সম্পদের প্রকৃত মালিক সাধারণ মানুষ হওয়া সত্ত্বেও রাষ্ট্রব্যবস্থায় সাধারণ মানুষকে বঞ্চিত করে রাখা হয়েছে। আন্তর্জাতিক পরাশক্তির নিয়ন্ত্রণাধীন বিশ্বে অনেকগুলো দেশ রয়েছে, যে দেশগুলোতে সাধারণ মানুষের অধিকার বলতে কিছু নেই। শাসকগোষ্ঠী পরাশক্তির নিয়ন্ত্রণে। পুতুল সরকার বসিয়ে রাখা হয়েছে। শাককগোষ্ঠী লুটপাটতন্ত্র কায়েম করার সুযোগ লাভ করছে, অন্যদিকে পরাশক্তি তাদের লাভ তুলে নিচ্ছে। দক্ষিণ সুদান, মোজাম্বিক, কঙ্গো, বুরুন্ডি, মালাউই, চাদ, লাইবেরিয়া—এই সব দেশে সাধারণ মানুষ সীমাহীন মানবেতর জীবন যাপন করছে। মানবাধিকারের উচ্চকণ্ঠের দেশগুলো তাদের জন্য কিছু সাহায্য-সহযোগিতা করে থাকে রাজনৈতিক কারণে। বছরের পর বছর যেসব দেশে মানুষ কষ্ট করছে, তাদের উদ্ধারের কি কোনো ব্যবস্থা নেই? ওদের দেশীয় সম্পদের সুষ্ঠু ও সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করে সমবণ্টন ব্যবস্থার সরকার প্রতিষ্ঠিত হলেই ওদের কষ্ট লাঘব হবে।

পৃথিবীতে বৈধ পথে সচ্ছল হওয়া যায়, কিন্তু বিপুল পরিমাণে অর্থ-সম্পদের মালিক হওয়া কখনো সম্ভব নয়। বিশ্বের প্রথম সারির ধনী ও বিলিয়নিয়রদের প্রতি বছরই একটা তালিকা প্রকাশ করা হয়ে থাকে। প্রথম ১০ জন ধনী ব্যক্তির তালিকায় যাদের নাম থাকে, তাদের আপাতত গর্বিত মনে হলেও তারা প্রকৃত গর্বের বিষয় নয়। ধনী হওয়ার গৌরব অর্জনে অসুস্থ প্রতিযোগিতা বিদ্যমান। প্রশ্ন উঠতে পারে, বিশ্বের নামকরা ধনী ব্যক্তিরা রাষ্ট্রকে রাজস্ব দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করে ধনবান হয়েছেন। আসলে ব্যাপারটা তা নয়। তাদের অধিকাংশ মানুষকে ঠকিয়ে কখনো কখনো বোকা বানিয়ে, ধোঁকা দিয়ে সম্পদের মালিক হয়েছেন। নিয়মানুযায়ী ১৫ শতাংশের বেশি মুনাফা করা অন্যায় বা অবৈধ। কিন্তু বিশ্বের ধনী ব্যবসায়ীরা সুযোগ বুঝে ৫০০ শতাংশ মুনাফা করে থাকেন। এ ব্যাপারে তাদের কেউ কিছু বলতে পারবে না। কারণ তারা রাষ্ট্র ও সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করে। বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা করে যারা রাতারাতি শতকোটি টাকার মালিক বনে যান, সেই ব্যবসায় যে ঘাপলা রয়েছে, তা কিন্তু আমরা ভেবে দেখি না। রাষ্ট্র তাকে সফল উদ্যোক্তা হিসেবে পুরস্কৃত করে। রাষ্ট্রকে এই সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

বাংলাদেশে যখন প্রথম মোবাইল ফোনের ব্যবহার শুরু হয়, তখন একটি সিম নম্বরসহ মোবাইল ফোনের দাম ছিল ১ লাখ টাকা। বর্তমানে সিম বিনা টাকায় পাওয়া যায়। সবার হাতে মোবাইল ফোন। কলরেট ১ টাকার নিচে। তখন ছিল ১০ টাকা। বিজ্ঞান সভ্যতায় অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপক সংস্কার হয়েছে। কোম্পানিগুলো বিপুল পরিমাণ লাভ করে যাচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে শুভংকরের ফাঁকি। বাতাসের সাহায্যে বিনা খরচে কোটি কোটি টাকা কামাই করছে। ফোনে টাকা রিচার্জ করার সঙ্গে সঙ্গে চোখের আড়ালে টাকা কেটে নিচ্ছে। আমরা কিছুই করতে পারছি না। ডিজিটাল সিস্টেমে পকেট কাটা হচ্ছে সাধারণ মানুষের। যে যেভাবে পারছে, অন্যায় পথে ধনবান হচ্ছে। পৃথিবীতে সাধারণ শান্তিপ্রিয় মানুষের সংখ্যা বেশি হলেও এরা ঐক্যবদ্ধ নয়। এদের ঐক্যবদ্ধ করতে যে নেতৃত্ব প্রয়োজন, সেই নেতৃত্ব আজও গড়ে ওঠেনি। সত্ নেতৃত্ব ছাড়া রাষ্ট্রের সাধারণ মানুষের কল্যাণ নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। ছলে-বলে-কৌশলে একবার ধনী হতে পারলে সবকিছু নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। কারণ অর্থনৈতিক শক্তিই হচ্ছে আসল শক্তি। বিশ্বে বিলিয়নিয়ারদের যে ক্ষমতা, মর্যাদা, সেটি কোনো দেশের সরকারপ্রধান বা রাষ্ট্রপ্রধানের চাইতে কম নয়। বরং বেশি। যেমন—ভারতের মুকেশ আম্বানি। তিনি বিশ্বের প্রথম ১০ জন ধনীর একজন। তার পরিবারের সদস্যদের বিলাসী জীবনচিত্র দেখে বিস্মিত হতে হয়। অথচ ভারতে ৪০ শতাংশ লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে মানবেতর জীবন যাপন করে।

ধনী-গরিব বিষয়টি ক্ষণস্থায়ী হলেও মানব জাতি কখনো তা ভাবে না। আজকে যে ধনী কালকে সে ফকির—এই তত্ত্বে বিশ্বাসী নয় মানুষ। এটা ব্যর্থদের সান্ত্বনা। যারা ধনী হতে পারছে না, তারা এই সান্ত্বনার বাণী নিয়ে বেঁচে আছে। তবে আধ্যাত্মিকভাবে ধনী-গরিবের সংজ্ঞা অন্যভাবে নির্ধারিত। যার মন আছে, হূদয়ে ভালোবাসা আছে, তিনি প্রকৃত অর্থে ধনী ব্যক্তি। কিন্তু এরূপ ধনী ব্যক্তিকে মানবসমাজ কী কখনো মূল্যায়ন করেছে? কেবল বিত্ত-বৈভবের বিচারে মানুষের মূল্যায়ন হয়। মানুষের কাজকে যদি মানবিক দর্শন ও কর্মসূচির একটি অঙ্গ মনে না করে অর্থনৈতিক দিকটাকেই সবকিছু ভাবা হয়, অর্থবহির্ভূত বিষয়গুলোকে স্বীকৃতি ও যথাযোগ্য মর্যাদা দেওয়া না হয়, তাহলে সভ্যতা একসময় বিপর্যস্ত হবেই। বিজ্ঞান সভ্যতাও আমাদের বাঁচাতে পারবে না। তাই ধনবান হওয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত না হয়ে মানবিক উত্কর্ষের দিকটা ভাবতে হবে। মানবিক বিকাশই সমাজ-সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখবে।

এ পৃথিবীতে একেক দেশের সরকার ও শাসনব্যবস্থা একেক রকম। মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ দেশগুলোতে রাজতন্ত্র বংশানুক্রমিকভাবে চালু রয়েছে। তবে ঐ সব দেশে রাজপ্রথা থাকলেও সাধারণ মানুষ অধিকারবঞ্চিত নয়। রাষ্ট্রীয় সম্পদের ভাগিদার সবাই। আবার যুক্তরাজ্য ওয়েস্টমিনস্টার পদ্ধতি দ্বারা চালিত একটি সাংবিধানিক রাজতন্ত্র ও সংসদীয় গণতন্ত্র এবং এটি গণতান্ত্রিক সংসদীয় রাজতন্ত্র হিসেবেও পরিচিত। এটি কেন্দ্রীভূত এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র, যেখানে যুক্তরাজ্যের সংসদ সার্বভৌম। নির্বাচিত হাউজ অব কমন্স, মনোনীত হাউজ অব কমন্স মনোনীত হাউজ অব লর্ডস ও ব্রিটিশ রাজমুকুট নিয়ে যুক্তরাজ্যের সংসদ গঠিত। দেশটিতে ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা বিদ্যমান। এখানে দরিদ্রের সংখ্যা নেই বললেই চলে। সুতরাং ধনী-দরিদ্রের বিষয়টি আপেক্ষিক। মানবজাতি যদি মনে করে পৃথিবীতে দরিদ্র থাকবে না, তবে সেটা হতে বাধ্য। গোটা বিশ্বের শাসকগোষ্ঠীকে মানবিক হতে হবে। ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য কমানোর জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা তৈরি করতে হবে আন্তর্জাতিকভাবে। একজন মানুষ কী পরিমাণ অর্থ-সম্পদের মালিক হতে পারবে, তারও একটি সীমারেখা বিধি থাকা জরুরি। তবেই ধনী হওয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতা বন্ধ হবে। অসুস্থ প্রতিযোগিতায় অপরাধ জন্ম নেয়। এই অপরাধ থেকে জাতিকে মুক্ত রাখতে না পারলে মানবসভ্যতা ধ্বংস হয়ে যাবে। সভ্যতার স্বার্থেই মানবজাতিকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ধনী-গরিব নিয়ে যেন আর আলোচনা করতে না হয়।

লেখক : কলাম লেখক ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক

শেয়ার করুন