আমি সব সময় বলে আসছি যে, এত কম বরাদ্দ দিয়ে এত ভালো লেখাপড়া পৃথিবীর আর কোনো দেশে হয় না। যেখানে জিডিপির কমপক্ষে ৪ শতাংশ বরাদ্দের প্রয়োজন সেখানে এখনো ১ দশমিক ৬৯ শতাংশ বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। শিক্ষায় আমাদের দেশে এত অবিশ^াস্য রকম কম বরাদ্দ দেওয়া হয়। এত কম বরাদ্দের মধ্যেই এই খাতটি চালিয়ে নিতে হচ্ছে। এটি সত্যিই অবিশ্বাস্য।
বাজেটে অন্য খাতে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। কিন্তু শিক্ষায় প্রাধান্য অনেক কম দেওয়া হচ্ছে প্রতিবার। এই খাতে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। যদি পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ থাকতো তাহলে শিক্ষার্থীদের কর্মমুখী এবং সৃজনশীল করা যেতো। কম বাজেটে যে মানের শিক্ষা দেওয়া হয় ভবিষ্যতে যদি তাদের কাজেই না লাগানো যায় তাহলে এর কোনো উপযোগিতা পাওয়া যায় না।
মানবসম্পদ উন্নয়নই আসল উন্নয়ন। শিক্ষার মাধ্যমেই এই উন্নয়ন সম্ভব। কিন্তু আমাদের দেশে অনেকের মাইন্ডসেট হলো শিক্ষার উন্নয়ন বলতেই বোঝে অবকাঠামোর উন্নয়ন। তাই শিক্ষায় যতটুকুই বরাদ্দ হয় তার বেশিরভাগ অবকাঠামো তৈরিতে ব্যয় হয়। অবকাঠামোর উন্নয়ন তো সহজ। কিন্তু মানবসম্পদ বেশ কঠিন। তাই আমার ব্যক্তিগত অভিমত হলো- মানবসম্পদ উন্নয়ন কিভাবে করা যায় সেদিকে নজর দেওয়া উচিত। তবুও অবকাঠামোর উন্নয়নই হচ্ছে। কারণ সেখানে দুর্নীতি করার সুযোগ রয়েছে। অথচ কম বরাদ্দ হলেও সৎ উদ্দেশ্য থাকলে যথাযথভাবে ব্যয় হলেও উপকার পাওয়া যেত। নতুন শিক্ষাক্রম করতে গিয়ে দেখলাম অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সায়েন্স ল্যাব নেই, কম্পিউটার ল্যাব নেই, লাইব্রেরি নেই। যদি মানবসম্পদ উন্নয়নে ব্যয় না করে অবকাঠামোতেই ব্যয় করতে চাই তবে এসব ঘাটতি অন্তত পূরণ করুক।
পৃথিবীতে এমন অনেক দেশের উদাহরণ রয়েছে যারা শিক্ষায় যেমন অর্থ ব্যয় করেছে খুব দ্রুত সেই দেশ এগিয়েছে। শিক্ষক হিসেবে এবং শিক্ষা নিয়ে কাজ করা মানুষ হিসেবে আমি মনে করি বরাবরের মতো এবারও খুব কম বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। যদি জিডিপির ৪ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া যেত তাহলে পরিকল্পনা করে অনেক কাজ করা যেত।
শিক্ষায় বরাদ্দ বাড়লে শিক্ষার্থীদের আরও খাবার দেওয়া সম্ভব হতো। ফলে ঝরে পড়া রোধ হতো। ইতিমধ্যে নারী শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি দেওয়ার কারণে ঝরে পড়াও অনেকটা রোধ করা গেছে। বাংলা মাধ্যমে শিক্ষা ব্যয় বেশি থাকে। ফলে বর্তমানে অনেক শিক্ষার্থী কওমী মাদ্রাসায় ভর্তি হচ্ছে। কারণ সেখানে বিনামূল্যে থাকা এবং খাওয়ার সুযোগ রয়েছে। শিক্ষায় বরাদ্দ বাড়লে বাংলা মাধ্যমেও সেই সুযোগ দেওয়া সম্ভব হতো। এছাড়া প্রাথমিকের ধাপ শেষ করে মাধ্যমিকে যেতেই বিশাল অংশ ঝরে পড়ে। তাই প্রাথমিক বিদ্যালয়কে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত করলে ঝরে পড়া আরও কমিয়ে আনা যাবে। সেটি বাস্তবায়নেও প্রয়োজন পর্যাপ্ত অর্থ।
আমাদের শিক্ষক সংকট রয়েছে। যেখানে ৩০ শিক্ষার্থীর বিপরীতে একজন শিক্ষক দরকার। কিন্তু বর্তমানে সংখ্যাতীত শিক্ষার্থীর বিপরীতে একজন শিক্ষকের পাঠদান করতে হয়। এছাড়া পেশা হিসেবেও এটি আকর্ষণীয় নয়। আমি এখন পর্যন্ত যত স্কুলে গিয়েছি কোনো শিক্ষার্থী বড় হয়ে শিক্ষক হতে চায়নি। পৃথিবীর অনেক দেশ রয়েছে যেখানে শিক্ষকদের বেতনের পাশাপাশি নানা রকম সুবিধা দেওয়া হয়। ফলে সেসব দেশের শিক্ষার্থীরা শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে নিতে চায়। দেশেও শিক্ষায় বরাদ্দ বাড়লে শিক্ষকদের সেসব সুযোগ-সুবিধা দেওয়া সম্ভব।
মুহম্মদ জাফর ইকবাল, শিক্ষাবিদ ও লেখক