সম্প্রতি দুবাই শহরের এক দুর্দশা দেখল বিশ্ববাসী। গত ১৬ এপ্রিল ভারী বৃষ্টিতে শহরটির প্রধান সড়ক বড় এক নদীর রূপ নেয়। সেখানকার বিমানবন্দর সড়কটিতে এত পানি জমে যে মনে হয়, সেখানে গাড়ি চলার পরবর্তে জাহাজ চালানো যাবে! এত বৃষ্টি কি প্রাকৃতিকভাবে ঘটল, নাকি কৃত্রিম মেঘ থেকে বৃষ্টি ঝরানো হলো, তা নিয়ে জনমনে সংশয় রয়ে গেছে। খবর দ্য ইকোনমিস্টের।
গত মাসে দুবাই শহরে ১৪২ মিলিমিটার (৫ দশমিক ৬ ইঞ্চি) বৃষ্টি হয়। শহরটিতে বার্ষিক যে পরিমাণ বৃষ্টি হয়, তার চেয়ে একদিনেই দেড় গুণ বেশি বৃষ্টি হয়। এই বৃষ্টিতে বিমানবন্দরের রানওয়ে ডুবে গিয়েছিল। ফলে হাজার হাজার যাত্রীকে বিশ্বের ব্যস্ততম আন্তর্জাতিক এই বিমানবন্দরে আটকা পড়তে হয়। কয়েক দিন ধরে পানি সড়কে থাকায় রাস্তায় গাড়ি চলতে পারেনি। দুবাইয়ের মতো সংযুক্ত আরব আমিরাতের অন্যান্য শহরের পরিস্থিতিও একই রকম দাঁড়ায়। বাড়ি ফিরতে না পেরে অনেক কর্মী ও ক্রেতাকে শপিং মলের মেঝেতেই ঘুমাতে হয়েছে।
দুবাইয়ের মতো শহর ১০০ বছরে একবার এ ধরনের পরিস্থিতিতে পড়তে পারে, এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। তবে আশ্চর্যের বিষয় দুবাই শহরটি ঠিকঠাক পরিচ্ছন্ন রাখা হয়। কিন্তু বন্যা পরিস্থিতির পর কী ঘটেছে, তা স্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়নি। সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদের (জিসিসি) ছয়টি সদস্য দেশে নানা ক্ষেত্রে তথ্য জনসম্মুখে আনা হয়ে থাকে খুব কমই।
প্রতিবেশী দেশগুলোর মতোই সংযুক্ত আরব আমিরাত এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু না জানানোর চেষ্টা করে। সেখানকার গণমাধ্যমগুলোও কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। সেখানকার সরকারের সমালোচনার বিষয়ে নিরুৎসাহিত করা হয়। এ ধরনের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের পক্ষ থেকে যে বিবৃতি দেওয়া হয়, তা সব সময়ই ইতিবাচক থাকে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে দেশগুলোর নাগরিক ও বিদেশিরাও তাতে সন্তুষ্ট থাকেন।
সংযুক্ত আরব আমিরাত অবকাঠামো, স্বাস্থ্যসেবা ও ই-গভর্নমেন্টের দিক থেকে বৈশ্বিক র্যাংকিংয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে। কোভিড মহামারির বিষয়টি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও অন্যান্য দেশের তুলনায় দেশটি ভালো করেছিল। এখানকার অপরাধের হারও কম।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের ক্লাউড সিডিং বা কৃত্রিম মেঘ থেকে বৃষ্টি ঝরানোর এক বিশেষ কর্মসূচি রয়েছে। উড়োজাহাজ ও ড্রোনের মাধ্যমে রাসায়নিক প্রয়োগ করে মেঘ থেকে বৃষ্টি ঝরানো হয় এখানে। তবে এ প্রযুক্তি সঠিকভাবে কাজ করে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়ে গেছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত তাদের এ পদ্ধতিটি নিয়ে গর্ব করে থাকে। তারা প্রকৃতির ওপর ছড়ি ঘোরানোর বিষয়টিকে নিজেদের ব্র্যান্ড হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকে।
আরব আমিরাতের অনেক নাগরিক বিশ্বাস করেন, কৃত্রিম বৃষ্টি কবে, কখন ঝরবে, সে সিদ্ধান্ত নেন দেশের রাজধানী আবু ধাবির কর্মকর্তারা। গত মাসে কৃত্রিম বৃষ্টি নিয়ে আলোচনার মধ্যেই ব্যাপক বৃষ্টির ঘটনাটি ঘটে। এতে অনেকের ঘরবাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে বন্যার পানি ঢুকে পড়ে।
সরকারের তরফে জানানো হয়, বৃষ্টি ঝরাতে ক্লাউড সিডিং পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়নি। বিজ্ঞানীদের মধ্যেও এ নিয়ে সংশয় আছে। কারণ, ক্লাউড সিডিং করে এত ব্যাপক বৃষ্টি আদৌ সম্ভব কি না, সে বিষয়ে তারা নিশ্চিত নন। তাদের ধারণা, এ ক্ষেত্রে যদি মানবসৃষ্ট কোনো কারণ থেকে থাকে, তবে তা হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন। তবে ক্লাউড সিডিং কর্মসূচি নিয়ে দেশটির স্বচ্ছতার ঘাটতি নিয়ে অনেক নাগরিকের মনে সংশয় রয়েছে। তাদের মনে প্রশ্ন উঠেছে, এর পেছনে সরকারের কোনো সিদ্ধান্ত কি থাকতে পারে?
বন্যা পরিস্থিতির কয়েক দিন পরেই আমিরাতের নাগরিকদের হোয়াটসঅ্যাপে বেশ কিছু বার্তা ছড়িয়ে পড়ে। তাতে সতর্ক করে বলা হয়, দূষিত পানির কারণে নানা রোগ ছড়িয়ে পড়ছে। এরপর সরকারি কর্মকর্তাদের এ নিয়ে নিশ্চয়তা দিতে দেখা যায়।
দুবাই স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ ২৪ এপ্রিল জানায়, পরিস্থিতি স্বাভাবিক। কারও অসুস্থতার কোনো খবর পাওয়া যায়নি। তবে একই দিন কয়েকটি স্থানীয় সংবাদপত্রে চিকিৎসকদের বরাতে জানানো হয়, দেশটিতে পানিবাহিত নানা রোগের বড় ধরনের প্রার্দুভাব ঘটেছে।
শাসনব্যবস্থা ভালো হলে তা নিয়ে কেউ খুব একটা চিন্তা করে না। কিন্তু যখন কোনো পরিবর্তন ঘটে বা যখন কিছু ভুল হয়ে যায়, তখন অস্বচ্ছ সরকারের পক্ষে তাদের প্রজাদের আস্থা ধরে রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। সৌদি আরব রক্ষণশীল সমাজ থেকে বের হয়ে আসার এবং তেলনির্ভর অর্থনীতিকে বৈচিত্র্যময় করার চেষ্টা করছে।
সৌদির এ উদ্যোগের কেন্দ্রে রয়েছে নিওম নামের একটি স্মার্ট সিটি বা ভবিষ্যৎ শহর। দেশটির উত্তর পশ্চিমে ওই শহরটি গড়ে তোলার পরিকল্পনা করা হয়েছে। এই শহরের একটি ফ্ল্যাগশিপ প্রকল্প হচ্ছে দ্য লাইন। শুরুর দিকের নকশায় দেখা গেছে, এটি হবে মরুর বুকে কাচে তৈরি কাঠামো, যা প্রস্থে ২০০ মিটার আর দৈর্ঘ্যে ১৭০ কিলোমিটার। সৌদি আরব বলেছে, এই শহরে গাড়ি চলবে না, জ্বালানি আসবে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে। শহরে ২০৩০ সালের মধ্যে বাস করবে ১৫ লাখ মানুষ।
কর্তৃপক্ষ প্রকাশ্যে বলছে, তাদের প্রকল্প পরিকল্পনামাফিক এগোচ্ছে। কিন্তু অনেকেই কানাঘুষা করছেন, ২০৩০ সাল নাগাদ মাত্র কয়েক কিলোমিটার দ্য লাইন তৈরি করা সম্ভব হবে। বাকি কাজ শেষ করতে কয়েক দশক লেগে যাবে। কয়েক মাস পর থেকে নিওমের বন্ড বিক্রি শুরু হবে। ধারণা করা হচ্ছে, ১০০ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি অর্থ এখান থেকে তোলা হবে। এখন বিনিয়োগকারীদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, যেভাবে বিজ্ঞাপন থেকে নিওমকে বড় আকারে দেখানো হয়েছে, তার চেয়ে অনেক ছোট প্রকল্পে তারা বিনিয়োগ করবেন কি না।
সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান দেশটিতে বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে আরও বেশ কিছু পরিকল্পনা করেছেন। ২০২১ সালে তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, রিয়াদের জনসংখ্যা এক দশকে দ্বিগুণ হয়ে যাবে। ৭৫ লাখ থেকে সেখানে ১ কোটি ৫০ লাখ জনসংখ্যা হতে পারে। তবে গত মাসে সৌদি কর্মকর্তারা বলেছেন, তাদের লক্ষ্য হচ্ছে, জনসংখ্যা এক কোটির মধ্যে রাখা। এতে রিয়াদে যারা আবাসন খাতে বিনিয়োগ করেছিলেন, তারা হতাশ হয়েছেন।
যুবরাজের আরেকটি উদ্যোগ হচ্ছে, সৌদিতে অ্যালকোহলকে বৈধতা দেওয়ার প্রস্তুতি। কিন্তু এ পদক্ষেপ থেকেও তাদের সরে আসতে হতে পারে। কিন্তু পরিস্থিতি যা–ই হোক না কেন, কেউ না কেউ হতাশ হবেন। তবে কখন, কী সিদ্ধান্ত নেবে, তা কেউ জানেন না। এ বিষয়ে কিছু বলারও নেই।
উপসাগরীয় দেশগুলোতে দ্রুত পরিবর্তন ঘটছে। কিছু পরিবর্তন দেশগুলোর ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তিরা নিজেরাই করছেন। তারা বিদেশি মেধাবীদের আকৃষ্ট করতে ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য এ পরিবর্তনের চেষ্টা করছেন। তবে যেটা এখন দরকার, সেটা হচ্ছে, দেশের বাসিন্দাদের দ্রুত সরকারি বিবৃতির বাইরে কিছু জানার প্রয়োজন আছে কি না, সেটা ঠিক করতে হবে। জিসিসির দেশগুলোর অনেক কর্মকর্তাই কয়েক দশক ধরে ভালো শাসনব্যবস্থা গড়ে তুলে যে বিশ্বস্ততা অর্জন করেছেন, তা নিয়ে গর্ব করেন। কিন্তু এই গর্ব ধরে রাখতে তাদের আরও স্বচ্ছতার প্রয়োজন।