ঘূর্ণিঝড় রেমালের তাণ্ডব: ৩৯টি মৃত হরিণ উদ্ধার

নিজস্ব প্রতিবেদক

ঘূর্ণিঝড় রেমাল উপকূলীয় অঞ্চলে তাণ্ডব তালিয়ে আপাতত নিস্তেজ হয়ে গেছে। লোকালয়, জনজীবন, ফসল ও ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্তের খবর সহজে জানা গেলেও সময়ের সঙ্গে আস্তে আস্তে আসছে সুন্দরবন ও বন্যপ্রাণির প্রাণহানির খবর।

সুন্দরবনে গাছপালার ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি অনেক বন্যপ্রাণি হতাহতের আশাঙ্কা শুরু থেকেই ছিল। ধীরে ধীরে সে আশঙ্কা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। উপকূলে তাণ্ডব চালানোর একদিন পর মঙ্গলবার প্রায় অর্ধশত বন্যপ্রাণির মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।

universel cardiac hospital

এদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকা থেকে অন্তত ৩৯টি মৃত হরিণ, একটি মৃত বন্য শুকর ও ১৭টি আহত হরিণ উদ্ধার করার কথা জানিয়েছে বন বিভাগ। আশঙ্কা করা হচ্ছে অনেক বন্যপ্রাণী মৃত বা আহত অবস্থায় ভেসে গেছে।

এদিকে ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে জলোচ্ছ্বাসের কারণে সুন্দরবনের অনেক এলাকা তলিয়ে গেছে। ফলে বনের ভেতরে থাকা প্রাণিকূলের পানি পানের মিঠাপানির জলাধার নোনাজলে নষ্ট হয়ে গেছে। যা ঝড় পরবর্তী সময়ে প্রাণিদের জীবনধারণে অসুবিধা তৈরি করবে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রেমালের ক্ষয়ক্ষতির প্রভাব ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি তৈরি করেছে। গাছপালা ভেঙেছে, অনেক প্রাণি মারা গেছে কিংবা আহত হয়েছে, প্রাণিদের খাবার পানির জলাধার তলিয়ে গেছে। কোনো কোনো জলাধার (পুকুর) বিলীনও হয়ে গেছে।

বন বিভাগ জানায়, তীব্র স্রোত ও ঢেউয়ের তোড়ে বনের কটকা এলাকার পুকুরটি বঙ্গোপসাগরে বিলীন হয়ে গেছে।

এছাড়াও সমুদ্র–তীরবর্তী দুবলার চর ও কটকা বন বিভাগের কার্যালয়ের জেটি স্রোতের তোড়ে ভেসে গেছে। বিভিন্ন স্থানে বনকর্মীদের থাকার ঘরের জানালার কাঁচ, সুপেয় পানির ট্যাংক, সোলার প্যানেল বাতাসে উড়ে গেছে।

জানা গেছে, মিষ্টি পানির আধার হিসেবে সুন্দরবনে রয়েছে ১১৫টি পুকুর। এর মধ্যে শুধু বিভিন্ন প্রাণীর জন্য ছোট আকারের পুকুর ৩৫টি। আর মানুষ ও প্রাণী উভয়ের জন্য ৮০টি পুকুর আছে। সবগুলো পুকুর লোনা পানিতে তলিয়ে গেছে।

সুন্দরবন একাডেমির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির গণমাধ্যমকে বলেন, ‘সুন্দরবন ঝড়ের তীব্রতা যেমন ঠেকিয়েছে, তেমনি অস্বাভাবিক জলোচ্ছ্বাসের গতিও মন্থর করেছে। তবে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে মিষ্টি ও লবণ পানির যে মিথস্ক্রিয়া তা নষ্ট হয়েছে। জলোচ্ছ্বাসে বনের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে লবণ পানি ঢুকেছে যা বনের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্যকে নষ্ট করবে।’

খুলনা সার্কেলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো বলেন, ‘সুন্দরবনে যে ক্ষতি হয়েছে সেখানে আমার মনে হয়েছে উদ্ভিদের তুলনায় প্রাণীকুল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বেশি। সিডরের সময় যেমন বেশি গাছপালা পড়ে গিয়েছিল, তখন প্রাণীকুলের অতটা ক্ষতি হয়নি। ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে কিন্তু ২৬ তারিখ সকাল থেকে সুন্দরবন প্লাবিত হয়েছে। কোথাও ৮-১০ ফিট, কোথাও কোথাও তারও বেশি জোয়ারের পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে সুন্দরবনের অধিকাংশ জায়গা। বিশেষ করে মান্দারবাড়িয়া, কটকা, কচিখালী অধিক জোয়ারে ভেসেছে।’

তিনি বলেন, ‘৩৬ ঘণ্টা পর বন থেকে পানি নেমেছে। পানি নামার গতি এবং তীব্র জলোচ্ছ্বাসে সাধারণ প্রাণীকুল ভেসে যাওয়া স্বাভাবিক।’

‘কাজেই এই দীর্ঘ সময়ে বাঘ শাবক, হরিণ শাবক এমনকি প্রাপ্তবয়স্ক প্রাণীরও বেঁচে থাকা কঠিন। কারণ কোথাও উঁচু জায়গা ছিল না।’

সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগের বানিয়াখালী ফরেস্ট স্টেশন কর্মকর্তা মো. মনিরুল ইসলাম জানান, তার স্টেশনের আওতাধীন বনের ভেতরে কয়রা টহল ফাঁড়ির মিঠা পানির পুকুরটি ঘূর্ণিঝড়ের সময় উঁচু জোয়ারে নোনা পানিতে তলিয়ে গেছে। সুন্দরবনে অবস্থান করা বনকর্মী, জেলে-বাওয়ালি, মৌয়াল ছাড়াও বন্য প্রাণীগুলো এই পুকুরের পানি পান করে।

সুন্দরবনের করমজল বন্যপ্রাণী ও প্রজনন কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হাওলাদার আজাদ কবির বলেন, ‘বেশ কয়েকটি ঝড়-জলোচ্ছ্বাস দেখেছি। কিন্তু এত বেশি পানি আগে কখনো দেখিনি। স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে অন্তত ৫-৭ ফুট পানি বেশি হয়েছিল করমজলে।’

সাগর উপকূলে দুবলা, কটকা, কচিখালী এলাকায় পানি আরও কয়েক ফুট বেশি হয়েছিল বলে তিনি উল্লেখ করেন।

তবে জোয়ার-জলোচ্ছ্বাসে করমজল প্রজনন কেন্দ্রের কুমির-কচ্ছপসহ প্রাণীদের কোনো ক্ষতি হয়নি জানিয়ে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘বনের মাঝে প্রাণীদের জন্য বেশ কিছু উঁচু স্থান করে দেওয়া হয়েছে। এই টাইগার টিলাগুলোতে কিছু প্রাণী আশ্রয় নিতে পেরেছে।’

শেয়ার করুন