দেশকে নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত করা এবং সমাজের সর্বস্তরের শিশু-কিশোরদের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিতকরণ প্রসঙ্গে যখন লিখছি, তখন চির নতুনেরে ডাক দেওয়া পঁচিশে বৈশাখের আলোয় উদ্ভাসিত শিক্ষিত, সচেতন বাঙালির মনোলোক। লেখা থেকে অবচেতন মন চলে গেল রবীন্দ্রনাথের সুদূরপ্রসারী, কালজয়ী শিক্ষাভাবনার দিকে। শতবর্ষের অধিক কাল আগে তিনি ভেবেছেন, ‘শিক্ষা হবে সর্বজনীন এবং তা সব মানুষের মৌলিক অধিকার। যেখানে সবার সামনে থাকবে মাতৃভাষা ও মাতৃভূমি।…শিক্ষায় মাতৃভাষাই মাতৃদুগ্ধ।’
অথচ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় মাতৃভাষা শিক্ষার যে দৈন্যদশা এবং শিক্ষা যে মানুষের মৌলিক অধিকার, স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও শতভাগ মানুষের শিক্ষার সেই অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে না পারার আক্ষেপ তো এমন প্রসঙ্গে বিশ্বকবিকে স্মৃতিতে আনবেই।
মানুষের মৌলিক অধিকার হিসেবে সর্বজনীন শিক্ষার বাস্তবায়ন যেমন জরুরি, তেমনি সর্বস্তরের মাতৃভাষায় পাঠদান নিশ্চিত করার বিষয়টিও উন্নত জাতি গঠনের অপরিহার্য শর্ত। জাপান ভ্রমণের অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি তার পুত্রের কাছে লেখা এক চিঠিতে জাপানের বিস্ময়কর উন্নয়নে মাতৃভাষায় শিক্ষা এবং কর্মমুখী কারিগরি শিক্ষার যে প্রভাব, তা জানিয়েছিলেন অত্যন্ত আবেগঘন ভাষায়।
মাতৃভাষার বাইরে অন্য ভাষা শিক্ষার প্রয়োজনীয়তাও তিনি অস্বীকার করেননি। বরং ভেবেছেন দুটোই পরস্পর পরিপূরক। তাই তো লিখেছেন :‘আপনাকে ত্যাগ করিয়া পরকে চাহিতে যাওয়া যেমন নিষ্ফল ভিক্ষুকতা, পরকে ত্যাগ করিয়া আপনাকে বঞ্চিত রাখা তেমনি দারিদ্র্যের চরম দুর্গতি।’
শিক্ষার মধ্য দিয়ে শুধু জ্ঞান অর্জনই নয়, তিনি সর্বজনীন কর্মমুখর উত্পাদনশীল সমাজ গড়ে তোলার সহায়ক উপকরণও ভেবেছেন শিক্ষাকে। ‘এইসব ম্লানমুখ মূক মুখে দিতে হবে ভাষা/ ধ্বনিয়া তুলিতে হবে আশা…’ কেবল কবিতার জন্যই লেখেননি, এ ছিল তার বিশ্বাস।
এ কারণে পুত্রকে কৃষিবিজ্ঞান পড়ানোর জন্য বিদেশে পাঠিয়েছিলেন। মহাজনের সুদে জর্জরিত বাংলার কৃষক এবং কৃষির উন্নয়নের জন্য কৃষিব্যাংক স্থাপন করেছিলেন নোবেল পুরস্কারের টাকা ব্যয় করে।
না, এ লেখার মূল উদ্দেশ্য বিশ্বকবির শিক্ষাভাবনার বিশ্লেষণ নয়। প্রসঙ্গক্রমেই এসেছে আমাদের চলমান শিক্ষাব্যবস্থা আর কবিগুরুর শিক্ষাভাবনার কথা।
শিক্ষার সর্বস্তরে মাতৃভাষায় শিক্ষাদান আমরা এখনো করতে পারিনি। কর্মমুখী শিক্ষারও আশানুরূপ বিকাশ ঘটেনি। এ কথা সত্য যে, ১৯৭১-এ মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশ গত ৫৩ বছরে শিক্ষা ক্ষেত্রে বহু পথ হেঁটেছে। শিক্ষিতের হার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা, শিক্ষকের সংখ্যারও ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটেছে, যা অতীতের চেয়ে বহুগুণ। কিন্তু ১৯৭৫-এর পরবর্তীকাল থেকে ধীরে ধীরে কমেছে শিক্ষার মান। সন্ত্রাস চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে শিক্ষাঙ্গনে। গণআদর্শ ছেড়ে দলীয় লেজুড়বৃত্তি করছে ছাত্র সংগঠন। এ কারণে শিক্ষার মান সাম্প্রতিক কালে উদ্বেগজনক পর্যায়ে নিচে নেমে গেছে।
এই বাস্তবতার মধ্যেই আলোকপাত করতে চাই বিদ্যালয়বহির্ভূত শিশু-কিশোরদের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করা এবং তাদের মানবসম্পদে রূপান্তরের প্রসঙ্গে। চার দিন আগে শিক্ষাবিষয়ক একটি সেমিনারে যোগদানের আমন্ত্রণ পাই এবং সে সংক্রান্ত একটি ধারণাপত্রও। তাতে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর করা ২০২৩ সালের একটি প্রতিবেদন থেকে কিছু তথ্য উদ্ধৃত করা হয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে :বর্তমানে দেশে পাঁচ থেকে ২৪ বছর বয়সি মানুষের মধ্যে ৫৯ দশমিক ২৮ শতাংশ আনুষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করছে। বাকি ৪০ দশমিক ৭২ শতাংশ রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে। বর্তমানে শিক্ষাঙ্গন থেকে ঝরে পড়ার হার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ১৩ দশমিক ৫৫ শতাংশ ও মাধ্যমিকে ৩৫ দশমিক ৯৮ শতাংশ। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে এই হার আরো অনেক বেশি।
দেশের পাঁচ থেকে ২৪ বছর বয়সিদের মধ্যে ৪০ শতাংশের অধিক যদি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে থেকে যায়, তাহলে তো উদ্বেগেরই কথা। তারুণ্যের চরম অপচয় বৈকি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, দেশে বর্তমানে সাক্ষরতার হার ৭৪ দশমিক সাত শতাংশ এবং নিয়োগ উপযোগী বেকারের সংখ্যা ২৪ লাখ ৩০ হাজার।
যেখানে তথ্যপ্রযুক্তিতে অগ্রসর ডিজিটাল বাংলাদেশ আজ উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে উন্নীত এবং আগামী দেড় দশকের মধ্যে উন্নত, সমৃদ্ধ দেশের লক্ষ্যে পৌঁছে যাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা পোষণ করছে, সেখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরে থেকে যাবে ৪০ শতাংশ শিশু-কিশোর, তরুণ!
নানাবিধ কারণে অনেক শিক্ষার্থী এখনো প্রাথমিক স্তর সমাপ্ত করার আগেই বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ে। এই ঝরে পড়া ঠেকানোর লক্ষ্যে নানামুখী উদ্যোগও রয়েছে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে হয় যে, ৯০-এর দশকের শুরু থেকে এ যাবত্ অর্থাত্ গত প্রায় তিন দশকের অধিক সময়ে উল্লেখযোগ্য যে কাজগুলি হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে, প্রাথমিক শিক্ষা আইন প্রণয়ন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শতভাগ শিক্ষার্থীকে উপবৃত্তির আওতায় আনা, সারা দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ‘মিড-ডে মিল’ চালুর উদ্যোগ এবং আট থেকে ১৪ বছর বয়সি ঝরে পড়া ও ভর্তি না হওয়া শিশুদের জন্য উপানুষ্ঠানিক শিক্ষাধারায় ‘আউট অব স্কুল চিলড্রেন এডুকেশন প্রোগ্রাম’ চালু করা।
এসব উদ্যোগের পাশাপাশি উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর মাধ্যমে ঝরে পড়া শিশুদের শিক্ষায় দ্বিতীয় বার সুযোগ বা ‘সেকেন্ড চান্স এডুকেশন’ দেওয়ার জন্য উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় বিদ্যালয়বহির্ভূত অর্থাত্ ঝরে পড়া এবং ভর্তি না হওয়া আট থেকে ১৪ বছর বয়সি ১০ লাখ শিশুকে প্রাথমিক শিক্ষার সমমানের শিক্ষা গ্রহণ ও সমাপনের পর কারিগরি ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে দক্ষ নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ রয়েছে।
‘আউট অব স্কুল চিল্ড্রেন এডুকেশন প্রোগ্রাম’- এর আওতায় ভবিষ্যত্ প্রজন্মকে দক্ষ নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতেই এই লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এ লক্ষ্যে ৬১টি জেলার ৩৪৪টি নির্বাচিত উপজেলা ও ১৫টি শহরে ২৫ হাজার ৮১৫টি শিখন কেন্দ্রের মাধ্যমে ৮ লাখ ১৭ হাজার ২৭৯ জন শিক্ষার্থী বালক-বালিকাকে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রদানের জন্য ৫৩টি এনজিওকে সহায়ক সংস্থা হিসেবে নির্বাচন করা হয়েছে, যা দেশের নিরক্ষরতা দূরীকরণ ও এসডিজির অভীষ্ট লক্ষ্য (‘বাদ যাবে না কেউ’) অর্জনে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
কিন্তু চলতি বছরের ডিসেম্বর এই প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। এই বিশেষ শিক্ষাসংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ‘প্রকল্পভিত্তিক স্বল্পমেয়াদি এই কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা থাকে না বলে এ শিক্ষা প্রায়ই টেকসই হয় না এবং অধিকাংশ শিক্ষার্থীর তেমন কোনো কাজে আসে না।
এ অবস্থায় সচেতন মহলে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে—ঐ ৯ লাখ শিশুর শিক্ষার ভবিষ্যত্ কী হবে? তারা কি চর্চার অভাবে পুনরায় নিরক্ষরতার অন্ধকারে হারিয়ে যাবে?
শিক্ষার প্রতি অনুরাগ এবং দীর্ঘকাল গণমাধ্যমের একজন সক্রিয় কর্মী হিসেবে প্রশ্নটি আমাকেও ভাবিয়েছে। এ প্রসঙ্গে কিছু কথা না বলে উপায় নেই। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গত প্রায় দেড় যুগে বর্তমান সরকার দেশে নানা ক্ষেত্রে উন্নয়নের যে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, তার কোনো তুলনা নেই। শুধু নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল উড়ালসড়ক নির্মাণই নয়, টেকসই উন্নয়ন বাস্তবায়নে প্রসূতি ও শিশুমৃত্যুহার রোধের আন্তর্জাতিক সাফল্য, স্বীকৃতি কিংবা নারীর ক্ষমতায়নসহ বহু ক্ষেত্রের বিশ্ববাসীর কাছে দৃষ্টান্তমূলক সাফল্যের কথা উল্লেখ করা যায়। কিন্তু দুর্নীত, লুটপাট-অপসংস্কৃতির যে নিয়ন্ত্রণহীন পরিস্থিতি, তাতে সাফল্যের পথে এখনো অনেক কাঁটা বিছানো।
সবাই জানি, আজ বাংলাদেশ যে যোগাযোগ প্রযুক্তির ক্ষেত্রে এত অগ্রসর, তার মূলে কাজ করেছে বাংলাদেশকে ডিজিটাইজেশন করা, যা ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনি অঙ্গীকার ছিল। ঐ পথ ধরেই প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্ন—দেশকে স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তরের। ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত সমৃদ্ধ স্মার্ট বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য অর্জনে ইতিমধ্যেই নানা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। কিন্তু দেশের আট থেকে ২৪ বছর বয়সিদের ৪০ শতাংশ তারুণ্যকে সাক্ষরতা ও কর্মমুখী প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মানবসম্পদে রূপান্তরিত করা না গেলে উন্নত, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়া যে দুরূহ হয়ে পড়বে, এ সত্যও সবার আগে উপলব্ধি করবেন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শুধু প্রধানমন্ত্রী উপলব্ধি করলেই হবে না, শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সরকারের সংশ্লিষ্ট সব মহলকেই গুরুত্বের সঙ্গে তা উপলব্ধি করতে হবে। মূলধারার শিক্ষার পাশাপাশি চলমান রাখতে হবে শিক্ষার বিকল্প পথটাও।
বিশ্বকবির শিক্ষাচিন্তার আলোয় এ লেখা শুরু করেছিলাম, শেষেও তার কাছেই। রাশিয়ার চিঠি যারা পড়েছেন, তাদের মনে পড়বে তার সেই গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য :‘আমাদের সকল সমস্যা সমাধানের সবচেয়ে বড় রাস্তা হচ্ছে শিক্ষা। এতকাল সমাজের অধিকাংশ লোক শিক্ষার পূর্ণ সুযোগ থেকে বঞ্চিত—ভারতবর্ষ তো প্রায় সম্পূর্ণই বঞ্চিত। এখানে (রাশিয়া) সেই শিক্ষা যে কী আশ্চর্য উদ্যমে সর্বত্র ব্যাপ্ত হচ্ছে, তা দেখলে বিস্মিত হতে হয়। শিক্ষার পরিমাণ শুধু সংখ্যায় নয়, তার সম্পূর্ণতায়, তার প্রবলতায়।’
আমাদের সমাজেও নিষ্কর্মা মানুষ নিরক্ষরতামুক্ত হয়ে কর্মমুখী শিক্ষার আশ্রয়ে কর্মমুখর উত্পাদনশীল হয়ে উঠুক, বাংলাদেশ হয়ে উঠুক বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের মতোই সত্যিকারের সোনার বাংলা, এই তো প্রত্যাশা।
লেখক : বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি ও সিনিয়র সাংবাদিক