বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের রাজনীতির পাশাপাশি দেশের ইতিহাসে ১৭ মে এক অনন্য দিন। জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার ছয় বছর পর ১৯৮১ সালের এই দিনে স্বদেশে ফিরে এসেছিলেন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দলের দুঃসময়ে হাল ধরেন আওয়ামী লীগের। সেই থেকে দীর্ঘ ৪৪ বছর ধরে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন দলটির। কালের পরিক্রমায় তার নেতৃত্বে স্বৈরাচারের পতন ঘটে, ভোট ও ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। দেশের বর্তমান উন্নয়ন ও অগ্রগতি, সাফল্য ও সমৃদ্ধি তার সুযোগ্য নেতৃত্বেই অর্জন করা সম্ভব হয়েছে।
বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে দীর্ঘদিন যেমন রাজপথ ও জেলের সেলে বন্দি থেকে জনগণের জন্য অধিকার আদায় করে নিতে হয়েছিল; তেমনি ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট-পরবর্তী শেখ হাসিনাকেও কঠিন পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। শেখ হাসিনা রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারী, মৃত্যুকে উপেক্ষা করে এগিয়ে চলেছেন নির্ভীকভাবে আর গভীর মমতা দিয়ে জনগণের প্রত্যাশা পূরণে সচেষ্ট রয়েছেন। শেখ হাসিনা দেশে ফিরে এসে সুস্থ ধারার রাজনীতির নেতৃত্ব দিয়েছেন বলেই আজ বাংলাদেশ বিশ্বের কাছে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেমন বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের ইতিহাস, তেমনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এ দেশের শাসনকাজে দীর্ঘকাল ক্ষমতায় আসীন থেকে মহিমান্বিত রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে মহাকালকে স্পর্শ করতে সক্ষম হয়েছেন।
দুঃখী রাজকন্যার মতো হৃত গৌরব পুনরুদ্ধারের জন্য শেখ হাসিনার জন্ম ও পুনর্জন্মের খুব বেশি প্রয়োজন ছিল দেশ ও জনতার। তার প্রত্যাবর্তনের আগে নৈরাজ্যের জাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছিল দেশের সাধারণ মানুষ। ১৯৭১ সালে বিশ্বের মানচিত্রে যখন নতুন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়, তখন অর্থনৈতিকভাবে দেশটি টিকে থাকা নিয়ে অনেকে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন, অথচ আজ বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ও সামাজিক এমন কোনো সূচক নেই, যেখানে অগ্রগতি লাভ করেনি।
বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলায় গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠা ও রক্ষা করার প্রচেষ্টা সফল হতে দেয়নি খুনিরা। ফলে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট পরবর্তী সামরিক শাসকদের অভ্যুত্থান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভূলুণ্ঠিত করে। দেশ অন্ধকারে নিক্ষিপ্ত হয়। দেশের প্রতিকূল পরিস্থিতিতে একসময় জননেত্রী শেখ হাসিনাকে দলের হাল ধরতে হয়েছে, আন্দোলন-সংগ্রামের কণ্টকাকীর্ণ পথ অতিক্রম করে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসতে হয়েছে। বেদনার তরি বেয়ে দেশে ফেরা শেখ হাসিনা আজ বিশ্বব্যাপী সমাদৃত এবং নন্দিত এক রাষ্ট্রনায়ক।
মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস তিনি গৃহবন্দি থেকেছেন। সামরিক স্বৈরশাসকের আমলেও বেশ কয়েক বার তাকে কারা নির্যাতন ভোগ করতে হয়েছে ও গৃহবন্দি থাকতে হয়েছে। বারবার তার জীবনের ওপর ঝুঁকি এসেছে। অন্তত ১৯ বার তাকে হত্যার অপচেষ্টা করা হয়েছে। জীবনের ঝুঁকি নিয়েও তিনি অসীম সাহসে লক্ষ্য অর্জনে থেকেছেন অবিচল। জননেত্রী শেখ হাসিনার বিচক্ষণ নেতৃত্বে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে স্বৈরশাসনের অবসান হয়। গণতন্ত্র ও সাধারণ মানুষের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয় তার নেতৃত্বে নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতার প্রথম পাঁচ বছর (১৯৯৬-২০০১) এবং ২০০৯ সাল থেকে টানা তিন মেয়াদে সুপরিকল্পিত অর্থনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করায় বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটেছে। দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর খুনি ও একাত্তরের নরঘাতক মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্য সম্পন্ন এবং রায় কার্যকর করা হয়েছে। সব ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে দেশের সর্ববৃহত্ অবকাঠামো পদ্মা সেতু শেখ হাসিনার অদম্য সাহস, দৃঢ়তা ও আত্মনির্ভরশীলতার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শিক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেশে অসম শিক্ষানীতির পরিবর্তে সবার জন্য সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা চালু হয়েছে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণের মাধ্যমে স্যাটেলাইট ক্লাবের ৫৭তম গর্বিত সদস্য দেশ। অনেক মাইলফলক অর্জনের তালিকায় গত বছরের ডিসেম্বরে যোগ হয়েছে মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ও কর্ণফুলী টানেল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর জাদুর পরশে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছে ডিজিটাল বাংলাদেশ। এখন স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে নিরলসভাবে কাজ করছে তার সরকার।
বঙ্গবন্ধুর পর জননেত্রী শেখ হাসিনার রাষ্ট্র পরিচালনার ১৮ বছর বাংলাদেশের ইতিহাসের স্বর্ণালি সময়, যা আজও অব্যাহত আছে। অর্থনীতি ও উন্নয়ন, সমাজনীতি, সংস্কৃতি, আইনশৃঙ্খলা, পররাষ্ট্রনীতিসহ সব খাতকে প্রধানমন্ত্রী ইতিহাসের সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সমীক্ষা বলছে, একসময়ের দরিদ্রতম দেশটি আজ ৪১তম অর্থনীতির দেশ। ব্রিটেনের অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর ইকোনমিক অ্যান্ড রিসার্চের (সিইবিআর) সমীক্ষামতে, বর্তমান ধারায় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিকাশ অব্যাহত থাকলে ২০৩৫ সাল নাগাদ দেশটি বিশ্বে ২৫তম অর্থনীতির দেশ হবে।
বর্তমান সরকারের শাসন আমলেই কোনো বৈরিতা ছাড়াই দুই প্রতিবেশী ভারত ও মিয়ানমারের বিপক্ষে সমুদ্র বিজয় নিশ্চিত করেছে বাংলাদেশ। বঙ্গোপসাগরে ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটারের বেশি টেরিটোরিয়াল সমুদ্র, ২০০ নটিক্যাল মাইল এলাকায় একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপান এলাকার প্রাণিজ ও অপ্রাণিজ সম্পদের ওপর সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ ছাড়া ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে স্বাধীনতার পরপর যে স্থল সীমান্ত চুক্তি হয়েছিল, সম্প্রতি তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে ছিটমহল সমস্যার সমাধান করা বাংলাদেশের বড় অর্জন বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা। সর্বশেষ রোহিঙ্গা ইস্যুতেও আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসা পেয়েছে বাংলাদেশ। জাতিসংঘসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশ ও সংস্থা এই ইস্যুতে বাংলাদেশের ভূয়সী প্রশংসা করেছে।
রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা এক অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব। শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে রেকর্ড পরিমাণ উন্নয়ন হয়েছে দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে। শুধু আর্থিক বা অবকাঠামোগত উন্নয়ন নয়, দেশ থেকে জঙ্গিবাদ নির্মূল হয়েছে, বাল্যবিবাহসহ বিভিন্ন রকমের সামাজিক সমস্যাগুলো নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে।
শেখ হাসিনার দূরদর্শী ও সময়োপযোগী পদক্ষেপের কারণে বাংলাদেশ আজ বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল। দেশ ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের সব ষড়যন্ত্র ও রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে তার পথচলা শুধু দেশের কল্যাণে। ক্রমাগত গৃহহীনেরা পেয়েছেন মাথা গোঁজার ঠাঁই। তার সাহসিকতা ও নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো বৃহত্ প্রকল্প আলোর মুখ দেখেছে। বাংলাদেশকে একটি সুখী-সমৃদ্ধ সোনার বাংলায় পরিণত করতে তিনি ‘ভিশন ২০২১’ ও ‘ভিশন ২০৪১’ কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন এবং সে অনুযায়ী বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ ও এর বাস্তবায়নে অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলছেন। গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও জনগণের কল্যাণে শেখ হাসিনার এসব যুগান্তকারী কর্মসূচি বাংলার ইতিহাসের স্বর্ণালি অধ্যায় হয়ে থাকবে।
শেখ হাসিনা এক আলোকবিন্দু। পুরো বাংলাদেশকে আলোকিত করে চলেছেন ইতিবাচক শাসনব্যবস্থা দিয়ে। কাজ করার সময় আশপাশের লোকের কারণে কিছু সীমাবদ্ধতা আসে, আছে, থাকে; কিন্তু দিন শেষে নিরপেক্ষভাবে মূল্যায়ন করলে শেখ হাসিনার দুর্দান্ত সফল একটি প্রতিবিম্ব সুস্পষ্ট। ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে যিনি বিজয়ের স্বপ্ন দেখেন, দেখান; যিনি রক্তাক্ত শরীর নিয়ে গোলাপ চাষের চিন্তা করেন, করান; যিনি ষড়যন্ত্র-নীলনকশাকে প্রতিরোধ করতে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে হাত নাড়েন। তিনিই অনন্যা শেখ হাসিনা, যিনি বাংলাদেশকে স্বাধীনতাবিরোধী, সাম্রাজ্যবাদী ও আধিপত্যবাদীদের স্বার্থান্বেষী শকুনি দৃষ্টি থেকে সুরক্ষা দিতে স্রষ্টার অনুগ্রহে নিজের আঁচলের ছায়ায় জীবন বাজি রেখে বাংলার মাটি, সম্পদ ও মানুষকে আশ্রয় দেন। তিনিই অদ্বিতীয়া, তিনিই যোদ্ধা, তার নাম শেখ হাসিনা। যিনি শুনেছিলেন স্বৈরাচারী সামরিক সরকারের বুটে পদপিষ্ট অসহায় বাঙালির আর্তনাদ, কেবল মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী বিপ্লবী হূদয় সেই দুঃসহ সময়কে ধারণ করে শিখে নেয় অনন্তর্ভেদী গান। স্বরতন্ত্রে ষড়যন্ত্র থাকে, বাচ্য অবাচ্যের বাইরে তাই এ গান কেবলই সমৃদ্ধ স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনের আপসহীন সংগ্রামের অঙ্গীকার। এমন নবধারাজলের দৃপ্ত অঙ্গীকার নিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে জননেত্রী শেখ হাসিনা সমাসীন। প্রচল প্রকরণের সীমানা ভেঙে মানবীয় চেতনা ও অভিজ্ঞতায় এক অভাবিত নৈপুণ্যে হয়ে উঠেছেন গণমানুষের অবিসংবাদিত নেত্রী। সাময়িক প্রাপ্তির জন্য আদর্শ জলাঞ্জলি দিয়ে কখনো আপসরফায় স্বাক্ষর করেননি। যুগপত্ আপন কীর্তি ও মহিমায় ক্রমশ উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়েছেন তিনি। তার চেতনার মানসপটে বাংলাদেশের মানুষের অধিকার ও ক্ষমতার রাজনীতি এক অভিন্ন রসায়নে জারিত। ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’ খ্যাত জননেত্রী শেখ হাসিনা ব্যক্তি মানুষকে ছাপিয়ে মূল্যায়িত হবেন ইতিহাসের মহার্ঘ্য পৃষ্ঠায়। সময় ও বাংলাদেশের গণমানুষের আকাঙ্ক্ষাকে আত্মস্থ করে এক প্রবল মানবকল্যাণকামী চিত্তের মৃত্যুঞ্জয়ী শেখ হাসিনা হয়ে উঠেছেন এক অনিবার্য রাষ্ট্রনায়ক। বহুবিস্তারী পথমালা আবিষ্কার বোধকরি তারই সাজে।
লেখক : ফিকামলি তত্ত্বের জনক, গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক, প্রেসিডিয়াম সদস্য, বঙ্গবন্ধু পরিষদ