মুদ্রাস্ফীতি যদি বিরাট আকার ধারণ করে, তবে প্রকৃত পক্ষেই অর্থনৈতিক ও সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তার বিষয়। কোনো দেশের জিডিপি বৃদ্ধি, বেকারত্ব হ্রাস, আয় স্তর বৃদ্ধি ইত্যাদি কারণে কিছু পরিমাণ মুদ্রাস্ফীতি হতেই পারে। রাজস্বনীতি, মুদ্রানীতি, নোট ইস্যু, বাজার নিয়ন্ত্রণ প্রভৃতি উপায়ে যদি অতিমাত্রার মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তবে দরিদ্র, মধ্যবিত্ত ও নির্দিষ্ট আয়ের জনগণের মধ্যে ব্যাপক সমস্যা তৈরি করে থাকে।
একটি গবেষণাধর্মী রিপোর্টে দেখা গেছে, দরিদ্র শ্রেণির জনগণ যেমন—রিকশাচালক, দিনমজুর, গৃহপরিচারিকা প্রভৃতি পেশায় জড়িত জনগণ অনেক সময় মুদ্রাস্ফীতির প্রভাবে তাদের আয় স্তর বাড়াতে সক্ষম হয়ে থাকেন। বিপদের সম্মুখীন হন নির্দিষ্ট সীমিত আয়ের জনগণ। দরিদ্র ও কর্মে অক্ষম বয়স্ক জনগণ মুদ্রাস্ফীতির কারণে ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন হন। ২০২২ সালে দেশে মুদ্রাস্ফীতির পরিমাণ ছিল ৭.৭ শতাংশ। বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস অনুযায়ী এই অর্থবছরে মুদ্রাস্ফীতি ৯.৬ শতাংশ হতে পারে। এ বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে মুদ্রাস্ফীতির পরিমাণ ১০ শতাংশের কাছাকাছি। অনেকে মনে করেণ, প্রকৃত মুদ্রাস্ফীতির পরিমাণ আরো বেশি। এই মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না হলে উন্নয়ন ও বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে।
অতিমাত্রায় মুদ্রাস্ফীতির কারণে জনগণের ক্রয়ক্ষমতা কমে। সঞ্চয় ও বিনিয়োগ কমে এবং সুদের হার বাড়ে। এর ফলে বিনিয়োগের মুনাফা কমতে থাকে। খাদ্যদ্রব্য ও অন্যান্য পণ্যের দাম অস্বাভাবিক বাড়ার কারণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ব্যাহত হয়। জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশ খাদ্যজাত দ্রব্যে মুদ্রাস্ফীতির পরিমাণ ছিল ৯.৫৬ শতাংশ। মুদ্রাস্ফীতির কারণে প্রধানত দরিদ্র জনগণ বিভিন্ন উপায়ে খাতভিত্তিক ব্যয় সংকোচনে বাধ্য হয়ে থাকে। একটি গবেষণাধর্মী রিপোর্ট অনুযায়ী মুদ্রাস্ফীতির কারণে স্বল্প আয়ের জনগণের মধ্যে ৩১ শতাংশ জনগণ খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন এনে থাকে। ২৪ শতাংশ জনগণ সঞ্চিত অর্থ ব্যয় করে থাকে এবং ১৫ শতাংশ দরিদ্র জনগণ খাদ্য ছাড়াও অন্যান্য সামগ্রীর ব্যয় সংকোচন করতে বাধ্য হয়ে থাকে। মুদ্রাস্ফীতির কারণে শহর অঞ্চলের দরিদ্র জনগণ গ্রাম অঞ্চলের জনগণের তুলনায় বেশি মাত্রায় সমস্যার সম্মুখীন হয়ে থাকে।
বাংলাদেশের মুদ্রাস্ফীতির কারণগুলো নিয়ে আলোচনা করতে গেলে বেশ কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করা যায়। এগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি মৌলিক কারণ রয়েছে, যেগুলো দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন ছাড়া মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা দুরূহ ব্যাপার। আমাদের দেশ মূলত আমদানিনির্ভর দেশ। আমাদের দেশে রপ্তানির তুলনায় আমদানির পরিমাণ বেশি। ২০২১ সালে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল প্রায় ২ লাখ ৯৩ কোটি টাকা এবং ২০২২ সালে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল প্রায় ৪ লাখ ৬ হাজার কোটি টাকা। ২০২১-২০২২ অর্থবছরে বাংলাদেশের আমদানির পরিমাণ ছিল ৮ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা এবং রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৪ লাখ ৭ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ বেশির ভাগ পণ্য আমদানি করে থাকে যথাক্রমে চীন, ভারত, সিংগাপুর, মালোয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, জাপান, দক্ষিণ-কোরিয়া প্রভৃতি দেশ থেকে। ২০২১-২০২২ অর্থবছরে চীন ও ভারত থেকে বাংলাদেশের পণ্য আমদানির পরিমাণ ছিল প্রায় ২ লাখ ৯ হাজার কোটি টাকা এবং ১ লাখ ৪৯ হাজার কোটি টাকা। ২০২১-২০২২ অর্থবছরে আমেরিকায় রপ্তানির পরিমাণ ছিল প্রায় ৮২ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া বাংলাদেশ যে সব দেশে পণ্য রপ্তানি করে থাকে, তার মধ্যে জার্মানি, যুক্তরাজ্য, স্পেন, ফ্রান্স ইত্যাদি রাষ্ট্র উল্লেখযোগ্য। দেশের মোট রপ্তানির প্রায় ৮০ শতাংশ এসে থাকে পোশাক খাত থেকে। মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য রপ্তানির খাত ও পরিমাণ বাড়ানো প্রয়োজন। এর জন্য প্রয়োজন দেশীয় ও বৈদেশিক বিনিয়োগ ও উত্পাদন বাড়ানো।
২০২২-২০২৩ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে সরকারের বাজেট ব্যয়কে সহায়তার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে ৭০ হাজার কোটি টাকা মুদ্রণ করতে হয়েছিল। অর্থের মালটি প্লাইয়ার ইফেক্টের কারণে এর পরিমাণ হতে পারে প্রায় ৩ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা। এটি মুদ্রাস্ফীতির একটি কারণ হতে পারে। অবশ্য অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলে ভবিষ্যতে আয় স্তর ও উত্পাদন বাড়বে আশা করা যেতে পারে। আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি এবং টাকার অবমূল্যায়ন দেশের মুদ্রাস্ফীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। টাকার অবমূল্যায়ন হ্রাসে প্রয়োজন টাকার চাহিদা বাড়ানো এবং এর জন্য প্রয়োজন রপ্তানি বাড়ানো। এছাড়া আমাদের দেশের সঙ্গে যেসব দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক বেশি যেমন—চীন, ভারত, সিংগাপুর, জাপান, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি প্রভৃতি দেশে যদি সুদের হার, মুদ্রাস্ফীতি, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, যুদ্ধ ইত্যাদি দেখা দেয়, তবে এর মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও মুদ্রার মান প্রভাবিত হতে পারে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম বেড়েছে এবং বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রভাবিত হচ্ছে। কোনো কারণে খাদ্যশস্য, তেলের দাম প্রভৃতি বাড়লে পণ্যের উত্পাদন খরচ বাড়ে এবং এর ফলে পরিবহন, বিক্রয়মূল্যসহ অন্যান্যভাবে বিভিন্ন পণ্যের দাম বাড়ে।
বাজারদর নিয়ন্ত্রের জন্য শিল্পের সঙ্গে সঙ্গে কৃষি উত্পাদন বাড়ানো একান্ত প্রয়োজন। কৃষিজমির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা একান্ত প্রয়োজন। খাদ্যশস্যসহ অন্যান্য দ্রব্যের দাম বাড়লে প্রতিষ্ঠানগুলো মজুরি বাড়াতে বাধ্য হয়ে থাকে এবং এর প্রভাবে উত্পাদন খরচ বাড়ে। আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম বাড়ার কারণে উত্পাদিত দ্রব্যের দাম বাড়ে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে নোট ইস্যু যদি দেশীয় উত্পাদনের সঙ্গে সমন্বয়হীন হয়, তবে মুদ্রাস্ফীতি হয়ে থাকে। দেশীয় উত্পাদনের তুলনায় অতিরিক্ত নোট ইস্যু করা হলে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয় অথবা কম নোট ইস্যু হলে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হয়। সুতরাং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নোট ইস্যু ও জিডিপির সমন্বয় প্রয়োজন। রাজস্বনীতির সঙ্গে দেশীয় উত্পাদনের সমন্বয় জরুরি। কর সংগ্রহ, বিভিন্ন খাতে অর্থ বণ্টন এবং বিভিন্ন উন্নয়নমুখী প্রোগ্রাম বাড়লে জিডিপির সঙ্গে যদি সমন্বয়হীন হয়, তবে মুদ্রাস্ফীতি হতে পারে। মুদ্রানীতির মাধ্যমে অর্থের সরবরাহ ও মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যায়। মুদ্রানীতি বা মনিটারি পলিসির বিভিন্ন পন্থার মাধ্যমে অর্থের সরবরাহ নিয়ন্ত্রের মাধ্যমে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির মাধ্যমে মুদ্রাস্ফীতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হলেও এতে সঞ্চয়, বিনিয়োগ এবং উত্পাদন ও উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সতর্কতার সঙ্গে রাজস্বনীতি ও মুদ্রানীতির প্রয়োগ প্রয়োজন। অন্যথায় বেকারত্ব বাড়তে পারে এবং আয় স্তর কমে যেতে পারে। দীর্ঘমেয়াদি মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাজেট ঘাটতির জন্য স্বল্প ব্যয়ে বৈদেশিক ঋণ সংগ্রহ প্রয়োজন। দেশে বৃহত্ শিল্পপ্রতিষ্ঠান তৈরির মাধ্যমে উত্পাদন ও রপ্তানি বাড়লে টাকার মান ও মুদ্রাস্ফীতির নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স আমাদের বিনিয়োগ বাড়াতে ও অর্থনীতি শক্তিশালী করতে সহায়তা করবে এবং আন্তর্জাতিক বাজারে টাকার মান বাড়বে। অনেক সময় ব্যবসায়ীগণ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কৃত্রিম সংকট তৈরি এবং অবস্থা অনুযায়ী পণ্য সরবরাহের মাধ্যমে পণ্যের দাম বাড়িয়ে প্রচুর অবৈধ মুনাফা অর্জন করে থাকেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, সিলেট শহরের টুকের বাজারে সবজির দাম কেজিপ্রতি ৩০-৪০ টাকা হলেও বন্দর এলাকার লালবাজারে সেই সব সবজি ৬০-৭০ টাকায় বিক্রি করতে দেখা যায়। এছাড়া মাছ, মুরগির, মাংস প্রভৃতির দাম বাড়াতে সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীগণ সফল হয়ে থাকেন। বাজার মনিটরিং ও নিয়ন্ত্রণ বাড়ানো প্রয়োজন। এছাড়া অবৈধ অর্থের বিভিন্নমুখী বিনিয়োগের কারণে জমিসহ অন্যান্য দ্রব্যের দামও বেড়ে থাকে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যায়, কোনো দ্রব্যের দাম বাড়লে ভোক্তাগণ ভবিষ্যতে আরো দাম বাড়ার আশঙ্কার কথা চিন্তা করে কেনার পরিমাণ বাড়িয়ে থাকে। এতে দ্রব্যের দাম বাড়ে। এক্ষেত্রে ভোক্তাদের সচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন।
বর্তমানে বিকাশ, নগদ প্রভৃতির মাধ্যমে অর্থ সহজেই এক স্থান থেকে অন্য স্থানে স্থানান্তরিত হচ্ছে। এতে সবাই সহজেই পণ্য কেনাবেচা করতে পারছেন। অর্থের গতিশীলতা বাড়ার কারণেও মুদ্রাস্ফীতি পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। প্রায় ১৫-১৬ বছর আগে যে বাসার ভাড়া ছিল ৫ হাজার টাকা, বর্তমানে সেই বাসার ভাড়া প্রায় ১৫-১৬ হাজার টাকা। যে এলাকায় যেতে সিএনজি অটোরিকশায় ৫০ টাকা খরচ হতো, তা বর্তমানে ১৫০-১৬০ টাকা। আটার প্রতি কেজির দাম ২০-২২ টাকা থাকলেও বর্তমানে প্যাকেট আটা প্রতি কেজি প্রায় ৫৫-৬০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা যায়। দুই-তিন বছর আগে উচ্চ মাধ্যমিকের এক জন ছাত্রকে পদার্থবিজ্ঞান ও গণিত পড়ানোর জন্য এক জন শিক্ষককে ৪-৫ হাজার টাকা দিতে হলেও সিলেট শহরে বর্তমানে দিতে হচ্ছে ৭-৮ হাজার টাকা। ১৫ বছর আগে যে পরিবারটির মাসিক খরচ ছিল ৩০-৩৫ হাজার টাকা, বর্তমানে সেই পরিমাণ খরচের জন্য একটি পরিবারের প্রয়োজন ৮০-৯০ হাজার টাকা। আমাদের দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য মুদ্রাস্ফীতির কারণ বিশ্লেষণ এবং অতিমাত্রায় মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে দীর্ঘমেয়াদি ও দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ একান্ত প্রয়োজন।
লেখক : অধ্যাপক, ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট