সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কঠোর না হলে শুধু ধর্মীয় সংখ্যালঘুরাই নয়, যারা মানবিক বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে সরকারকে সহায়তা করছে তাদের সবার জন্য দুঃখের কাল অপেক্ষা করছে বলে মনে করেন বিশিষ্টজনরা। তারা বলেছেন, সাংস্কৃতিক আন্দোলনের দুর্বলতায় সামাজিক সাম্প্রদায়িকতা বেড়েছে। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণে প্রশাসনিক সাম্প্রদায়িকতা বড় বাধা। এই প্রেক্ষাপটে জঙ্গিবাদের মতোই সাম্প্রদায়িকতা নির্মূলে সরকারকে শক্ত হতে হবে। সকল রক্ত, চক্ষু উপেক্ষা করে উপড়ে ফেলতে হবে মৌলবাদের বিষবৃক্ষ। অন্যথায় পাকিস্তানের মতো বাংলাদেশের পরিণতি বরণ করতে হবে বলেও মনে করেন তারা।
এই প্রেক্ষাপটে সংখ্যালঘুদের অধিকার বাস্তবায়নে সামাজিক, রাজনৈতিকসহ সকল অসাম্প্রদায়িক শক্তির ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা প্রয়োজন বলেও মনে করেন তারা। জাতীয় প্রেস ক্লাবে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের ৩৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আজ শুক্রবার ‘অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ : চ্যালেঞ্জ ও করণীয়’ শীর্ষক আলোচনায় অংশ নিয়ে বক্তারা এসব কথা বলেন।
জন্মনিয়ন্ত্রণ ও দেশত্যাগের কারণে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ কমছে দাবি করে সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে ভূমিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ বলেন, দেশে এখন সাম্প্রদায়িকতা কঠিন অবস্থায় চলে গেছে। ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়ানো হচ্ছে। মানবিকতা দূর হচ্ছে। ধর্মান্ধরা সমাজকে পেছনে নিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, মেজোরিটির দিকে তাকিয়ে সরকার ইচ্ছা করলেও সংখ্যালঘুদের সুরক্ষায় অনেক কিছু করতে পারে না। বাস্তবতা এমন হয়েছে, মানুষের অধিকারের কথা বলতে গেলেও সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিতে দেখা হয়।
তিনি বলেন, আমরা ছেলেমেয়েদের যেন ভারতে না পাঠাই। দাবি আদায়ে প্রগতিশীল মানুষ ও বুদ্ধিজীবীসহ সকলের ঐক্যের মধ্য দিয়ে সামাজিক সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ঘটাতে পারলে সাম্প্রদায়িকতা কমবে। স্বাগত বক্তব্যে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাণা দাশগুপ্ত বলেন, দেড় দশক ধরে মুক্তিযুদ্ধের সরকার ক্ষমতায় থাকলেও রাষ্ট্র, প্রশাসন, সমাজ সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের দখলে চলে গেছে। প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলসমূহের অনেকেই সাম্প্রদায়িক মানসিকতায় দুষ্ট।
তিনি বলেন, অসাম্প্রদায়িকতার কথা মুখে বলা হলেও অন্তরে, রাজনীতিতে ও জীবনের চর্চায় প্রকৃত অর্থে ক’জন ধারণ করেন তা আজ বিশাল প্রশ্ন তৈরি করেছে। সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী সরকারের প্রগতিশীল শিক্ষানীতি বানচালের আস্ফালন শুরু করেছে। বাঙালির সাহিত্য, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ আজ টার্গেটে পরিণত হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুরা আজ সংকুচিত হয়ে অস্তিত্ব সংকটে। মানবিক বাংলাদেশ, অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ বিনির্মাণে যেসব চ্যালেঞ্জ সামনে রয়েছে তা মোকাবেলা করে শান্তি, সমৃদ্ধি ও সম্প্রীতির পথে এগিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সকল শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সময় এখনই।
সাবেক ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী ড. বীরেন শিকদার এমপি বলেন, রাষ্ট্রীয় বৈষম্য ও সামাজিক বাস্তবতার কারণে সংখ্যালঘুরা ক্ষয়িষ্ণু হতে হতে ৮ দশমিক ৯ ভাগে পৌঁছেছে। তিনি বলেন, অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন সরকার বাস্তবায়ন করতে চাইলেও জেলা প্রশাসক ও এ্যাসিলেন্ডরা সাম্প্রদায়িক মানসিকতায় করতে দেন না। এটি দুঃখজনক। সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন হলে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন এগিয়ে যাবে।
তিনি বলেন, ইশতেহারে আওয়ামী লীগ সংখ্যালঘুদের জন্য অনেক প্রতিশ্রুতি দিলেও ক্ষমতায় যাওয়ার পর এসব বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হয় না, আশ্বাসে থাকে। জীবদ্দশায় বোধহয় আর অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ দেখে যেতে পারব না এমন আক্ষেপের কথা জানিয়ে নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার বলেন, ধর্মকে রাজনৈতিক সঙ্গে যুক্ত করায় সংকট বেড়েছে। গোটা বিশ্বে এখন ধর্মের কারণে উগ্রবাদী চেতনা বেড়েছে। পাশের দেশের ধর্মীয় উন্মাদনার প্রভাব এ দেশে থাকা স্বাভাবিক।
সাম্প্রদায়িক ব্যক্তিরা অর্থের বিনিময়ে জনপ্রতিনিধি হচ্ছেন জানিয়ে তিনি বলেন, নতুন পাঠ্যসূচির বাস্তবায়ন হলে সাম্প্রদায়িক মনোভাব হয়তো কিছুটা কমবে। সংখ্যালঘুদের দাবি আদায়ে চাপ অব্যাহত রাখার পরামর্শ দিয়ে রামেন্দু মজুমদার বলেন, জঙ্গিদের বিরুদ্ধে যেমন সরকার কঠোর তেমনি সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধের কঠোর হতে হবে। সবচেয়ে বড় ভয়ের বিষয় হলো সরকার ও প্রশাসনে সাম্প্রদায়িক মানুষের অভাব নেই। তাই সমাজ চলে গেছে মৌলবাদীদের দখলে।
সামাজিক সাম্প্রদায়িকতা রাজনৈতিক সংকটের চেয়েও বেশি উল্লেখ করে অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, সবাই মিলে সামাজিক সাম্প্রদায়িকতা আগে মোকাবিলা করতে হবে। সংস্কৃতি আন্দোলনের দুর্বলতায় সামাজিক সাম্প্রদায়িকতা বেড়েছে দাবি করে তিনি বলেন, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণে প্রশাসনিক সাম্প্রদায়িকতা বড় বাধা। তিনি বলেন, রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে ধর্মীয় সংখ্যালঘু ইস্যুতে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি একমত। তাই রাজনৈতিক বাস্তবতায় হয়তো আমরা আর অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ ফিরে পাব না।
তিনি বলেন, দাবি আদায়ে ১০ ভাগ সংখ্যালঘু ভোট কম নয়। সবাইকে একত্র করতে না পারলে দাবি আদায় সম্ভব নয়। রাজনৈতিক দলগুলোর ভোটের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় যেতে হলে দাবি পূরণ হতো। এজন্য সামাজিক আন্দোলন, প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তির সমর্থন প্রয়োজন বলেও মনে করেন তিনি।
সাম্প্রদায়িক বিষবৃক্ষ শক্তিশালী হওয়ার প্রভাবে আজকের বাংলাদেশ ক্রমশ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে সরে যাচ্ছে এমন মন্তব্য করে আদিবাসী সংখ্যালঘুবিষয়ক সংসদীয় ককাসের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. মেজবাহ কামাল বলেন, জিয়াউর রহমানের উত্তরসূরি হিসেবে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ মুসলিম ছাড়া অন্যদের রাষ্ট্রধর্মের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করেছেন। তিনি বলেন, শিক্ষানীতির মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণের চেষ্টা করছেন, কিন্তু আওয়ামী লীগ তা করছে না। অনেক ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুকন্যা ও দলের অবস্থান বিপরীত। মূলত আওয়ামী লীগসহ বাম দলগুলো অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণের দায়িত্ব থেকে সরে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, দেশে এখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে মিথ্যাচার ও বিরোধিতা পাকিস্তান আমলেও দেখিনি। মিথ্যাচারের মধ্য দিয়ে কবিকে সাম্প্রদায়িক বানানোরও চেষ্টা হচ্ছে। এমন বাস্তবতায় রাষ্ট্রকে সকল শক্তি প্রয়োগ করে সাম্প্রদায়িক জঙ্গিদের নির্মূল করতে হবে। অন্যথায় দেশটা একসময় পাকিস্তানে রূপ নেবে।
ছয় হাজার ২৭৫ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে জরিপের একটি ফল তুলে ধরে এই শিক্ষাবিদ বলেন, ১৮-৩৫ বছরের ১০ ভাগ যুবক মনে করেন, তারা মরে গেলেও কোনো বিধর্মীর শরীরের রক্ত নেবে না। সাম্প্রদায়িক মানসিকতা কোন পর্যায়ে গেছে এটাই বড় উদাহরণ হতে পারে। পংকজ নাথ এমপি বলেন, ১০ ভাগ সংখ্যালঘুর উন্নয়ন ছাড়া কেউ দেশ নিয়ে ভাবলে তা আর বাংলাদেশ থাকবে না।