বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুকে এখন আর অস্বাভাবিক কোনো বিষয় হিসেবে দেখা হয় না। বলা যায়, অন্য অনেক বিষয়ের মতো এটিও আমাদের গা সওয়া সংস্কৃতিতে পরিণত হয়ে গেছে। লেখা বাহুল্য যে, সড়ক দুর্ঘটনা আজকাল আমাদের জাতীয় জীবনের অন্যতম উদ্বেগ হিসেবে দাঁড়িয়েছে। পত্র-পত্রিকার পাতা ও টেলিভিশনের পর্দায় সম্প্রচারিত খবরে সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যুর সংবাদ থাকবেই। মানুষের জীবনের মূল্য যেখানে সবকিছুর চেয়ে বেশি, সেখানে আমাদের সড়কগুলোতে একের পর এক তরতাজা জীবনপ্রদীপ নিভে যাচ্ছে অবলীলায়!
জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন কর্মসূচির ১১.২ নম্বর অভীষ্টেও নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থাপনার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে :অরক্ষিত পরিস্থিতির মধ্যে বসবাসকারী জনগোষ্ঠী, নারী, শিশু, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ও প্রবীণ মানুষের চাহিদার প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রেখে প্রধানত রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত যানবাহনের সম্প্রসারণ দ্বারা সড়ক নিরাপত্তাব্যবস্থা উন্নতিসাধনের মাধ্যমে ২০৩০ সালের মধ্যে নিরাপদ, সাশ্রয়ী, সুলভ ও টেকসই পরিবহনব্যবস্থায় সবার প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা।
সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু ও আহতের দুই রকমের পরিসংখ্যান রয়েছে : একটি সরকারি, অন্যটি বেসরকারি। উভয় হিসাব অনুসারেই সড়কে প্রাণহানি বাড়ছে। সরকারি হিসাব সংরক্ষণ করে বিআরটিএ। তাদের হিসাবমতে, ২০২৩ সালে সড়কে ৫ হাজার ২৪ জনের মৃত্যু হয়েছে আর আহতের সংখ্যা ৭ হাজার ৪৯৫। বেসরকারি সংস্থা রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের হিসাব অনুযায়ী ২০২৩ সালে মৃত্যু হয়েছে ৬ হাজার ৫২৪ জনের এবং আহতের পরিমাণ ১১ হাজার ৪০৭।
বিআরটিএ’র হিসাবমতে, এবারের ঈদযাত্রায় (৪-১৮ এপ্রিল) ৩২০ জনের মৃত্যু হয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় প্রায় ১৯ শতাংশ বেশি। পক্ষান্তরে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের সমীক্ষায় একই সময়সীমায় ৪৬৭ জনের মৃত্যু হওয়ার পরিসংখ্যান রেকর্ড করা হয়েছে। উল্লেখ্য, গত বছরের ঈদ যাত্রায় প্রাণ হারানো লোকের সংখ্যা ছিল ২৮৫ জন। বিআরটির তথ্যমতে, বৈধ-অবৈধ, যান্ত্রিক ও অযান্ত্রিক মিলে দেশের সড়ক ও মহাসড়কে ৫০ ধরনের বেশি যান চলাচল করে। ২০২৩ সালে যেসব দুর্ঘটনা ঘটেছে, এর সঙ্গে অন্তত ৪৭ ধরনের যানবাহনের সম্পৃক্ততা পেয়েছে বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট। বিশ্লেষণে এসেছে, গত বছর প্রায় ২৬ শতাংশ দুর্ঘটনার সঙ্গে মোটরসাইকেলের সংশ্লিষ্টতা ছিল। ট্রাকের ক্ষেত্রে এই হার প্রায় ১৭ শতাংশ, বাস ১৬ শতাংশ, অটোরিকশা ৭ শতাংশ এবং পিকআপ ও কাভার্ড ভ্যানের সংশ্লিষ্টতা প্রায় ৮ শতাংশ।
সড়কে সংঘটিত প্রতিটি দুর্ঘটনার পেছনে ফিটনেসবিহীন যানবাহন, লাইসেন্সবিহীন চালক, ক্লান্তি ও ঘুম নিয়ে গাড়ি চালানো এবং অবৈধ ও মেয়াদোত্তীর্ণ যান প্রভৃতিই আমাদের সড়ক দুর্ঘটনা ঘটার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কারণ। আমাদের সড়কগুলো অবকাঠামোর দিক থেকে ব্যাপকভাবে উন্নত হয়েছে?এ কথা যেমন অনস্বীকার্য, তেমনি সড়ক ব্যবস্থাপনায় যে আমরা এখনো অত্যন্ত দুর্বল জায়গায় রয়ে গেছি সেটিও তেমনই বাস্তব। ভারী যানবাহন চলাচল করার জন্য সড়কে যে ধরনের লেন থাকার কথা, তা অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের দেশে নেই। ফলে হালকা গাড়িগুলো অনেক সময় ভারী যানবাহনগুলোকে বারবার ওভারটেক করার বেপরোয়া চেষ্টা করে। আর তখনই দেখা যায় সড়কে সংঘর্ষ ও দুর্ঘটনার বীভত্স চিত্র!
নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের উদাসীনতা ও দায়সারা গোছের দায়িত্ব পালনকেও সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায় নেওয়া উচিত। নীতিনির্ধারকদের মধ্যে এমন একটা আত্মতৃপ্তি চলে এসেছে যে, তারা সড়ক, মহাসড়ক, সেতু ও এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করে দেশকে উন্নয়নের মহাসড়কে উন্নীত করে ফেলেছে। কিন্তু এই নির্মিত অবকাঠামো তথা সড়কগুলোকে নিরাপদ করার জন্য যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার, সে ব্যাপারে কতটুকু কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে? পৃথিবীতে এমন কোনো দেশ নেই, যেখানে আমাদের দেশের মতো গণহারে ফিটনেস সনদ দেওয়া হয়। বিস্ময়ে থ হয়ে যাওয়ার কথা, ফিটনেস সনদ নেওয়ার প্রয়োজনই অনুভব করেন না? এ দেশে এমন মালিকের সংখ্যাটাও উল্লেখ করার মতো। অধিকন্তু, তাঁদের জানা রয়েছে যে, সড়ক ও মহাসড়কে বিভিন্নভাবে ম্যানেজ করে চলা যায়। অবকাঠামো খাতে বড় ধরনের বিনিয়োগ হওয়ার কারণে অবকাঠামো উন্নয়নের কাজে আমরা প্রতিনিয়তই হুমড়ি খেয়ে পড়ি। পক্ষান্তুরে, সড়কে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা, নৈরাজ্য ঠেকানো ও মানুষকে জিম্মিদশা থেকে রেহাই দেওয়ার জন্য যেসব কাজ করার কথা, তার কোনোটিতেই যেন নীতিনির্ধারকদের নজর নেই। কেননা, এসব কাজ হলো দরদের সঙ্গে করার কাজ। তাই পরিস্থিতিটা দাঁড়িয়েছে এমন যে, যেখানে বিনিয়োগ নেই, সেখানে কেবল দরদ ও আন্তরিকতা প্রয়োজন, সেখানে আমাদের নীতিনির্ধারণী মহল আগ্রহ বোধ করে না। তাদের মধ্যে একটা ভুল ধারণাও প্রচলিত : সড়কে দুর্ঘটনা কমানোকে একটা স্বল্পকালীন প্রকল্প বলে মনে করেন তাঁরা।
মোটরসাইকেলের মতো যান আমাদের সড়কের উচ্ছৃঙ্খল ও বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিকে আরো নাজুক করে তুলেছে। প্রচলিত মোটরসাইকেলগুলো আমাদের সড়কের জন্য উপযোগী কি না, এসব গাড়ি চলাচলের জন্য সড়কে আলাদা লেন আছে কি না, মোটরসাইকেল চালকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা আছে কি না, ড্রাইভিং লাইসেন্স কতটুকু বৈজ্ঞানিক ও আধুনিকায়ন করা হয়েছে—এসব বিষয় যেন আমলে নেওয়ারই প্রয়োজন বোধ করেন না তারা। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় হতাহত লোকজনের মধ্যে ১৫-১৮ বছর বয়াসি কিশোর ও তরুণের সংখ্যাই সর্বাধিক। কোনোভাবেই এদের ড্রাইভিং সনদ থাকার কথা নয়। অভিভাবকদের নজরদারির অভাব ও অসচেতনতার দরুন এসব কিশোর ও তরুণ মহাসড়কে মহাসড়কে রেসিং ট্র্যাক বানিয়ে প্রতিযোগিতায় নামেন। পরিণামে অকালেই তাদের প্রাণ ঝরে পড়ছে, আবার কেউ- বরণ করে নিচ্ছেন পঙ্গুত্ব।
সড়ক পরিবহন আইন জানা ও মানার শুরুটা হওয়া উচিত পরিবহন মালিকদের কাছ থেকেই। পরিবহন মালিকদের মানানোর জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছার বাস্তবায়ন এক্ষেত্রে অতীব জরুরি। এজন্য পরিবহন মালিকদেরই আন্তরিক ও মানবিক বৈশিষ্ট্য ধারণ করে উদ্যোগী হতে হবে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরসমূহের মধ্যে ব্যাপকতরভাবে সমন্বয় করে কাজ করলে নিশ্চয় এর সুফল ও প্রভাব সুষ্ঠু সড়ক ব্যবস্থাপনাকে ত্বরান্বিত করবে। সড়কে শৃঙ্খলা ও ব্যবস্থাপনা আনয়নে সুশাসন নিশ্চিতকরণ ও আইনের প্রয়োগের চেয়ে ভালো বিকল্প নেই। পাশাপাশি সড়কে দুর্ঘটনা ঘটার পরে দায় না নেওয়ার যে প্রবণতা চালু হয়েছে আমাদের দেশে, এই দায়হীনতার সংস্কৃতি থেকেও আমাদের বের হয়ে আসতে হবে।
লেখক : অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়