রাইসির মৃত্যুতে ইরান ও মধ্যপ্রাচ্যে কী প্রভাব ফেলবে?

মাজিদ রাফিজাদেহ

ফাইল ছবি

ইরানের ভারজাকানে গত রোববারের হেলিকপটার বিপর্যয় ছিল একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। হেলিকপটারটিতে ইরানের প্রেসিডেন্ট ইবরাহিম রাইসি, পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আবদুল্লাহিয়ান, পূর্ব আজারবাইজানের গভর্নর মালেক রহমাতি এবং পূর্ব আজারবাইজানের সর্বোচ্চ নেতার প্রতিনিধি মোহাম্মদ আলী আল-হাশেমসহ বেশ কয়েক জন উচ্চপদস্থ ইরানি কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। এ ঘটনার ফলে হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে ইরানের বর্তমান প্রেসিডেন্টের নজিরবিহীন মৃত্যু ঘটে। মৃত ব্যক্তিদের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ও প্রভাবের কারণে এ ঘটনা মধ্যপ্রাচ্য ও বিশ্ব জুড়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। উক্ত ঘটনা এমন একটা সময়ে ঘটেছে, যখন মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক উত্তেজনা এবং ইরানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি একটা চ্যালেঞ্জিং সময় পার করছিল, যার প্রভাব তাত্ক্ষণিক ও সুদূরপ্রসারী উভয়ই হতে পারে।

ইবরাহিম রাইসি লম্বা সময় ধরে ডেপুটি প্রধান বিচারপতি, অ্যাটর্নি জেনারেল এবং প্রধান বিচারপতিসহ অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ১৯৮০ ও ১৯৯০-এর দশকে তেহরানের ডেপুটি প্রসিকিউটর, তার পরে প্রসিকিউটর হিসেবে তাঁর বিচারিক ভূমিকার কারণে তিনি অনেক পর্যবেক্ষকের নজরে এসেছিলেন। ‘তেহরানের কসাই’ হিসেবে পরিচিত রাইসি ১৯৮৮ সালে ৫ হাজারেরও বেশি রাজনৈতিক বন্দির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার জন্য দায়ী প্রসিকিউশন কমিটির চার সদস্যদের একজন ছিলেন। এছাড়া তিনি ২০১৬ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত বিশিষ্ট বনিয়াড আস্তান কুদস রাজাভির কাস্টোডিয়ান এবং চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। একই সময়ে তিনি দক্ষিণ খোরাসান প্রদেশের বিশেষজ্ঞ পরিষদের সদস্য ছিলেন।

২০১৭ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে রাইসির রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পেয়েছিল, যখন তিনি ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ডের কনজার্ভেটিভ পপুলার ফ্রন্টের প্রার্থী ছিলেন, যদিও তিনি মধ্যপন্থি ক্ষমতাসীন দলের হাসান রুহানির কাছে পরাজিত হয়েছিলেন। ২০২১ সালে তার দ্বিতীয় প্রেসিডেনশিয়াল ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে তিনি রুহানির পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন।

ইবরাহিম রাইসিকে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির সম্ভাব্য উত্তরসূরি হিসেবে গণ্য করা হতো। ধর্মীয় প্রভাবশালী বলয়ের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এবং ইরানের রাজনৈতিক ও বিচারব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য প্রভাব তাকে দেশের শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক ভূমিকার জন্য যোগ্য করে তুলেছিল। ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের মূল মূল্যবোধের সঙ্গে তার সামঞ্জস্যতা এবং বিভিন্ন বিচার বিভাগীয় ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করে তিনি নিজেকে একজন যোগ্য নেতা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিলেন।

ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে চরম উত্তেজনা চলাকালীন রাইসির মৃত্যু ঘটেছে। গত মাসে সিরিয়ার দামেস্কতে ইরানের কনস্যুলেটকে লক্ষ্য করে একটি ইসরায়েলি বিমান হামলার ফলে কুদস ফোর্সের সিনিয়র কমান্ডার মেজর জেনারেল মোহাম্মদ রেজা জাহেদি এবং ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পসের সাত কর্মকর্তাসহ বেশ কয়েকজন উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তি নিহত হন। পরে ইসরাইলের বিরুদ্ধে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা করে তার প্রতিশোধ নিয়েছিল ইরান, যা চলমান উত্তেজনাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল। এরপর ইসরাইল ইরানের বিভিন্ন সামরিক স্থাপনায় একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। এসব ঘটনা মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল, যা ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতের সূচনা তৈরি করেছিল।

ইরানের পারমাণবিক শক্তি অর্জনে অগ্রগতি আঞ্চলিক ও বিশ্বব্যাপী উভয় ক্ষেত্রেই তীব্র উত্তেজনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। চলমান আঞ্চলিক দ্বন্দ্বের সঙ্গে নতুন এই উত্তেজনা চলমান পরিস্থিতিকে আরো জটিল ও অস্থির করে তুলেছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সম্ভাবনা নিয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন, যা ইতিমধ্যে ভঙ্গুর মধ্যপ্রাচ্যকে আরো অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে।

ইরানের সংবিধান অনুযায়ী প্রেসিডেন্টের মৃত্যুর অর্থ হলো প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট, অর্থাত্ বর্তমানে মোহাম্মদ মোখবার পরবর্তী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। তবে এই ক্ষমতায়ন পদ্ধতি স্বয়ংক্রিয় নয়, কারণ এক্ষেত্রে ইরানের সর্বোচ্চ নেতার অনুমোদনের প্রয়োজন রয়েছে। গত সোমবার অনুমোদন সাপেক্ষে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির পদে মোখবারের পদোন্নতি বোঝা যায় যে ইরানের রাজনৈতিক কাঠামোতে খামেনির প্রভাব কতটা শক্তিশালী, যদিও ইরানের সংবিধান অনুযায়ী এটা ঘটে থাকে।

উনসত্তর বছর বয়সি মোখবার ২০২১ সাল থেকে ইরানের প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। একই সঙ্গে তিনি এক্সপিডিয়েন্সি ডিসার্নমেন্ট কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন। তাছাড়া তিনি ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পস তথা ‘আইআরজিসি’র মেডিক্যাল কর্পসে একজন অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। যেকোনোভাবে প্রেসিডেন্টের মৃত্যুর ঘটনা ঘটলে ইরানের সংবিধান অনুযায়ী প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট, পার্লামেন্টের স্পিকার ও বিচার বিভাগের প্রধানের সমন্বয়ে গঠিত কাউন্সিলকে অবশ্যই সর্বোচ্চ ৫০ দিনের মধ্যে নতুন রাষ্ট্রপতির জন্য একটি নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে।

‘আইআরজিসি’র একজন সাবেক সামরিক কর্মকর্তা ও ২০০৮ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত পার্লামেন্টের স্পিকার হিসেবে দায়িত্বরত আলি লারিজানি ইরানের পরবর্তী রাষ্ট্রপতি পদের একজন সম্ভাব্য প্রার্থী। সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমাদিনেজাদও আবার নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কথা ভাবতে পারেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আবদোল নাসের হেমতি আরেক প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারেন। মোহসেন রেজাই, ১৯৮১ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত ‘আইঅরজিসি’র কমান্ডার-ইন-চিফ এবং সুপ্রিম ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের প্রাক্তন সেক্রেটারি সাইদ জলিলিও সম্ভাব্য প্রার্থী। তারা সবাই ইরানের কট্টরপন্থি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিত্ব করেন।

রাইসির মৃত্যুর কারণে ইরানের অভ্যন্তরীণ বা বৈদেশিক নীতির মৌলিক পরিবর্তনের সম্ভাবনা কম। এটি মূলত খামেনির স্থায়ী প্রভাবের কারণে ঘটতে পারে, যিনি দেশে চূড়ান্ত কর্তৃত্বের অধিকারী। উপরন্তু, ‘আইআরজিসি’ও রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে যথেষ্ট শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে, যাতে ইরানের কৌশলগত দিক অপরিবর্তিত থাকে। যদিও রাইসির মৃত্যু বেশ তাত্পর্যপূর্ণ। তবে ইরানের মধ্যে ক্ষমতার বৃহত্তর কাঠামো এখনো অপরিবর্তিত রয়েছে। বর্তমানে আলি খামেনি ও ‘আইআরজিসি’ দেশের পলিসি মেকিংয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছেন।

তবে রাইসির মৃত্যু আলি খামেনির সম্ভাব্য উত্তরসূরিদের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতার সূত্রপাত ঘটাতে পারে। ৮৫ বছর বয়সি ইরানের সর্বোচ্চ নেতার বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার উত্তরসূরি সম্পর্কে জল্পনা-কল্পনাও বাড়ছে এবং রাইসির মৃত্যু ইরানের কট্টরপন্থি রাজনৈতিক অভিজাতদের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতার কারণে প্রতারণা বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এই প্রতিযোগিতা কেবল পরবর্তী সর্বোচ্চ নেতা কে হবেন তা নিয়ে নয়, কে পরবর্তী রাষ্ট্রপতি পদে আরোহণ করবেন তা নিয়েও। ইরানের ভবিষ্যত্ রাজনৈতিক গতিপথ নির্ধারণের ক্ষেত্রে এ দুটি পদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে খামেনি-পরবর্তী যুগে। আগামী কয়েক মাসে ইরানের ভবিষ্যত্ রাজনৈতিক কাঠামো নির্ধারণে বিশিষ্ট রাজনীতিবিদদের রাজনৈতিক কূটকৌশল চরম আকার ধারণ করতে পারে।

লেখক : ইরানি বংশোদ্ভূত আমেরিকান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী

আরব নিউজ থেকে অনুবাদ : আব্দুল্লাহ আল মামুন

শেয়ার করুন