টানা তৃতীয়বার ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। এটা তার এক রেকর্ড। এর আগে জওহরলাল নেহরু ছাড়া আর কেউ টানা তিন মেয়াদে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়া গৌরব অর্জন করতে পারেননি। তবে প্রধানমন্ত্রী হতে পারলেও মোদির জনপ্রিয়তায় যে টান পড়েছে, সেটা এবার ভোটের ফলাফলে স্পষ্ট হয়েছে। মোদির দল বিজেপি যতটা বিজয় আশা করেছিল ততটা হয়নি। এমনকি সরকার গঠনের জন্য যে ম্যাজিক সংখ্যা ২৭২ আসনে জয়, সেটাও একক দল হিসেবে বিজেপি পায়নি। বিজেপি পেয়েছে ২৪০ আসন।
গত নির্বাচনে বিজেপির আসন সংখ্যা ছিল ৩০৩। এবার নরেন্দ্র মোদি নিজে ও তার সমর্থকেরা ৪০০শর বেশি আসনে জয়ী হওয়ার আশা করলেও বাস্তবে সেটা হয়নি। মোদি নিজেকে ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে দাবি করলেও সাধারণ ভোটারদের মন জয় করতে পারেননি। হিন্দুত্ববাদের যে জয়ডঙ্কা বাজিয়ে ধর্মনিরপক্ষতার নীতি অনুসরণ করা ভারতে রামরাজত্ব প্রতিষ্ঠার খোয়াব পূরণ মোদির জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বরং এবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি মেয়াদ পূরণ করতে পারবেন কি না, সে প্রশ্ন উঠছে এখনই। মোদি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নয়, কর্তৃত্ববাদী মানসিকতায় বিশ্বাসী। তিনি নিজেকে অন্যদের চেয়ে উঁচু অবস্থানে ভাবেন। অথচ এবার তাকে ক্ষমতায় বসতে হয়েছে জোটের ওপর ভরসা করে। জোটের শরিকদের মন রক্ষা করে নরেন্দ্র মোদি কতটা স্বাচ্ছন্দ্যে ভারত শাসন করতে পারবেন, সে প্রশ্নও জোরালোভাবেই সামনে আসছে।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদির শপথ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুই দিনের জন্য দিল্লি যান। মোদি নিজেই শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। শপথ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ছাড়াও দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানরা উপস্থিত ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মোদি ২০১৪ সালে যেদিন প্রথমবার শপথ নিয়েছিলেন; সেদিনও তিনি বিশ্ব নেতাদের নিমন্ত্রণ করেছিলেন। তৃতীয়বার এসেও তিনি তা বজায় রেখেছেন। সেই হিসেবে শপথ অনুষ্ঠানে বিশ্ব নেতাদের যোগদান নিয়ামিত বিষয়। এবার যেটা লক্ষণীয় সেটা হলো, তৃতীয়বারের মতো শপথ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে একান্ত বৈঠক করবেন, যার রাজনৈতিক ও কূটনৈতিকভাবে যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে।
ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের পর্যবেক্ষক অধ্যাপক ড. শ্রীরাধা দত্ত মনে করেন, ভারতের যে নেইবারহুড পলিসি (প্রতিবেশী দেশগুলো সম্পর্কে নীতি) তাতে কিন্তু একটা ‘ব্রড কনসেনসাস’ (মোটা দাগে ঐকমত্য) তৈরি হয়েই গেছে। ফলে ভারতে বিজেপি বা কংগ্রেসের একক সরকারই থাকুক বা জোট সরকার, সেখানে খুব কিছু পার্থক্য হবে না। হ্যাঁ, আমেরিকা বা চীনের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে অল্প বিস্তর হতে পারে, কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা কখনোই হবে না।
শেখ হাসিনা নরেন্দ্র মোদির শপথ গ্রহণে যেমন যোগ দিয়েছেন, তেমনি দু-তিন সপ্তাহের ভেতরে ভারত সরকারের আমন্ত্রণে রাষ্ট্রীয় সফরেও তার আবার দিল্লিতে আসার কথা। এখন এত ঘন ঘন দিল্লিতে এসে তিনি নিশ্চই খালি হাতে ফিরতে চাইবেন না। বরং আমার ধারণা, তিস্তার মতো ইস্যুতে তাকে বড় কোনো প্রতিশ্রæতি দেয়া হয়েছে বলেই তিনি এই সফরগুলোতে সম্মতি দিয়েছেন।
নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর মোদিকে শুভেচ্ছা জানিয়ে শেখ হাসিনা ৫ মে বুধবার এক বার্তায় বলেন, বাংলাদেশের জনগণ এবং আমার নিজের পক্ষ থেকে ১৮তম লোকসভা নির্বাচনে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) নেতৃত্বে এনডিএ জোটের নিরঙ্কুশ বিজয়ের জন্য আপনাকে আমার আন্তরিক অভিনন্দন জানাতে চাই। তৃতীয় মেয়াদে নতুন করে জনগণের রায় নিয়ে মোদির এ নবযাত্রায় দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক সব ক্ষেত্রেই অব্যাহত থাকবে বলেও আশা প্রকাশ করেন শেখ হাসিনা।
এদিকে ভারত সফরের পরই বেইজিং যাবেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। চলতি মাসে আরো একবার ভারত সফরে যেতে পারেন হাসিনা। এরপরই চিন যাবেন তিনি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, এখন পর্যন্ত নির্ধারিত বা পরিবর্তিত তারিখ অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী সরকারি সফরে নয়াদিল্লি এবং ৯-১২ জুলাই বেইজিং সফর করবেন।
গত জানুয়ারিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি নির্বাচনে জয়ের জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উষ্ণ অভিনন্দন জানিয়েছিলেন এবং ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ঐতিহাসিকভাবে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক অব্যাহত জোরদার করার আশা প্রকাশ করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী মোদি ও শেখ হাসিনার মধ্যে সর্বশেষ দ্বিপক্ষীয় বৈঠক ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে জি-২০ নেতাদের শীর্ষ সম্মেলনের সময় হয়েছিল, যেখানে বাংলাদেশ অতিথি দেশ ছিল। শেখ হাসিনাকে জুলাইয়ে চিন সফরের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। চিনে এখন বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম উন্নয়ন অংশীদার। সে কারণে হাসিনার জন্য চিন সফরও গুরুত্বপূর্ণ।
এদিকে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আশা করছে, নির্ধারিত সূচি অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পারস্পরিক সুবিধাজনক সময়ে আলাদাভাবে ভারতের নয়াদিল্লিতে একটি পূর্ণাঙ্গ দ্বিপক্ষীয় সফর করবেন যেখানে বেশ কয়েকটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর এবং কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণার সম্ভাবনা রয়েছে।
বাংলাদেশে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নতুন সরকার গঠিত হয়েছে এবং ভারতেও মোদির নেতৃত্বে নতুন সরকার গঠিত হলো। এই অবস্থায় সম্পর্কের ধারাবাহিকতা থাকার পাশাপাশি দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে কিছু নতুন উদ্যোগ দেখতে চাওয়াই স্বাভাবিক।
ভারতীয় সংসদের নিম্নকক্ষ ৫৪৩-সদস্যের লোকসভার নির্বাচনে বিজেপি-নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট ২৯৩টি আসনে জয়ী হওয়ার পর মোদি ৯ জুন পরপর তৃতীয়বারের মতো ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন। এর আগে শেখ হাসিনাকে তার সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার আমন্ত্রণ জানান মোদি এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীও আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। নির্বাচনে জয়ের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উষ্ণ শুভেচ্ছার জন্য মোদি তাকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মোদিকে অভিনন্দন জানানো প্রথম বিদেশি নেতাদের মধ্যে ছিলেন, যা দুই নেতার মধ্যে উষ্ণতা এবং ব্যক্তিগত সম্পর্কের বহিঃপ্রকাশ।
মোদি বলেছেন, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে, যা গত এক দশকে অভূতপূর্ব বেড়েছে। এর আগে এক এক্স বার্তায় মোদি বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে জনকেন্দ্রিক অংশীদারিত্ব আরো জোরদার করতে তিনি এক সঙ্গে কাজ করার জন্য উন্মুখ।
দুই নেতা ভারত ২০৪৭ এবং স্মার্ট বাংলাদেশ ২০৪১ অর্জনের লক্ষ্যে ঐতিহাসিক এবং ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে আরো গভীর করার জন্য একসঙ্গে কাজ চালিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। তারা গত এক দশকে উভয় দেশের জনগণের জীবনে অর্জিত উল্লেখযোগ্য উন্নতির কথা স্বীকার করে এবং অর্থনৈতিক ও উন্নয়ন অংশীদারিত্ব, জ্বালানি নিরাপত্তা, ডিজিটাল সংযোগ এবং জনগণের মধ্যে সংযোগসহ সমস্ত সম্পর্ককে আরো বাড়ানোর জন্য উন্মুখ।
এদিকে কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় বিজেপি সরকারকে এবার শরিকদের ওপর নির্ভর করে চলতে হবে। তাই গত এক দশকে যে বিজেপি তথা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কর্তৃত্ব দেখা গেছে, এই মেয়াদে সেটা হয়তো থাকবে না। ভারতে জোট সরকারের ভবিষ্যৎ ভালো হয় না। অতীতের জোট সরকারগুলো মেয়াদই পূর্ণ করতে পারেনি। কাজেই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আগের দুই মেয়াদের মতো স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না বিজেপি সরকার। শরিকদের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে।
ভারতের গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, জোটের রাজনীতির চ্যালেঞ্জের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদির যাত্রা গত এক দশকের মতো মসৃণ না হলেও দেশটির বৈদেশিক নীতিতে তা খুব বেশি প্রভাব ফেলবে না। ২০১৪ সালে মোদি ক্ষমতায় আসার পর থেকে নয়াদিল্লি ভারতের পররাষ্ট্রনীতির একটি মূল উপাদান হিসেবে ‘প্রতিবেশীই প্রথম’ নীতি গ্রহণ করে। এই নীতি অনুযায়ী দেশটির এ অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে তার সম্পর্ক মেরামত এবং জোরদার করার দিকে মনোনিবেশ করেছে।
বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব তৌহিদ হোসেন গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘নয়াদিল্লি ও ঢাকা উভয়েরই নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্বার্থ রয়েছে। বাংলাদেশের বিষয়ে কোনো উল্লেখযোগ্য নীতিগত পরিবর্তন হবে না। কারণ মোদির শরিকরা নিজেদের রাজ্যকেন্দ্রিক চিন্তা করেন, পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে নয়।’
যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ মনে করেন, ‘কোনো কিছুই মোদিকে তার পররাষ্ট্রনীতির লক্ষ্য বাস্তবায়নে বাধা দেবে না। কারণ ভারতীয় সংস্থাগুলো সরকারের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখবে। ভারতকে একটি উদীয়মান বৈশ্বিক শক্তি হিসেবে তুলে ধরার বিষয়ে বিজেপি এবং বিরোধী দলগুলোর মধ্যে খুব বেশি মতবিরোধ নেই।’
অন্যদিকে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, ‘ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ককে অন্য কোনো দেশের সঙ্গে তুলনা করা চলে না। দুই দেশ রক্তের সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ। আগামীতে এই সম্পর্ক আরও উন্নত করব।’
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে নানা বিরূপ মন্তব্য কেউ কেউ করেন না তা নয়, তবে লক্ষণীয় এটাই যে দুই বিপরীত রাজনৈতিক ধারায় বিশ্বাসী হলেও আওয়ামী লীগ ও বিজেপি সরকারের আমলে দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে শীতলতা তৈরি না হয়ে উঞ্চতা বেড়েছে। এবারও হয়তো ব্যতিক্রম হবে না।
লেখক : রাজনীতিবিদ, কলামিস্ট ও চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ।