বর্তমানে বিশ্বব্যাপী আত্মহত্যার প্রবণতা ও হার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশেও এ প্রবণতা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। প্রতিনিয়তই সংবাদপত্রে আত্মহত্যার খবর দেখা যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাবা কিংবা মা সন্তানদের হত্যা করে নিজে আত্মহননের পথ বেছে নেয়। সমাজে প্রতিষ্ঠিত অনেক জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিও সাময়িক হতাশা কিংবা অসুবিধায় বীতশ্রদ্ধ হয়ে আত্মহননের মতো ভুল পথে পা বাড়ান। গবেষক ও অপরাধবিজ্ঞানীরা নানাভাবে এর ব্যাখ্যা দিয়ে থাকেন। আত্মহত্যার অন্যতম কারণগুলো হচ্ছে—বিভিন্ন কারণে হতাশা, ব্যর্থতা, অবহেলিত বা প্রতারিত হওয়া, লোকলজ্জার ভয়, দীর্ঘ অসুস্থতা ইত্যাদি। অনেক কিশোর ও যুবক-যুবতির প্রেমে ব্যর্থতা, ধর্ষণের শিকার হওয়া, একাডেমিক পরীক্ষায় আশানুরূপ ফল করতে না পারা, এমনকি নিকটজনদের সঙ্গে অভিমান করেও আত্মহত্যা করে ফেলে।
বিপজ্জনক ও মর্মান্তিক এ প্রবণতা রোধে করণীয় সম্পর্কে আমাদের সমাজ, অভিভাবক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মিডিয়া—সবারই চিন্তাভাবনা করা প্রয়োজন। এ ব্যাপারে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার প্রসার ও ব্যাপক প্রচারণা একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায় বলে আমি মনে করি।
পৃথিবীর সব ধর্মেরই বিধান হলো—আত্মহত্যা মহাপাপ। আমাদের দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ইসলাম ধর্মাবলম্বী বিবেচনায় আত্মহত্যা বিষয়ে দিন ইসলামের কিছু বিধিনিষেধ কুরআন ও হাদিসের আলোকে জানা প্রয়োজন। সর্বশক্তিমান আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেছেন, ‘তোমরা নিজেদের হত্যা কোরো না, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি পরম দয়ালু এবং যে-কেউ সীমা লঙ্ঘন করে অন্যায়ভাবে তা (আত্মহত্যা) করবে, তাকে অগ্নিতে দগ্ধ করব, এটা আল্লাহর পক্ষে সহজ’ (সুরা আন-নিসা, আয়াত ২৯-৩০)। কুরআনে সুস্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা ঘোষিত হয়েছে, ‘তোমরা নিজের হাতে নিজেদের জীবনকে ধ্বংসের মধ্যে নিক্ষেপ কোরো না (সুরা আল বাকারা, আয়াত :১৯৫)।
যে আত্মহননের পথ বেছে নেয়, তার করুণ পরিণতি সম্পর্কে আমরা ধর্মগ্রন্থের বিভিন্ন বাণী থেকে জানতে পারি। তার রেখে যাওয়া পরিবার যে অবর্ণনীয় কষ্ট ভোগ করে; অপমান, দুর্নাম ও হয়রানির মুখোমুখি হয়, তা খোঁজ নিলেই আমরা দেখতে পাই। ভিকটিম জানে না তার অদূরদর্শী সিদ্ধান্তে তার পরিবার কীরূপ যন্ত্রণা ভোগ করছে এবং সামাজিকভাবে কতটা হেয় হচ্ছে। বেশ কয়েক বছর আগে সরকারের একজন অবসরপ্রাপ্ত সচিব হতাশার কারণে চট্টগ্রামে একটি হোটেল কক্ষে ফাঁসিতে ঝুলে আত্মহত্যা করেন। হোটেল ও আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষ প্রাথমিক পর্যায়ে তার পরিচয় না জেনে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করে। তার স্ত্রী-সন্তানদের জন্য এটি কী দুঃখ ও অপমানের তা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ বুঝতে পারে না। সম্প্রতি এক ব্যক্তি চাকরি হারিয়ে এবং বড় অঙ্কের টাকা ব্যয় করে জমি কিনতে গিয়ে প্রতারিত হয়ে শোকে হতাশায় নিজ ছেলেমেয়েকে হত্যা করে আত্মহত্যা করে। আল্লাহর ইচ্ছায় মেয়েটি বেঁচে যায়। স্ত্রী ও মেয়ে কী বর্ণনাতীত ট্রমা ও সংকটে পড়েছে, তা তো আত্মহননকারী ব্যক্তি চিন্তা করেনি। আর একটি ঘটনায় একজন উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি ঋণ করে পরিশোধ করতে না পেরে আত্মহত্যা করে ‘মুক্তি’ পেতে চেয়েছে। কেউ কেউ আবার ফেসবুকে লাইভে এসে ফাঁসিতে ঝুলে কিংবা ব্রিজ থেকে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। এসব ঘটনা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। অর্থকষ্টে পতিত বা ঋণগ্রস্ত লোক মরে গিয়ে নিষ্কৃতি পেতে চেয়েছে। কিন্তু তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যের যে কীরূপ বোঝা দিয়ে গেল তা সে চিন্তা করেনি। মানুষের জীবন অতি মূল্যবান। সাময়িক আবেগ বা হতাশাকে প্রাধান্য দিয়ে জীবন বিসর্জন দেওয়া কাপুরুষতার শামিল।
প্রকৃত শিক্ষার অভাবে এসব হতভাগা-হতভাগিনী হয়তো আত্মহত্যার মাধ্যমে তার কথিত হতাশা, লজ্জা বা কষ্ট থেকে মুক্তি পেতে চায়; কিন্তু সে জানে না যে মৃত্যুর পরের জীবনে সে দুনিয়ার জীবনের তুলনায় লাখ লাখ গুণ বেশি কষ্ট ভোগ করবে, যে কষ্টের কোনো শেষ নেই, ক্ষমা নেই। আত্মহত্যা একটি অমার্জনীয় অপরাধ। মহান আল্লাহতায়ালা মানুষকে একবারই নির্দিষ্ট সময়ের জন্য পৃথিবীতে পাঠান। আল্লাহর নেয়ামত এ জীবনটাকে মানুষ নিজে শেষ করে দেবে, তা আল্লাহ মোটেও পছন্দ করেন না। মানুষের জীবনে দুঃখকষ্ট, হতাশা, সুখ-শান্তি, সাফল্য ঘুরেফিরে আসবেই। দুঃখ-কষ্ট ও হতাশা, খারাপ সময় ইত্যাদি ধৈর্যের সঙ্গে মোকাবিলা করে আল্লাহর সাহায্য চাইতে হবে। আত্মহত্যা তো দূরের কথা, দুঃখ-কষ্টের কারণে আল্লাহর কাছে মৃত্যু কামনা করাও যাবে না। রসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, তোমাদের কেউ যেন (নির্ধারিত সময়ের আগে) মৃত্যু কামনা না করে। কারণ, (মৃত্যু বিলম্বিত হলে) সে যদি নেককার হয়, তাহলে হয়তো তার নেক কাজের পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে। আর যদি গুনাহগার হয়, তাহলে সম্ভবত সে তার কৃত পাপ (তওবার মাধ্যমে) সংশোধনের সুযোগ পাবে (বুখারি, মুসলিম)। আর এক হাদিসে রয়েছে, জীবন-মৃত্যু সম্পর্কে আল্লাহর দরবারে মানুষের প্রার্থনা যদি করতেই হয় তবে এরূপ হবে—‘হে আল্লাহ! আমাকে ঐ সময় পর্যন্ত জীবিত রাখুন, যতক্ষণ পর্যন্ত জীবন আমার জন্য কল্যাণকর। আর আমাকে তখন মৃত্যুদান করুন, যখন মৃত্যু আমার জন্য কল্যাণকর’ (বুখারি, মুসলিম)।
আল্লাহ সীমা লঙ্ঘনকারীকে পছন্দ করেন না। প্রত্যেক কাজেই সংযমী হওয়া জরুরি। অভিভাবকের লক্ষ রাখতে হবে তার সন্তান যেন ন্যায় ও সত্যের পথে চলে। ক্ষমতা, অর্থ, প্রতিপত্তি কিংবা ষড়িরপুর লোভে পড়ে মানুষ ধ্বংসের দিকে ধাবিত হয়। যুবক-যুবতিরা না বুঝে শয়তানের প্ররোচনায় অসামাজিক কাজে লিপ্ত হতে পারে। তাদের ন্যায়ের পথে ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব অভিভাবক ও সমাজের। সত্, ন্যায়ানুগ ও উন্নত জীবন গঠনের জন্য রাষ্ট্রযন্ত্র, মিডিয়া ও দেশের বুদ্ধিজীবী ও আলেম সমাজ থেকে তাগিদ ও প্রচার-প্রচারণা থাকতে হবে।
কখনো কখনো দেখা যায়, একটি মেয়ে ধর্ষণের শিকার হয়ে লোকলজ্জার ভয়, অপমান ও ধিক্কারে আত্মহত্যা করে। কখনো দেখা যায়, বিয়ের আশ্বাস পেয়ে একজন তরুণী কোনো দুশ্চরিত্র ছেলের ভোগের শিকার হয়ে, প্রতারিত হয়ে স্বেচ্ছামৃত্যু বেছে নেয়। কখনো দেখা যায়, দিনের পর দিন নানামুখী চাপ, হতাশা ও কষ্ট সহ্য করতে না পেরে কেউ আত্মহত্যা করে। প্রকৃত ধর্মীয় শিক্ষা থাকলে কোনো ব্যক্তি আত্মহননের পথ বেছে নেয় না, এমনকি কোনো অসামাজিক কাজেও জড়িয়ে পড়ে না। এসব ক্ষেত্রে যার বা যাদের প্ররোচনা বা অপকর্মের কারণে অপরিণত ও অনাহূত মৃত্যু ঘটে, তারা যদি ক্ষমতার জোরে, কিংবা সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে দুনিয়ার আদালতের বিচার থেকে নিষ্কৃতিও পেয়ে যায়, পরকালে আল্লাহর বিচার থেকে তারা কোনোভাবেই রক্ষা পাবে না। মনে রাখতে হবে, আল্লাহ একদিকে রহমানুর রাহিম (দয়ালু ও ক্ষমাশীল), অন্যদিকে ক্বাহ্হার (মহা পরাক্রমশালী)। কোনো ব্যক্তি তার কৃত অপরাধের জন্য আল্লাহর কাছে তওবা করে ক্ষমা ভিক্ষা চাইলে আল্লাহ মাফ করতেও পারেন। আত্মহত্যাকারী তওবার সময় পায় না, তাই ক্ষমা পাওয়ার প্রত্যাশাও করতে পারে না। পৃথিবীর অশান্তি, হতাশা, অনাচার থেকে আত্মহত্যার মাধ্যমে নিষ্কৃতি পাওয়ার আশা তাই বৃথা। বরং কেউ যদি কৃত ভুলকর্ম থেকে ফিরে এসে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করে, তবে নিশ্চয়ই আল্লাহ তার সহায় হন। কেউ যদি কোনো তৃতীয় ব্যক্তির দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হন, প্রতারিত হন কিংবা আত্মহত্যায় প্ররোচিতও হন, যদি তিনি তার সমস্যাগুলো নিয়ে পরিবারের সদস্য কিংবা নির্ভরযোগ্য বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ করেন এবং পরামর্শ চান, তবে নিশ্চয়ই এর সমাধানের পথ খুঁজে পাবেন। সেজন্য পরিবারের সদস্য, বন্ধুবান্ধব কিংবা আত্মীয়স্বজন এসব ভিকটিম বা হতাশাগ্রস্ত ব্যক্তিদের সান্ত্বনা বা কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে পারেন।
ধর্ষণ, প্রতারণা, নারী নিগ্রহ ইত্যাদির জন্য কঠোর আইন প্রণয়নের পাশাপাশি আইন বাস্তবায়নের দিকে নজর দিতে হবে। এক্ষেত্রে চাক্ষুষ সাক্ষী যেমন গুরুত্বপূর্ণ, এর অবর্তমানে পারিপার্শ্বিক অবস্থাগত সাক্ষ্যসাবুদও ন্যায়বিচারের স্বার্থে গুরুত্বসহকারে আমলে নেওয়া প্রয়োজন।
সন্তান-সন্ততিদের পারিবারিক, ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা দেওয়া শুরু করতে হবে শৈশব থেকেই। আত্মহত্যার ধর্মীয় ও সামাজিক পরিণতি ও কুফল সম্পর্কে মাধ্যমিক স্কুলের আবশ্যিক পাঠ্যতালিকায় একটি পূর্ণাঙ্গ চ্যাপ্টার রাখা যেতে পারে। সর্বোপরি দেশের বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজ ও মিডিয়া গঠনমূলক আলোচনার মাধ্যমে আত্মহননের কুফল বিষয়ে প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে সমাজের এই মারাত্মক ব্যাধির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে এগিয়ে আসতে পারেন।
লেখক : সাবেক সিনিয়র সচিব এবং এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান। বর্তমানে জার্মানিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত