রাজধানী ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার একটি অ্যাপার্টমেন্টে দুদিন আগে খুন হন জাপানপ্রবাসী আরিফুল ইসলাম। এ ঘটনায় সামনে আসছে পারভীন আক্তার নামে এক কানাডাপ্রবাসী নারীর নাম। ওই নারী আরিফুলের স্ত্রী বলে প্রমাণ মিলেছে। দুজনই আগে থেকে বিবাহিত হলেও তাদের দ্বিতীয় বিয়ের কথা গোপন ছিল।
পারভীন ২৪ ঘণ্টা বা তার কিছু বেশি সময়ের জন্য দেশে এসে এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে আবার কানাডা ফিরে গেছেন। দুজনের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি-ভিডিও কেন্দ্র করে অনৈতিক সুবিধা নেওয়ার জেরে এ খুন বলে ধারণা করছে পুলিশ।
তদন্ত সূত্রে জানা যায়, নিহত আরিফুল ইসলাম রাজধানীর বিজয়নগরে একটি আবাসিক হোটেলে চাকরি করতেন। এসময় জাপানি এক তরুণীর সঙ্গে তার পরিচয় হয়। পরিচয় থেকে প্রেমের সম্পর্ক। এক বছর আগে আরিফুল চাকরি ছেড়ে জাপান চলে যান। সেখানে জাপানি তরুণী নাচুকিকে (বর্তমানে নাম আয়েশা) বিয়ে করেন।
এদিকে অভিযুক্ত কানাডাপ্রবাসী পারভীন আক্তারকেও বিয়ে করেন আরিফুল। তবে এ বিয়ের কথা তারা দুজন ছাড়া পরিবারের কেউ জানতেন না। বসুন্ধরার যে অ্যাপার্টমেন্ট থেকে আরিফুলের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে, সেখানে আরিফুল ও পারভীন আক্তারের বিয়ের একটি নোটারি হলফনামা পাওয়া গেছে। হলফনামায় দেখা যায়, তারা ২০২১ সালের ৩০ ডিসেম্বর বিয়ে করেন।
কাউকে না জানিয়ে গত ১৬ মে আকস্মিক ঢাকায় আসেন পারভীন। ২৪ ঘণ্টার মতো রাজধানীর বসুন্ধরা এলাকার একটি বাসায় অবস্থান করে পরদিন ফের কানাডার মন্ট্রিলে চলে যান। তবে বসুন্ধরার যে বাসায় তিনি ছিলেন, সেখান থেকে শনিবার (১ জুন) রাতে অর্ধগলিত এক পুরুষের মরদেহ উদ্ধারের পর প্রযুক্তিগত তদন্তে পারভীনের নামটি সামনে আসে। এতে চমকে ওঠেন তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা।
অনলাইনে যোগাযোগের মাধ্যমে বসুন্ধরার ওই ফ্ল্যাট এক সপ্তাহের জন্য ১৩ হাজার টাকায় ভাড়া নিয়েছিলেন আরিফুল। তিনি ১৭ মে জাপান থেকে ঢাকায় ফিরে ওই ফ্ল্যাটে ওঠেন।
আরিফুলের মরদেহের পাশে একটি চিরকুটে লেখা ছিল। ধারণা করা হচ্ছে পারভীন চিরকুটটি লিখে যান। চিরকুটে লেখা ছিল, ‘আমার জীবনের শান্তি নষ্ট করে দিছে এই রেপিস্ট (ধর্ষক), ব্ল্যাকমেলার। সে তার নিজের ইচ্ছায় আমার হাতে ধরা দিছে। নিজের হাতে এই রেপিস্ট, ব্ল্যাকমেলারকে মেরে শান্তি নিলাম।’
তদন্ত সংশ্লিষ্টদের ধারণা, পারভীন দেশে থাকাকালীন আরিফুলের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক ছিল। সেই সম্পর্কের জেরে তারা বিভিন্ন আবাসিক হোটেলে যেতেন। সে সময় অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি তুলে রেখেছিলেন আরিফুল। সেই ছবির কথা বলে বিভিন্ন সময় ব্ল্যাকমেইল করতেন তিনি। ওই ছবি ব্যবহার করে দীর্ঘদিন পারভীনের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক বজায় রাখেন। এরপর পারভীনের জোরাজুরিতে ২০২১ সালের ৩০ ডিসেম্বর তারা বিয়ে করেন। তবে বিষয়টি গোপন রাখেন দুজনই। এছাড়া এসব অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি-ভিডিওর কথা বলে বিভিন্ন সময় মোটা অংকের টাকাও নিতেন আরিফুল।
বছরখানেক আগে আরিফুল চলে যান জাপান। সেখানে এক জাপানি তরুণী নাচুকিকে বিয়ে করেন। বিয়ের পর ধর্মান্তরিত হলে নাচুকির নতুন নাম রাখেন আয়েশা। জাপানি ওই তরুণী বর্তমানে অন্তঃসত্ত্বা।
আরিফুলের কাছে থাকা অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি-ভিডিওর রফাদফা করতে ঢাকায় আসেন পারভীন। প্রথমে আত্মহত্যার কথাও ভাবেন তিনি। তবে পরে নিজের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আরিফুলকে খুন করার সিদ্ধান্ত নেন। মাটি প্রপার্টিজের ওই অ্যাপার্টমেন্টে আরিফুল ঘুমিয়ে পড়লে তাকে ছুরিকাঘাত করেন পারভীন। ওই ছুরি আগে থেকেই পারভীনের কাছে ছিল।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মনে করছেন, দীর্ঘদিনের ক্ষোভ ও অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি-ভিডিও আরিফুলের কাছে থাকার কারণে পারভীন আক্তার খুন করে আবার কানাডায় চলে যান।
পুলিশ জানায়, পারভীন গত ১৬ মে কানাডা থেকে ঢাকায় এসে একটি হোটেলে ওঠেন। পরদিন বেলা ১১টায় বসুন্ধরার ভাড়া ফ্ল্যাটে যান। পারভীন ঢাকায় ফিরেছেন নিশ্চিত হয়ে জাপান থেকে ১৭ মে বিকেল ৪টায় ঢাকায় আসেন আরিফুল। এর আগেই বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার সি-ব্লকের ২ নম্বর রোডের এক নম্বর ভবনে মাটি প্রপার্টিজের ২০৩ নম্বর স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট সাতদিনের জন্য ভাড়া করেন আরিফুল। অগ্রিম ১৩ হাজার টাকা বিলও পরিশোধ করেন অনলাইনে। দেশি-বিদেশি নাগরিকরা অল্পদিনের জন্য অনলাইনে স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নেন।
পুলিশের জব্দ করা ভবনের সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা যায়, ১৭ মে বিকেল ৪টা ৯ মিনিটে আরিফুল ও পারভীন অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকেছেন। দুজনের মুখেই ছিল মাস্ক। আরিফুলের হাতে একটি লাগেজ। ১৮ মে ভোর ৬টা ৩১ মিনিটে পারভীন অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বের হয়ে যান।
বাড্ডা থানা পুলিশ জানায়, সিসি ক্যামেরার ফুটেজ ও তদন্তে তারা আরিফুলের সঙ্গে পারভীনকে ঢুকতে দেখেছেন। এরপর পারভীনকে একা বের হয়ে যেতে দেখা যায়। এর ১৫ দিন পর ১ জুন বিকেলে পরিচ্ছন্নতাকর্মী ওই কক্ষের দরজা নক করে সাড়াশব্দ না পেয়ে বিকল্প চাবি দিয়ে ঘর খুলে মরদেহ দেখতে পান। এরপর খবর পেয়ে পুলিশ মরদেহ উদ্ধার করে।
আরিফুল হত্যাকাণ্ডে তার বোন সাফরিজা আক্তার রেলি ২ জুন বাদী হয়ে ভাটারা থানায় মামলা করেন। মামলায় পারভীন আক্তার ও তার কানাডাপ্রবাসী স্বামী নাজমুল হাসান বাবুকে আসামি করা হয়েছে।
নিহত আরিফুলের চাচাতো ভাই সবুজ মিয়া জানান, পারভীনের সঙ্গে তার ভাইয়ের বিয়ের বিষয় তারা জানতেন না। এছাড়া পারভীনের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কের কথাও জানতেন না। এখন অনেক কিছু জানা যাচ্ছে।
আরিফুলের বোন সাফরিজা আক্তার রেলি বলেন, ‘আমার ভাই জাপানে গিয়ে বিয়ে করার ফলে পারভীন ক্ষিপ্ত হয়। বিভিন্ন সময় মোবাইলে আমার ভাইকে খুন করবে বলে ভয়ভীতি দেখিয়ে হুমকিও দেয়। তখন আমরা নিশ্চিত হই পারভীন ও তার স্বামী নাজমুল হাসান বাবু পূর্বপরিকল্পিতভাবে আমার ভাইকে জাপান থেকে কৌশলে বাংলাদেশে এনে ১৭ মে রাত ৮টা থেকে ১৮ মে সকাল ৬টা ৩১ মিনিটের মধ্যে যে কোনো সময় ওই ফ্ল্যাটে খুন করে পালিয়ে যায়।’
আরিফুলের বোন আরও বলেন, ‘এছাড়া মাটি প্রোপার্টিজের মালিক, ম্যানেজার, কর্মচারী এবং পারভীন ও তার স্বামীর আত্মীয়রা আমার ভাইয়ের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে বলে সন্দেহ করছি।’
পুলিশ মরদেহ উদ্ধার করে রাতেই শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠায়। রোববার দুপুরে (২ জুন) মরদেহের ময়নাতদন্ত করা হয়। বিকেলে মরদেহ নিয়ে স্বজনরা গ্রামের বাড়ির উদ্দেশে রওয়ানা হন। রাতেই গ্রামের কবরস্থানে তার মরদেহ দাফন করা হয়।
এ বিষয়ে গুলশান বিভাগের বাড্ডা জোনের সহকারী কমিশনার (এসি) রাজন কুমার সাহা বলেন, ‘অ্যাপার্টমেন্টের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে ও প্রযুক্তির সহায়তায় পারভীন আক্তারের নাম আসে। ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ থেকে আরিফুলকে হত্যা করেছে পারভীন বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। পারভীন ২৪ ঘণ্টার জন্য দেশে এসে আবার কানাডায় ফিরে যান। তার স্বজনদের সঙ্গে তদন্তের জন্য যোগাযোগ করা হচ্ছে।’
জানতে চাইলে ডিএমপির গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) রিফাত রহমান শামীম বলেন, ‘অভিযুক্ত পারভীন আক্তারই আরিফুলকে খুন করেছে। কারণ সিসি ক্যামেরার ফুটেজ, তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্লেষণ করে পারভীনকেই একমাত্র আসামি হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে। কানাডা থেকে পারভীনকে ফেরাতে পুলিশের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরোর (এনসিবি) সহায়তায় ইন্টারপোলে চিঠি দেওয়া হবে।’