শিল্প বিপ্লবের পর থেকে পৃথিবীর তাপমাত্রা দ্রুততম সময়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সুইডিশ বিজ্ঞানী আর্হেনিয়াস ১৮৯৬ সালে এ বিষয়ে প্রথম বর্ণনা দেন। তাঁর মতে, জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর ফলে বায়ুমন্ডলে কার্বনের পরিমাণ প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। সূর্য থেকে আগত তাপ ও পৃথিবী থেকে বিক্ষিপ্ত তাপ কার্বন শোষণ করে নেয়।
এতে করে পৃথিবীর মোট তাপমাত্রা ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি বৃদ্ধি পেতে পারে। ১৯৮৮ সালে ধারণাটি প্রথম স্বীকৃতি অর্জন করেছিল। ১৮৮০ সাল থেকে ওই সময় পর্যন্ত ছিল উষ্ণতম বছর। পৃথিবীর ৬০টির বেশি দেশের ২৫০০ বিজ্ঞানী মত প্রকাশ করেন যে, মানবসৃষ্ট গ্রিনহাউস গ্যাসই পৃথিবীর তাপমাত্রা দ্রুততম সময়ে বৃদ্ধির কারণ। বায়ুমন্ডলে বিভিন্ন গ্যাসীয় উপাদান তথা নাইট্রোজেন, অক্সিজেন, কার্বন ডাই অক্সাইড, আর্গন ও জলীয়বাষ্প বিদ্যমান। কিন্তু মানবসৃষ্ট বিভিন্ন কর্মকান্ডের কারণে যোগ হওয়া বিভিন্ন গ্যাসের কারণে এ প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। ফলে পৃথিবীর উষ্ণতা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। যানবাহন, রান্নাবান্না, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও কলকারখানায় ব্যাপকহারে জীবাশ্ম জ্বালানি তথা কয়লা, পিট, পেট্রোলিয়াম, প্রাকৃতিক গ্যাস প্রভৃতি ব্যবহৃত হয়। বিগত ২০০ বছর ধরে পশ্চিমা দেশগুলোতে অধিকমাত্রায় জ্বালানি ব্যবহারের কারণে এবং বর্তমানে তৃতীয় বিশ্বে শিল্পায়ন যত হচ্ছে তত বেশি কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাস বায়ুমন্ডলে যুক্ত হচ্ছে। বিজ্ঞানীদের মতে, বিগত ২০০ বছরে ব্যাপকহারে বন উজাড় এবং জ্বালানি হিসেবে খনিজ তেল ব্যবহারের ফলে বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাস বেড়েছে ৩ গুণ। পৃথিবীর তিন-চতুর্থাংশের বেশি কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাস জ্বালানি তেল উৎপাদন ও ব্যবহারের ফলে তৈরি হয়।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ শুধু অতিরিক্ত কার্বন নির্গমনই নয়, কার্বন শোষণে মূল্যবান সম্পদ সমগ্র বিশ্বের বনাঞ্চল ও রেইনফরেস্টের নির্বিচার উৎপাটনও। কলকারখানা স্থাপন, বনজঙ্গল ও জলাভূমি উজাড় করে বসতি স্থাপন, নদীনালায় তীব্র দূষণ, কৃত্রিম বাঁধ নির্মাণ, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস, তীব্র বায়ুদূষণ, ইকোসিস্টেমের বিনাশ প্রভৃতি কারণে স্থানিক, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে পৃথিবী মারাত্মক হুমকির মুখে পতিত হচ্ছে। তাছাড়া শিল্পায়নের ফলে প্রতিবছর কলকারখানার কোটি কোটি টন বিষাক্ত গন্ধকের ধোঁয়া বাতাসে জলীয় অংশের সঙ্গে মিশে সালফিউরিক এসিড তৈরি করে। যা অমø বৃষ্টি নামে অভিহিত। তথ্য মতে, যুক্তরাষ্ট্রের পূর্বাংশে বৃষ্টির পানির অম্লত্ব বেড়েছে বহুগুণ। এর ফলে অনেক হ্রদের ৯০ শতাংশ মাছ ধ্বংস হয়ে গেছে। ব্রিটেন ও জার্মানির শিল্পাঞ্চল থেকে নির্গত ধোঁয়া নরওয়ে ও সুইডেনে অম্লবৃষ্টিজনিত সমস্যার সৃষ্টি করেছে।
কোনো জায়গার গড় জলবায়ুর দীর্ঘমেয়াদি ও অর্থপূর্ণ পরিবর্তন; যার ব্যাপ্তি কয়েক যুগ থেকে কয়েক লাখ বছর পর্যন্ত হতে পারে, তাকে জলবায়ু পরিবর্তন বলে। এ পরিবর্তন বিভিন্ন নিয়ামকের ওপর নির্ভরশীল।
পৃথিবীর আহরণকৃত সৌরবিকিরণের পরিবর্তন, ভূত্বক গঠনের পাততত্ত্ব, আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত প্রভৃতির ওপর। বর্তমানে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও বিশ্বায়নের দৃষ্টিকোণ থেকে জলবায়ু পরিবর্তন বললে সমগ্র পৃথিবীর সাম্প্রতিক সময়ের মানুষের কর্মকান্ডের কারণে জলবায়ুর পরিবর্তনকে বোঝায়; যা ভূমন্ডলীয় উষ্ণতা বৃদ্ধিরই রূপান্তর। পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের বিভিন্ন গ্যাস, জলীয়বাষ্প ও অপরাপর উপাদানের মধ্যে প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় থাকলেও ঊনবিংশ শতকের শুরু থেকে বায়ুমন্ডলে অতিমাত্রায় ওজোন গ্যাস ক্লোরোফ্লোরোকার্বন তথা সিএফসি যুক্ত হওয়ায় বায়ুমন্ডলের স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে অবস্থিত আর্কটিক ওজোনস্তর ফুটো হয়ে গেছে। পরিণামে ওজোনের পাতলা গ্যাসের স্তর পেরিয়ে সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি পরিবেশের ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এ ওজোনস্তরই অতিবেগুনি রশ্মিকে ফিল্টারের মতো সযত্নে ছেঁকে নিয়ে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে। উত্তর গোলার্ধে এ ওজোনস্তরের ফুটো বেশি দৃশ্যমান। তাই সেখানে ক্ষতির পরিমাণও বেশি। অতিবেগুনি রশ্মি মানুষের ত্বকের ক্ষতি ও দেহে ক্যান্সারসহ মারাত্মক ব্যাধির সৃষ্টি করে। পশুপাখি এবং গাছপালার ওপরও এর ক্ষতিকর প্রভাব রয়েছে। পৃথিবীর ৩ ভাগই হচ্ছে পানি। আবার এর বড় অংশ হলো বরফ এবং হিমবাহ। উত্তর ও দক্ষিণ গোলার্ধের বরফ, দক্ষিণ মেরুর তুষার আস্তরণ প্রাকৃতিক নিয়মে চললেও শিল্প বিপ্লবের প্রভাবে মানবসভ্যতার উন্মেষের কারণে ভূপৃষ্ঠের উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে মেরু অঞ্চলের বরফ দ্রুতই গলছে। এ বরফগলা পানির কারণে সমুদ্রস্ফীতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। আর এতে করে পরিবেশ-প্রতিবেশগত বিপর্যয় নেমে আসবে। ফলে দ্বীপদেশ, উপকূলীয় ও নিম্নাঞ্চলের দেশ সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে সমুদ্রে তলিয়ে যাবে।
আইপিসিসির (ইন্টারগভার্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ) মতে, উন্নয়নের ধারায় কোনো ইতিবাচক পরিবর্তনও যদি সাধিত হয়, তাহলেও আগামী শতকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত যে পরিমাণ কার্বন ডাই অক্সাইড বায়ুমন্ডলে সঞ্চিত হবে, তার পরিমাণ হবে শিল্প বিপ্লবের আগের মাত্রার দ্বিগুণের বেশি। বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ দ্বিগুণ হলে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ১.৫ থেকে ৪.৫ ডিগ্রি পর্যন্ত বাড়বে। বিশ্বব্যাপী বর্তমান নির্গমনের পরিমাণ ২১০০ সাল নাগাদ বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের স্থিতাবস্থা আনতে পারবে না। এজন্য কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমন হার ১৯৯০ সালের নির্গমনের চেয়ে কম হতে হবে। এখানে উল্লেখ্য, প্রাক-শিল্প বিপ্লব সময়কালের তুলনায় বর্তমানে বায়ুম-লে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ৩ গুণ। যদি বর্তমানে নির্গমন হার না বাড়ে তবু ২১০০ সাল নাগাদ বায়ুম-লে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বর্তমানের চেয়ে শতকরা ৪০ ভাগ বাড়বে এবং তা ক্রমশ বাড়তেই থাকবে। পরিবেশ দূষণ, প্রতিবেশ অবক্ষয়, প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রভৃতি কারণে স্থানীয়, আঞ্চলিক ও মহাদেশীয় কলেবরে পৃথিবীর যে ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে, তা শুধু কোনো নির্দিষ্ট একটি দেশের জন্য বিপর্যয় বয়ে আনবে তা-ই নয়, সেটা কমবেশি সব দেশেই বিরূপ প্রভাব ফেলবে। বাংলাদেশ হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমগ্র বিশে^র বিপন্ন ও ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম।
২১০০ সাল নাগাদ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১.১ মিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। কার্বন নির্গমন এবং তাপমাত্রা বৃদ্ধির মাত্রা যদি বেশি হয়, তবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ার কারণে নিউইয়র্ক বা সাংহাইয়ের মতো উন্নত ও সমৃদ্ধ নগরগুলোও ঝুঁকিতে পড়বে। সমুদ্রে তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে আবহাওয়া বিপজ্জনক আচরণ করবে। সামুদ্রিক ঝড় ও জলোচ্ছ্বাস আরও বৃদ্ধি পাবে। বিজ্ঞানীদের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বের বেশ কয়েকটি জায়গায় বড় মাপের জলোচ্ছ্বাস হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বন্যায় ক্ষতির মাত্রা ২ থেকে ৩ গুণ বৃদ্ধি পেতে পারে। সাগর-মহাসাগরের উষ্ণতা ১৯৭০ সাল থেকে বাড়ছে অব্যাহতভাবে। পরিবেশে যে বাড়তি তাপ তৈরি হচ্ছে, তার ৯০ ভাগই সমুদ্র শুষে নিচ্ছে। ১৯৯৩ সাল থেকে শুষে নেওয়ার এ মাত্রা ২ গুণ বেড়েছে। ফলে গ্রিনল্যান্ড ও অ্যান্টার্কটিকার বরফ গলছে। ২০০৭ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত অ্যান্টার্কটিকার বরফ যে হারে গলছে, তা আগের ১০ বছরের তুলনায় ৩ গুণ। অ্যান্ডিজ, মধ্য ইউরোপ এবং উত্তর এশিয়ার যেসব হিমবাহ রয়েছে, সেগুলোর বরফ ২১০০ সাল নাগাদ ৮০ শতাংশ গলে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। সম্প্রতি জাতিসংঘ রেড অ্যালার্ট জারি করেছে।
সমুদ্রের তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রভাব মৎস্য সম্পদ, জলজ উদ্ভিদ এবং ইকোসিস্টেমের ওপর পড়বে। মাছের শরীরে পারদের মাত্রা বৃদ্ধি পাবে। জলজ প্রাণী তার আবাসস্থল পরিবর্তন করবে।বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা এমনভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে যে, কোপেনহেগেন ও প্যারিস চুক্তিতে পৃথিবীর তাপমাত্রা সীমিত রাখার যে লক্ষ্যমাত্রা ঘোষিত হয়েছিল তাতে আর কাজ হচ্ছে না। ২০১৫ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনে (কপ-২১) ২০৩০ সাল নাগাদ বৈশ্বিক তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং গ্রিন হাউস নির্গমন হ্রাস করে ২০৫০ সালের মধ্যে তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে সীমাবদ্ধ রাখার অঙ্গীকার করা হয়। এ ছাড়া ক্ষতি মোকাবিলায় জলবায়ু তহবিল গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। ধনী ও শিল্পোন্নত দেশগুলো ১০০ মিলিয়ন ডলার সহায়তা করার অঙ্গীকার করেছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ার মতো উন্নত দেশ অর্থ জমা দেওয়ার বিষয়ে এখনো পিছিয়ে রয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন হ্রাসের কথা বলা হলেও শিল্পোন্নত দেশগুলো তা মানছে না। আইপিসিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিপর্যয়ের ঝুঁকি প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এ ঝুঁকি এড়াতে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও প্রযুক্তিকে কাজে লাগানো যেতে পারে। নতুন এ প্রতিবেদনকে জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তনিও গুতেরেস ‘মানবজাতির টিকে থাকার নির্দেশিকা’ বলে অভিহিত করেছেন। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, যত দ্রুত আমরা জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার হ্রাস করতে পারব, তত দ্রুত জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে খারাপ প্রভাব এড়াতে পারব।
জাতিসংঘ মহাসচিব আরও বলেন, সব দেশকেই এক দশকের মধ্যে কার্বন নিঃসরণের মাত্রা শূন্যে নামিয়ে আনার লক্ষ্যে আরও তৎপর হতে হবে। সকলের জন্য একটি বাসযোগ্য ও টেকসই ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করার সুযোগ দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। আমাদের এ সুযোগ এখনই কাজে লাগাতে হবে। ফরাসি সমুদ্রবিজ্ঞানী ড. জ্যঁ পিয়েরে গাত্তুসোর মতে, পৃথিবী এখন মহাসংকটে। বিভিন্ন দিক থেকে ঝুঁকি তৈরি হয়েছে এবং এর জন্য আমরাই দায়ী। তিনি আরও বলেন, নিচু জায়গাগুলোতে সাগরের উচ্চতা বাড়ার পরিণতি হবে ব্যাপক। বিশ্বের ৭০ কোটি মানুষ নিচু উপকূলীয় এলাকায় বসবাস করে; যা খুবই উদ্বেগের। আইপিসিসি প্যানেলের অধ্যাপক ডেরা রবার্টস এ প্রসঙ্গে বলেন, আমরা নজিরবিহীন কিছু আলামত দেখতে পাচ্ছি। আপনি যদি স্থলভাগের খুব ভেতরেও বসবাস করেন, তাহলেও সাগর এবং পরিবেশে তাপমাত্রা বৃদ্ধির ক্ষতিকর প্রভাব থেকে নিরাপদ থাকতে পারবেন না। তবে আশার বাণী হচ্ছে, সমুদ্রের ভবিষ্যৎ এখনো আমাদের হাতে রয়েছে। এর জন্য ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নির্গমনের মাত্রা এখনকার তুলনায় কমপক্ষে ৪৫ শতাংশ হ্রাস করতে হবে। আইপিসিসি প্যানেলের চেয়ারম্যান হোসুং লি এ প্রসঙ্গে বলেন, কার্বন নির্গমনের মাত্রা অনেক কমালেও চরম ঝুঁকির মধ্যে থাকা মানুষের জীবন ও জীবিকার ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা করাটা চ্যালেঞ্জিং হবে।
ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশ সবসময়ই দুর্যোগপ্রবণ দেশ। আইপিসিসির ২০১২ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের যে ঋণাত্মক প্রভাব, তা সবচেয়ে বেশি পড়ছে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমূহের ওপর। জলবায়ু পরিবর্তন বৈশ্বিক সমস্যা হলেও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিপন্নতার মাত্রা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ব্যাপক চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিচ্ছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশের নিম্নভূমির একটা বড় অংশ পানিতে তলিয়ে যাবে। এর ফলে সম্পদের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াও জনগোষ্ঠীর একটা বিরাট অংশ বাস্তুহারা হয়ে পড়বে।
সামুদ্রিক লবণাক্ত পানি বাংলাদেশের আরও গভীরে প্রবেশ করে ব্যাপক এলাকা অনাবাদি করে তুলবে। এতে বাংলাদেশের কৃষি, জনজীবন এবং অর্থনীতি বিধ্বস্ত হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজনীয় বিশুদ্ধ পানির ঘাটতিও বাড়ছে। কারণ, বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে পানি দূষিত হচ্ছে। আবার অতিরিক্ত গরম পড়ার কারণে ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে বেশি পরিমাণে পানি তুলে নেওয়া হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ততার বিচারে বিশ্বব্যাপী গবেষকগণ বাংলাদেশকে ‘পোস্টার চাইল্ড’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। বাংলাদেশ থেকে মাত্র ০.১৪ শতাংশ গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমন ঘটে, জলবায়ু পরিবর্তনে যার ভূমিকা নগণ্য। অথচ জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বেশি কুফল ভোগ করবে বাংলাদেশের মতো দুর্যোগপ্রবণ ও উপকূলীয় অঞ্চলের মতো কতিপয় দেশ। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বলেছেন, বাংলাদেশের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় দৃশ্যমান প্রভাব হচ্ছে দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোয় লবণাক্ততা বৃদ্ধি। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ঘনঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যেমন– সাইক্লোন, বন্যা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, ভূমিধস, নদীভাঙন, উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা বৃদ্ধি, ফসলহানি, ভূগর্ভস্থ পানিতে অতিমাত্রায় আর্সেনিকের উপস্থিতি, পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়াসহ বিভিন্ন বিপর্যয়ের মুখে পতিত হবে বাংলাদেশ।
জাতিসংঘের দুর্যোগ ঝুঁকি প্রশমন বিষয়ক দপ্তর (ইউএনডিআরআর) বলছে, ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্ব জুড়ে দুর্যোগের সংখ্যা দাঁড়াতে পারে বছরে ৫৬০টি; যা দৈনিক গড়ে দুটির কাছাকাছি। বৈশ্বিক জলবায়ু সূচক-২০২১ এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ২০ বছরে বাংলাদেশে ১৮৫টি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বড় দুর্যোগ আঘাত হেনেছে। এতে ১১ হাজার ৪৫০ জনের প্রাণহানি হয়েছে। আর অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে ৩৭২ কোটি ডলার। পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা ত্রিমাত্রিক- অভ্যন্তরীণ, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যার সমাধান করা বাংলাদেশের একার পক্ষে দুঃসাধ্যই বটে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতি মোকাবিলায় বাংলাদেশ তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখুক এবং উন্নয়নশীল ও বিপন্ন দেশগুলোর প্রতিনিধিত্ব করুক; এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক : শিক্ষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়