বাজেটে শিক্ষা ও গবেষণায় বরাদ্দ বাড়ানো হোক

ড. মো. শফিকুল ইসলাম

বাজেট
ফাইল ছবি

বাজেট ঘোষণা হবে। বাজেটে ভালো-মন্দ উভয় দিক থাকবে। বৈশ্বিক সংকট অর্থনীতি ও রাজনীতিকে নানাভাবে প্রভাবিত করছে। এই সংকটে বাজেট দেওয়া কঠিন এবং চ্যালেঞ্জিং।

নানামুখী চ্যালেঞ্জের মধ্যেই সরকার বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছে। বাজেটে শিক্ষা ও গবেষণা খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর জন্য বিশেষজ্ঞরা অনেক বছর ধরে বলে আসছেন, কিন্তু বিগত বছরের বাজেটে তার প্রতিফলন ঘটেনি। অঙ্কের হিসাবে বরাদ্দ বেড়েছিল। বাস্তবে গত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ বাড়েনি।

বাজেটে শিক্ষা খাতে উন্নয়নের বরাদ্দ বৃদ্ধি করে সুখবর দিতে হবে। বাজেট হতে হবে অর্থনীতি, ব্যবসা ও শিক্ষা বান্ধব। টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে শিক্ষায় জিডিপির ৫ শতাংশ বা মোট বাজেটের ২০ শতাংশ বরাদ্দ করা হবে—এ রকম প্রতিশ্রুতি ছিল। আসন্ন বাজেটে এর প্রতিফলন চাই।

শিক্ষা ও প্রযুক্তি মিলে একটি খাতে বাজেটে বরাদ্দ দেওয়া হয়, যা উচিত নয়। শিক্ষার সঙ্গে প্রযুক্তিকে যুক্ত করলে শিক্ষা খাতের প্রকৃত বাজেট বাস্তবায়ন এবং পরিকল্পনা করা কঠিন হয়ে পড়ে। শিক্ষার জন্য পৃথক বাজেট থাকা খবুই জরুরি। দেশের টেকসই উন্নয়নের জন্য শিক্ষাকে পৃথকভাবে মোট বাজেটের ২০ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া একান্ত প্রয়োজন। শিক্ষার উন্নয়ন ছাড়া স্মার্ট বাংলাদেশ ও টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়।

২০২৩-২৪ অর্থবছরে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ছিল ৮৮ হাজার ১৬৩ কোটি টাকা, যেখানে টাকার অঙ্ক বাড়লেও জিডিপির তুলনায় বরাদ্দ বিগত অর্থবছরের তুলনায় কমেছে। শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ছিল গত অর্থবছরে জিডিপির মাত্র ১.৭৬ শতাংশ, যা ২০২২-২৩ অর্থবছরে ছিল ১.৮৩ শতাংশ। এর আগের অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ২.০৮ শতাংশ, যেখানে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী শিক্ষা খাতে ৬ শতাংশ বরাদ্দ থাকার কথা। অর্থাৎ বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করা একান্ত প্রয়োজন। শিক্ষায় বরাদ্দ কোনো খরচ নয়, বরং বিশাল বিনিয়োগ হিসেবে কাজ করে। যেসব দেশ এটি বুঝতে পেরেছে, সেসব দেশ বিশ্বে নেতৃত্ব দিচ্ছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর, দক্ষতা, উদ্ভাবন ও সৃজনশীলতা সহায়ক সমাজ গড়ে তুলতে হলে সময়োপযোগী শিক্ষা প্রদান করতে হবে। এ জন্য দরকার শিক্ষা বা গবেষণা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি, যার সুফল পাবে দেশ ও জনগণ।

সম্প্রতি যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠান কিউএস ২০তম সংস্করণে বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র‌্যাংকিং ২০২৪ প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় এই তালিকার শীর্ষ পাঁচ শর মধ্যে স্থান পায়নি। তবে এবার বেশি হতাশ হতে হয়েছে, যখন এশিয়ার র‌্যাংকিং প্রকাশ পায়। যুক্তরাজ্যভিত্তিক টাইমস হায়ার এডুকেশনের ‘এশিয়ান ইউনিভার্সিটি র‌্যাংকিং ২০২৪’ প্রকাশিত হয় গত ৩০ এপ্রিল। এশিয়ার ৩১টি দেশের মোট ৭৩৯টি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে করা তালিকায় শীর্ষ তিন শতে নেই বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়। কারণ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ কম। বরাদ্দ কম মানে গবেষণা এবং শিক্ষার গুণগত মানও কম। তাই এই র‌্যাংকিংয়ে আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্থান পায় না। এসব প্রশ্ন নিয়ে গভীরভাবে পরিকল্পনা করা এবং দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ নেওয়া আমাদের জন্য বাধ্যতামূলক হয়ে পড়েছে। এই পদক্ষেপের মধ্যে শিক্ষা খাতে পৃথকভাবে মোট বাজেটের ২০ শতাংশ বরাদ্দ দিতে হবে। বরাদ্দ দিলেই হবে না, কার্যকর ব্যবহার করতে হবে।

এই র‌্যাংকিংয়ে যেসব সূচক বিবেচনা করা হয়, তার মধ্যে একাডেমিক খ্যাতি এবং গবেষণা (৬০ শতাংশ স্কোর) অধিকতর তাৎপর্যপূর্ণ। সূচকের মধ্যে শিক্ষা ও গবেষণার মান বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক খ্যাতি অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। গত কয়েক বছর উচ্চশিক্ষার অনেক উন্নয়ন হলেও গবেষণা তেমন কোনো গুরুত্ব পায়নি। গবেষণা খাতে আমাদের আর্থিক বরাদ্দ যথেষ্ট না থাকলেও গবেষণা হয়, কিন্ত সেটি আন্তর্জাতিক মানে জায়গা করে নেওয়ার মতো যথেষ্ট না। তাই বরাদ্দ বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই।

শিক্ষকদের আর্থিক গবেষণা বরাদ্দ বৃদ্ধি এবং আর্থিক প্রণোদনার কিছু নীতি থাকা জরুরি। যেমন—একাডেমিক গবেষণার ক্ষেত্রে অনেক চীনা বিশ্ববিদ্যালয় গবেষকদের জন্য বড় নগদ বোনাস অফার করে। যে গবেষক বা যাঁরা শীর্ষস্থানীয় একাডেমিক জার্নালে গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন, তাঁরা এই সুবিধা প্রাপ্ত হন, যা একজন চীনা গবেষকের মোট বেতন বৃদ্ধি করতে পারে। এর ফলে গবেষকরা অনুপ্রাণিত হন।

ইউনেসকোর শিক্ষা দলিলে স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে মোট বাজেটের ২০ থেকে ২৫ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ দিলে দেশের গবেষণা খাতকে শক্তিশালী করা সম্ভব হতে পারে। বিশ্বের যেসব দেশে জাতীয় বাজেটে শিক্ষা খাতে কম বরাদ্দ দেওয়া হয়, তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে শিক্ষা খাতে বাংলাদেশের ব্যয় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যেও সর্বনিম্ন।

উচ্চশিক্ষা টেকসই উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা পালন করতে পারে যদি গবেষণায় বরাদ্দ বেশি থাকে এবং সেই অনুসারে গবেষকরা যদি মানসম্মত গবেষণা করেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই আসবে ভবিষ্যতের নেতৃত্ব, যারা তাদের সৃজনশীল চিন্তা, মেধা ও বুদ্ধি দিয়ে টেকসই উন্নয়ন অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে এমন করে গড়তে হবে, যাতে বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতির উৎস হয় এবং এ জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষকে দ্রুত উদ্যোগ নিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন নিয়মিত মূল্যায়ন এবং পর্যাপ্ত বরাদ্দের মাধ্যমে গবেষণার বিবর্তনে শক্তিশালী প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করতে পারে।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য পদ্ধতি বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ

শেয়ার করুন